ত্রিশূলধারিনী মা দুর্গা আর কবে উপেক্ষা করতে পেরেছেন মাতৃবৎসল সন্তানের কাতর আহ্বান? সেই রামায়ণের সময় থেকে, বারংবার তিনি তার নিদর্শন দিয়ে এসেছেন। ভাবুন একবার, লঙ্কেশ রাবনের হাত থেকে প্রাণাধিক পত্নী সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাওয়া দশরথ নন্দন যখন দেবীর শরণাপন্ন হলেন, তিনি সটান সব নিয়ম ভেঙে তাঁর বসন্ত কালীন যাত্রা কে এগিয়ে আনলেন একেবারে শরতের রোদ বৃষ্টির মধ্যে। অবতার শ্রেষ্ঠ রামের ব্যাকুল আহ্বানে শেষমেশ অকাল বোধন হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার। এবং কালে, কালে মা তাঁর শরৎকালীন অধিবাসেই নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করলেন। বিশেষ করে বাংলার বর্ষা উত্তর সজল, স্নিগ্ধ শিউলী, শালুকের শুচি-শুভ্র বন্দনায় মা বিগলিত না হয়ে পারলেন না।
তখন ১৪৮০
খ্রীস্টাব্দ। রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের উদ্যোগে দুর্গা পুজো
শুরু হলো রাজবাড়ীর মন্দিরে। সূচনা হলো রাজবাড়ীতে বাৎসরিক দুর্গা আরাধনার। এরপরে
যে বিখ্যাত রাজবাড়ীর পুজার কথা জানা যাচ্ছে, তা - কৃষ্ণনগর রাজ বাড়ীর পুজো। সে সময় দিল্লিতে চলছে, মোঘলদের শাসন। মোঘল সম্রাট আকবরের কথিত রাজত্ব কালেই
(১৫৬৯-১৬০৫) শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর, রাজবাড়ীর দুর্গা পুজা। রাজা রুদ্র রায়ের
উদ্যোগে শুরু হয় এই পুজা। প্রসঙ্গত রাজা রুদ্র রায় ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
পিতামহ। কিন্ত মা তো সবার! শুধু শুধু রাজবাড়ী তেই বা বন্দী থাকবেন কেন তিনি? কয়েকবছরের মধ্যেই তাই দেখা গেল মা, রাজার রাজবাড়ী ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ধনশালী
জমিদারের ঠাকুর দালানে তাঁর আগমনকে সিদ্ধ করে ফেললেন। এবং সর্বপ্রথম তাঁর জমিদার
বাড়িতে পা রাখার কাল সূচিত হলো ১৬১০ সাল। বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়িতে। এইভাবে কলির রাজসূয় যজ্ঞ, দুর্গা পুজার আয়োজনে জমিদাররাও তাঁদের নাম
যুক্ত করে ফেললেন,
মহা আড়ম্বরে। কিন্তু দুর্গা
মায়ের আরাধনায় তখনো যেন সাধারনের আগ্রহ ছিল কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। বড্ড বেশী রাজ
অনুষঙ্গে ভারাক্রান্ত ছিল তা। সেই আভিজাত্যের গড়েও শেষমেশ ঘটলো আম জনতার প্রবেশ।
সাল ১৭৫৭। সালটা ঠিকই ধরেছেন পলাশীর যুদ্ধের। লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে নবাব
সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঐতিহাসিক জয়ের আনন্দে, বিশেষ দুর্গা পুজার আয়োজন হলো কৃষ্ণনগর
রাজবাড়ী এবং শোভাবাজার,
রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ীতে। মা
দুর্গা মর্ত্য ধামে সর্বপ্রথম পপুলিসট আদলে পূজিতা হতে শুরু করলেন। কিন্তু
সন্তানের ইচ্ছা যেন তাতেও পূর্ণ হচ্ছিলো না। অবশেষে ১৭৯০ সালে,
মা সে আশাও পূর্ণ করলেন। হুগলীর
গুপ্তিপাড়ায় সেই প্রথম আক্ষরিক অর্থেই বারোইয়ারী দুর্গা পুজা শুরু হলো। যদিও এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে গুপ্তিপাড়ায় দুর্গা নয় জগদ্ধাত্রী পূজা হয়েছিল। যদিও কথিত রূপে এই পুজোর উদ্যোক্তা ছিলেন ১২ জন বন্ধু, এবং যারা প্রত্যেকে ব্রাহ্মণ যুবক ছিলেন বলে সর্বজনস্বীকৃত। উল্লেখযোগ্য ভাবে সেই প্রথম কোনো একজন রাজা বা একজন জমিদারের বাইরে একাধিক সাধারন মানুষের উদ্যোগে দুর্গা পূজা হওয়া শুরু হোল। উপরিউক্ত ক্ষেত্রে ১২ জন মিলে পূজা করেছিল বলে তা বারোয়ারী পূজা হিসেবে পরিগণিত হয় এবং বর্তমানে তাই ই ক্লাব পুজায় পর্যবসিত হয়েছে। এইভাবে মা ক্রমে ক্রমে রাজতন্ত্র থেকে জমিদার
তন্ত্র এবং সবশেষে গনতান্ত্রিক হয়ে বারো ইয়ারী তথা সর্বজনীন হয়ে পড়লেন।
কোলকাতায় সর্বপ্রথম বারোয়ারী পুজো শুরু হয় কাশিপুরের রাজা হরিনাথ রায়ের
উদ্যোগে। এ যেন সন্তানের মন রক্ষায় একেবারে কল্পতরুর মতোই সন্তানের সকল সুপ্ত
আকাঙ্খা এক এক করে পূর্ণ করে চলেছেন, মা। কোথায় সেই বিশাল, সুদৃশ্য রাজমন্দির, সেখান থেকে জমিদারের উঁচু ঠাকুর
দালান। শেষে তাও ছেড়ে মা এখন পুজোর কদিন অবলীলায় আশ্রয় নেন বাঁশ কাপড়ে বাঁধা পলকা প্যান্ডেলের
মধ্যে। ভাবা যায়।
মায়ের
কৃপা যেন সত্যি সত্যিই শেষ হতে চায় না। এই নিরবিচ্ছিন কৃপার শেষতম দৃষ্টান্ত খুঁটি পূজার কথা উল্লেখ করে উপসংহার টানবো আজকের প্রবন্ধের।
এখনোও বনেদি বাড়ীতে, মায়ের মূর্তি তৈরি করেন যিনি, সেই মূর্তিকার রথযাত্রার পুন্য দিনে খড় বাঁশের কাঠামোয় মাটি লেপন করা
শুরু করেন। এই উপলক্ষে করা হয় কাঠামো পুজা বা পাট পুজার আয়োজন। এবং তারপরেই শুরু
হয় মায়ের আগমনের দিন গোনা। কাউন্টডাউন। বারোয়ারী পুজোর ক্ষেত্রে এরকম কোনো
ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কোন দুঃখে। সেই কবে মহালয়া হবে
তারপরে পিতৃপক্ষের অবসানে শুরু হবে মায়ের আগমনী গান গাওয়ার পালা। অত বিলম্ব কি করেই বা সওয়া যায়। মা তাদের
সেই মনোবাঞ্ছা ও অবশেষে পূর্ণ করেছেন কয়েকবছর হলো। তারা এখন মহা সমারোহে খুঁটি পুজা
নামক এক পুজা করা শুরু করেছেন। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সেই খুঁটি পুজাও শুরু হচ্ছে সেই রথযাত্রার দিন থেকেই। একেবারে, উদ্ভাবনী শক্তির চুড়ান্ত। প্যান্ডেলের খুঁটি কে ধান
দুর্বা,
ফুল, রঙীন ফিতে ইত্যাদি দিয়ে
সুন্দর করে সাজিয়ে,
ব্রাহ্মণ ডেকে পবিত্র
মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ছোট বড় বিভিন্ন ক্লাবের খুঁটি পুজোর আয়োজন করা হয়। মন্ত্রী, সান্ত্রী, নেতা, অভিনেতার হাজিরায় একেবারে সরগরম বর্তমান খুঁটি পুজার বাজার। আগে মূর্তীর কাঠামো পুজো হতো
আর এখন মূর্তীর নয় প্যান্ডেলের ভিত পুজো করা হচ্ছে খুঁটি পুজোর মাধ্যমে। মা তাও মেনে
নিয়েছেন এবং বলাই বাহুল্য বিনা বাক্যে।
মায়ের
সহ্য শক্তির সত্যিই জবাব নেই। খোদ কোলকাতা শহরেই তাই বাটাম ক্লাবের পরিচালনায়
বিগত ৩৩ বছর ধরে মা সাড়ম্বরে পুজিতা হয়ে আসছেন। এবছর ৩৪ বছরে পড়েছে সে পুজো। সম্প্রতি তাদের খুঁটি পুজো সম্পন্ন হোল। শরত বোস রোডের ওপরে টাঙানো ফেস্টুনে সগৌরবে
সে কথাই লেখা হয়েছে বড় বড় করে। বাংলায় একটা প্রচলিত স্ল্যাং আছে, এই বাটাম নিয়ে। মারমুখী মানুষ প্রায়শই
প্রতিপক্ষকে বাটাম দেওয়ার কথা বলে। বাটাম কথাটির অর্থ কাঠের তৈরী একটি পাটাতন। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। যদিও বাটাম নামের ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের একটি বড় শহর ও রয়েছে। সে যাই হোক, বাটাম ক্লাবের সভ্যরা যে সময়ে সময়ে বাটাম
ধরতেও সিদ্ধহস্ত তা মা ছাড়া কেই বা ভালো জানেন। খড়্গ ধারিনী মায়ের কাছে তাই
বাটাম ধারী সন্তানেরা কখনোই ব্রাত্য নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন