সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খুঁটি পুজা এবং কোলকাতার বাটাম ক্লাব!

ত্রিশূলধারিনী মা দুর্গা আর কবে উপেক্ষা করতে পেরেছেন মাতৃবৎসল সন্তানের কাতর আহ্বান? সেই রামায়ণের সময় থেকে, বারংবার তিনি তার নিদর্শন দিয়ে এসেছেন। ভাবুন একবার, লঙ্কেশ রাবনের হাত থেকে প্রাণাধিক পত্নী সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাওয়া দশরথ নন্দন যখন দেবীর শরণাপন্ন হলেন, তিনি সটান সব নিয়ম ভেঙে তাঁর বসন্ত কালীন যাত্রা কে এগিয়ে আনলেন একেবারে শরতের রোদ বৃষ্টির মধ্যে। অবতার শ্রেষ্ঠ রামের ব্যাকুল আহ্বানে শেষমেশ অকাল বোধন হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার। এবং কালে, কালে মা তাঁর শরৎকালীন অধিবাসেই নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলেন। বিশেষ করে বাংলার বর্ষা উত্তর সজল, স্নিগ্ধ শিউলী, শালুকের শুচি-শুভ্র বন্দনায় মা বিগলিত না হয়ে পারলেন না।

তখন ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ। রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের উদ্যোগে দুর্গা পুজো শুরু হলো রাজবাড়ীর মন্দিরে। সূচনা হলো রাজবাড়ীতে বাৎসরিক দুর্গা আরাধনার। এরপরে যে বিখ্যাত রাজবাড়ীর পুজার কথা জানা যাচ্ছে, তা - কৃষ্ণনগর রাজ বাড়ীর পুজো। সে সময় দিল্লিতে চলছে, মোঘলদের শাসন। মোঘল সম্রাট আকবরের কথিত রাজত্ব কালেই (১৫৬৯-১৬০৫) শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর, রাজবাড়ীর দুর্গা পুজা। রাজা রুদ্র রায়ের উদ্যোগে শুরু হয় এই পুজা। প্রসঙ্গত রাজা রুদ্র রায় ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিতামহ। কিন্ত মা তো সবার! শুধু শুধু রাজবাড়ী তেই বা বন্দী থাকবেন কেন তিনি? কয়েকবছরের মধ্যেই তাই দেখা গেল মা, রাজার রাজবাড়ী ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ধনশালী জমিদারের ঠাকুর দালানে তাঁর আগমনকে সিদ্ধ করে ফেললেন। এবং সর্বপ্রথম তাঁর জমিদার বাড়িতে পা রাখার কাল সূচিত হলো ১৬১০ সাল। বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়িতে। এইভাবে কলির রাজসূয় যজ্ঞ, দুর্গা পুজার আয়োজনে জমিদাররাও তাঁদের নাম যুক্ত করে ফেললেন, মহা আড়ম্বরে। কিন্তু দুর্গা মায়ের আরাধনায় তখনো যেন সাধারনের আগ্রহ ছিল কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। বড্ড বেশী রাজ অনুষঙ্গে ভারাক্রান্ত ছিল তা। সেই আভিজাত্যের গড়েও শেষমেশ ঘটলো আম জনতার প্রবেশ। সাল ১৭৫৭। সালটা ঠিকই ধরেছেন পলাশীর যুদ্ধের। লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঐতিহাসিক জয়ের আনন্দে, বিশেষ দুর্গা পুজার আয়োজন হলো কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী এবং শোভাবাজার, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ীতে। মা দুর্গা মর্ত্য ধামে সর্বপ্রথম পপুলিসট আদলে পূজিতা হতে শুরু করলেন। কিন্তু সন্তানের ইচ্ছা যেন তাতেও পূর্ণ হচ্ছিলো না। অবশেষে ১৭৯০ সালে, মা সে আশাও পূর্ণ করলেন। হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় সেই প্রথম আক্ষরিক অর্থেই বারোইয়ারী দুর্গা পুজা শুরু হলো। যদিও এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে গুপ্তিপাড়ায় দুর্গা নয় জগদ্ধাত্রী পূজা হয়েছিল। যদিও কথিত রূপে এই পুজোর উদ্যোক্তা ছিলেন ১২ জন বন্ধু, এবং যারা প্রত্যেকে ব্রাহ্মণ যুবক ছিলেন বলে সর্বজনস্বীকৃত। উল্লেখযোগ্য ভাবে সেই প্রথম কোনো একজন রাজা বা একজন জমিদারের বাইরে একাধিক সাধারন মানুষের উদ্যোগে দুর্গা পূজা হওয়া শুরু হোল। উপরিউক্ত ক্ষেত্রে  ১২ জন মিলে পূজা করেছিল বলে তা বারোয়ারী পূজা হিসেবে পরিগণিত হয় এবং বর্তমানে তাই ই ক্লাব পুজায় পর্যবসিত হয়েছে। এইভাবে মা ক্রমে ক্রমে রাজতন্ত্র থেকে জমিদার তন্ত্র এবং সবশেষে গনতান্ত্রিক হয়ে বারো ইয়ারী তথা সর্বজনীন হয়ে পড়লেন। কোলকাতায় সর্বপ্রথম বারোয়ারী পুজো শুরু হয় কাশিপুরের রাজা হরিনাথ রায়ের উদ্যোগে। এ যেন সন্তানের মন রক্ষায় একেবারে কল্পতরুর মতোই সন্তানের সকল সুপ্ত আকাঙ্খা এক এক করে পূর্ণ করে চলেছেন, মা। কোথায় সেই বিশাল, সুদৃশ্য রাজমন্দির, সেখান থেকে জমিদারের উঁচু ঠাকুর দালান। শেষে তাও ছেড়ে মা এখন পুজোর কদিন অবলীলায় আশ্রয় নেন বাঁশ কাপড়ে বাঁধা পলকা প্যান্ডেলের মধ্যে। ভাবা যায়।

মায়ের কৃপা যেন সত্যি সত্যিই শেষ হতে চায় না। এই নিরবিচ্ছিন কৃপার শেষতম দৃষ্টান্ত খুঁটি পূজার কথা উল্লেখ করে উপসংহার টানবো আজকের প্রবন্ধের। 
এখনোও বনেদি বাড়ীতে, মায়ের মূর্তি তৈরি করেন যিনি, সেই মূর্তিকার রথযাত্রার পুন্য দিনে
 খড় বাঁশের কাঠামোয় মাটি লেপন করা শুরু করেন। এই উপলক্ষে করা হয় কাঠামো পুজা বা পাট পুজার আয়োজন। এবং তারপরেই শুরু হয় মায়ের আগমনের দিন গোনা। কাউন্টডাউন। বারোয়ারী পুজোর ক্ষেত্রে এরকম কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে। সেই কবে মহালয়া হবে তারপরে পিতৃপক্ষের অবসানে শুরু হবে মায়ের আগমনী গান গাওয়ার পালা। অত বিলম্ব কি করেই বা সওয়া যায়। মা তাদের সেই মনোবাঞ্ছা ও অবশেষে পূর্ণ করেছেন কয়েকবছর হলো। তারা এখন মহা সমারোহে খুঁটি পুজা নামক এক পুজা করা শুরু করেছেন। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সেই খুঁটি পুজাও শুরু হচ্ছে সেই রথযাত্রার দিন থেকেই। একেবারে, উদ্ভাবনী শক্তির চুড়ান্ত।  প্যান্ডেলের খুঁটি কে ধান দুর্বা, ফুল, রঙীন ফিতে ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে, ব্রাহ্মণ ডেকে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ছোট বড় বিভিন্ন ক্লাবের খুঁটি পুজোর আয়োজন করা হয়। মন্ত্রী, সান্ত্রী, নেতা, অভিনেতার হাজিরায় একেবারে সরগরম বর্তমান খুঁটি পুজার বাজার। আগে মূর্তীর কাঠামো পুজো হতো আর এখন মূর্তীর নয় প্যান্ডেলের ভিত পুজো করা হচ্ছে খুঁটি পুজোর মাধ্যমে। মা তাও মেনে নিয়েছেন এবং বলাই বাহুল্য বিনা বাক্যে।

মায়ের সহ্য শক্তির সত্যিই জবাব নেই। খোদ কোলকাতা শহরেই তাই বাটাম ক্লাবের পরিচালনায় বিগত ৩৩ বছর ধরে মা সাড়ম্বরে পুজিতা হয়ে আসছেন। এবছর ৩৪ বছরে পড়েছে সে পুজো। সম্প্রতি তাদের খুঁটি পুজো সম্পন্ন হোল। শরত বোস রোডের ওপরে টাঙানো ফেস্টুনে সগৌরবে সে কথাই লেখা হয়েছে বড় বড় করে। বাংলায় একটা প্রচলিত স্ল্যাং আছে, এই বাটাম নিয়ে। মারমুখী মানুষ প্রায়শই প্রতিপক্ষকে বাটাম দেওয়ার কথা বলে। বাটাম কথাটির অর্থ কাঠের তৈরী একটি পাটাতন। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি।  যদিও বাটাম নামের ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের একটি বড় শহর ও রয়েছে। সে যাই হোক, বাটাম ক্লাবের সভ্যরা যে সময়ে সময়ে বাটাম ধরতেও সিদ্ধহস্ত তা মা ছাড়া কেই বা ভালো জানেন। খড়্গ ধারিনী মায়ের কাছে তাই বাটাম ধারী সন্তানেরা কখনোই ব্রাত্য নয়।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...