এক শনিবারের দুপুরে কলেজ স্ট্রিটে হানা দিয়েছিলাম মেয়ের জন্য ক্লাস ইলেভেনের নৃ-তত্ত্ববিদ্যার পাঠ্য বই কিনবো বলে। এ দোকান, ও দোকান ঘুরে বই খুঁজে না পেলেও খুঁজে পেয়ে গেলাম ২০০ বছরেরও বেশী প্রাচীন কলেজ স্ট্রিটের বুকে এখনও টিকে থাকা সবচেয়ে পুরনো বই দোকানটিকে। ৫৪/৩ কলেজ স্ট্রিট, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। দ্বিশতবর্ষ প্রাচীন (১৮১৭) প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার উল্টোদিকে তাকালে নজরে পড়বে এই দোকানের হোর্ডিং। 'বড় দোকান' বলে পরিচিত এই দোকান চলছে সেই ১৮৮৬ সাল থেকে। তবে শুরুর দিনে অর্থাৎ ১৮৮৬ তে কিন্তু দোকানের অবস্থান এখানে ছিল না, বর্তমানে যেখানে রয়েছে। দোকানটি প্রথমে চালু হয়, শ্যামাচরন দে স্ট্রীটে। দীর্ঘ ১৬ বছর সেখানে থাকার পরে ১৯০২ সালে, উঠে আসে বর্তমান ঠিকানায়।
এখন দোকানে ঢুকলেই চোখে পড়বে বড় বড় মোটা অক্ষরে লেখা - বুক সেলার্স সিন্স ১৮৮৬।
ক্রেতাদের ভিড় সামলে দোকানের বর্তমান কর্ণধার অরবিন্দ দাশগুপ্ত শুধু বললেন, "এখনও কলেজ স্ট্রিট দিয়ে ট্রাম চলে তবে তা বৈদ্যুতিক। এই দোকানের প্রতিষ্ঠার সময়ে চলতো ঘোড়ায় টানা।" জিজ্ঞাসা করলাম প্রতিষ্ঠাতা গিরীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত উনার কে হন।
প্রসঙ্গত গিরীশ বাবু এসেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের কালিয়া থেকে। শোনা যায় বাংলাদেশ থেকে কোলকাতা আসার পথে স্টিমারে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে। মহেশ বাবুও গিরীশ চন্দ্রের মতোই ঘর ছেড়ে ব্রিটিশ রাজধানী কোলকাতায় আসছিলেন আপন ভাগ্য সন্ধানের উদ্দেশ্যে। স্টিমারেই গিরীশ চন্দ্র কে বই ব্যবসা করার পরামর্শ দেন মহেশ ভট্টাচার্য। ৭৪ বছর বয়সী, বর্তমান মালিক অরবিন্দ বাবু, সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাতা গিরীশ চন্দ্রের প্রপৌত্র হন অর্থাৎ নাতির ছেলে। আমার প্রশ্নের উত্তরে অরবিন্দ বাবু সেই কথাই বললেন, "গিরীশ চন্দ্র হচ্ছেন আমার দাদুর বাবা।" অর্থাৎ চতুর্থ পুরুষে পড়েছে ১৩৭ বছরের প্রাচীন এই ব্যবসা। যদিও শুধু বই বিক্রি নয়, বই প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত এই দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই বই এর প্রকাশনা হয় বর্তমানে।
তবে অরবিন্দ
বাবুর বাবা অমূল্য চন্দ্র দাশগুপ্তের আমলে সাময়িক বই প্রকাশনা বন্ধ ছিল। সে সময়
বইয়ের ব্যবসা এতটাই ফুলে ফেঁপে উঠেছিল যে বাড়তি সময় দিতে গিয়ে ছেদ পড়েছিল
প্রকাশনায়। যা পুনরায় শুরু করেছেন, অরবিন্দ বাবু। এর পাশাপাশি ‘ইতিবৃত্ত’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রতি
বছর প্রকাশিত হয় অরবিন্দ বাবুর উদ্যোগে। পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন
বিশিষ্ট সাহিত্যিক রামচন্দ্র প্রামানিক।
কলেজ স্ট্রীটে বইয়ের ব্যবসায় বরাবরই পথ দেখিয়েছে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি
প্রাইভেট লিমিটেড।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বদলে ফেলার পাশাপাশি দেশ বিদেশ থেকে বই আনানোর প্রশ্নেও দাশগুপ্তরা অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। আমেরিকান বিভিন্ন প্রকাশকের থেকে বই আনানো শুরু করেন অরবিন্দ বাবুর বাবা অমূল্য চন্দ্র দাশগুপ্ত। সেই পরম্পরা সমানে চলছে। কলেজ স্ট্রীটে একটা কথা প্রচলিত আছে, দাশগুপ্ত তে কোনো বই না পেলে সেটা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বইয়ের সাগর প্রমান সম্ভার এখানে। থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন আলমারি ও তাকে এবং পুরো ক্লাসিফাইড পদ্ধতিতে। কোনটার ওপরে লেখা আছে নভেল, কোনটার গায়ে সায়েন্স।
দোকানের ডানদিকে লাল রঙের নকশাদার পেঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানেও রয়েছে অঢেল দেশী ও বিদেশী বইয়ের বিপুল স্টক। কিছু ছবি নিলাম। ছবি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ নেই যদিও।
সবশেষে বেরিয়ে আসার মুখে মুখোমুখি হলাম সেই অ্যান্টিক গোল দেওয়াল ঘড়ির, তাতে লেখা - কাফে দে প্যারিস, নীচে লেখা সাল – ১৮৮৭। হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা মনে করিয়ে দিল ঘড়িটি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন