আলোর পরশে জেগে ওঠা সে শিহরণ, বড় আকাঙ্খিত। তবু যেন চোখ তুলে তাকাতে কেমন
বাধে। ভ্রু পল্লব
সম পুষ্প দলে যেন কত যুগের দ্বিধা। অধোনমিত মুখে সুলগ্ন ফুলশয্যার লাজ, চুড়ান্ত বিহ্বলতার সেই ক্ষণ, অনুক্ষণ গুলোকে যেন ধরে রাখতে
চায় জীবনের অমূল্য সঞ্চয় করে। আসলে সে অবর্ণনীয় অনুরণন শুধুই যে অনুভব দিয়ে
শুষে নেওয়া যায়,
কাছে
পেয়েও তাই তো
তাকে হারাতে চায় দু চোখে।
রবি কবির কথায় - প্রাণ চায়, চক্ষু না চায় দশা।
তবু সে শুভ্র
আলোর সোহাগ তার পরতে পরতে জাগিয়ে তোলে রঙের উৎসার। ছড়িয়ে দেয় সাত রঙের
বিচ্ছুরণ।
বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন সেই কবে আলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাতরঙ্গী বাহার কে খুঁজে বের করেছিলেন। প্রমান করেছিলেন, বর্ণালীর ভিন্ন ভিন্ন সাত রঙের সম্পূর্ণ
সঙ্গমেই জন্ম নেয় এক ফালি সকালের রোদের।
তাই তো আমাদের পুরানেও সূর্যদেবের সাতটি ঘোড়া থাকার কথা বলা হয়েছে। সাতটি
ঘোড়া আসলে বর্ণালীর সাত রঙ - বে নি আ স হ ক লা কেই নির্দেশ করে।
সেই আলোর পরশেই,
পান্না হয়
সবুজ; শোণিত লাল হয় চূণী; রোদের রঙ হয় গাঢ় সোনালী আর জোছনার রঙ পেলব রূপোলী।
আলোর স্পর্শেই ফুটে ওঠে শুচি শুভ্র শিউলি আবার ঝরেও পড়ে বনতলে। গাঁদার রঙে লাগে হরিদ্রাভ আভা। আবার মায়ের চরণে রাখা জবা
পায় রক্ত লাল রঙ।
সেই আলোর সন্ধানেই সবুজ পাতা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় রোদের
স্পর্শ কে। আলোর পরশেই
ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে ওঠে সে।
পৃথিবীর তপস্যা আসলে আলোর তপস্যা। আলোর ধ্যানেই এই ধরা কাটিয়ে দিয়েছে কত
হাজার লক্ষ বছর,
না জানি
কাটাবে আরো কত বছর। আলোর ব্রতেই উপনিষদীয় মুনী ঋষিদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল - তমস মা
জ্যোতির্গময়। জগতে, আলোর সেই অনুপ্লাবন সদা ধাবিত তার
পবিত্র স্রোতধারায়। পৃথিবীর আনাচে কানাচে, যত ব্রাত্য অপাঙক্তেয় সকলের মধ্যেই তার
অকৃপণ উপস্থিতি।
আলোর উৎসবে তাই 'সবার
নিমন্ত্রণ'। জাতি
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই পৃথিবীর আলোক সম্পদের সমান অংশীদার। আলোই পৃথিবীর
সবচেয়ে আদি অনুভূতি। অকৃত্রিম অনুভব।
ধন্য আলো,
ধন্য তার
মধুর আপতন।
জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন