সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পাতাখোরের বৃষ্টি বিস্ময়!

কোনো একদিন এক পাতাখোর, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের - রেল ব্রীজের ওপরে বসেছিল, দু পা ছড়িয়ে। একেবারে রাজার মেজাজে। ঘোলাটে চোখে, ব্রীজের তলা দিয়ে হরেক ট্রেনের যাওয়া আসা লক্ষ করছিল নিবিষ্ট দৃষ্টিতে। পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে ছিল নোংরা ঝুল কালো কম্বল আর ছেঁড়া কাঁথার কুণ্ডলী, যেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে উপবিষ্ট সম্রাট পঞ্চম জর্জের পায়ে কৃষ্ণ পাথরে তৈরি কুঞ্চিত উত্তরীয় লুটোচ্ছে রাজ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। হয়তো কোনো পাগলের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র এগুলো। তার উপরেই বসেছিল সে। পাশে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের বড় কদম গাছটি পাঁচিলের ওপার থেকে তার উপুড় ডালাপালা মেলে একেবারে ঝেঁপে থাকে ব্রীজের ওপরে। তারই ছায়ার নীচে, পাতাখোরদের মুক্ত রাজত্ব। তা বেশ ছিল। হঠাৎ ঝেঁপে এল বৃষ্টি। কিছুটা সময় পাতার সাহারা পেয়েছিল বটে পাতাখোর টি। কিন্তু সে আর কতক্ষন! খানিক বাদেই ভেজা পাতা চুইয়ে মাটির দিকে ঝুলে থাকা কদম্ব পল্লবের সূচালো অগ্রভাগ দিয়ে টপকাতে লাগলো বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। কোনটা পড়ল তার মাথায়, কোনটা তার দীর্ঘ অযত্নে বেড়ে ওঠা লালচে দাঁড়ির চুলে, কোনটা ভুসা কালির কদর্য ছোপ লেগে থাকা, কলার ছেঁড়া জামায়। বাকি - কম্বল, কাঁথা সব ভিজে ন্যাতা। দারুন বিস্ময়ে পাতাখোরটি তার পোড়া পোড়া, শুকনো দুটি ঠোঁটে - হাঁ হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে- হচ্ছেটা কি? অনেকটা, তিনশ সাড়ে তিনশ বছর আগের সেই রূপকথার মতন আপেল বাগানে বসে থাকা বিস্ময়াবিষ্ট বিজ্ঞানীর মতো চাহনি তার চোখে। গাছ থেকে খসে পড়া পাকা আপেলটি কেন আকাশের দিকে উঠে না গিয়ে মাটিতে এসে পড়ল?

এই কুটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সেদিনকার সেই বিজ্ঞানী বুঝেছিলেন আসলে এ সব অভিকর্ষ বলের কারিকুরি। আইজ্যাক নিউটনের মতো এই পাতাখোর টির মধ্যেও বুঝি একই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আজকে। তবে আপেল বাগিচায় নয়, কদম্ব তলায় বসে বৃষ্টি বিন্দুর পতন দেখে।

জলের ফোঁটা গুলি কেন মাটির ওপর খুঁজে খুঁজে ওর মাথাতেই এসে পড়ে। আকাশের বৃষ্টি আকাশেই ভেসে থাকে না কেন? কেন হাওয়ায় ওড়েনা ডানা মেলা পাখির মতন? হঠাৎ কদম পাতাগুলি, হাওয়ার দমকে চপলা কিশোরীর মতন একে অপরের গায়ে গিয়ে পড়তেই ঝরঝর করে জল টুপিয়ে পড়লো একেবারে পাতাখোরটির মুখের মধ্যে। তাই দেখে পাশে অশ্বত্থ গাছের পাতাগুলি খিলখিলিয়ে উঠলো আর কুশ ঝরানো জলের মত স্খলিত বৃষ্টি বিন্দু দিয়ে আচমন করিয়ে দিলো নীচের ফুটপাথটিকে। জলের সিক্ততা উড়ে গেল, হাওয়ায়। কিছু জল কণা ভেসে থাকলো বাতাসে। যদিও সেই জলকণার ব্যাস অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কিন্তু জল বিন্দু (০.০৬ মিলি) গড়িয়ে পড়লো সেই মাটিতেই। আকাশে জন্ম হলেও সেই মাটিতেই তাকে সেঁধিয়ে যেতে হয় শেষে। কোথাও গাছের পাতা গলে, কোথাও আরসার ধার বয়ে, কোথাও বা টালির চালা বেয়ে এমনকি সুন্দরীর গাল বেয়ে শেষে বুকে এসে থামে বৃষ্টির অনর্গল ধারা প্রবাহ। চারিদিক কেমন বৃষ্টি মালায় সাজানো বাসর হয়ে ওঠে তখন।
একসময় বৃষ্টি থামে। কাপড় মেলা লোহার তার ধরে তবু ঝুলতেই থাকে, কিছু বৃষ্টি বিন্দু। পড়ে না সহসা। রোদের আলোয় মিলিয়ে যাওয়ার আগে। অভিকর্ষ বলের কোন্ সূত্রে আটকে থাকে এমন ঝুলন্ত বিপন্নতা?
আমার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় - কচি পেঁপে গাছের ডালে লেগে থাকা বৃষ্টি ফোঁটা গুলি ঝুলতে ঝুলতে একসময় শুকিয়ে যায়। কিন্তু পড়ে না। জলবিন্দু গুলোর মধ্য দিয়ে কখনো কখনো বৃষ্টি ভেজা সূর্যরশ্মির বিচছুরণে তৈরি হয় বেনিআসহকলা। সাত রঙা রংধনু।
নিউটন আর ওই পাতাখোর দুজনেই বিস্ময়াভিভূত হন যারপরনাই। এ ও সম্ভব! কিন্তু কোন সূত্রে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...