সাধারনের চোখে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যে মুগ্ধতার আবেশ রচনা করে তা তাদের অনুভবের আয়নায় যথেষ্ট ঝকমক করলেও তাকে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না সাধারণ মানুষ। প্রকৃতির অপরুপ রূপের বিচ্ছুরনকে শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে তাই সাহিত্যের ভাষাই একমাত্র মাধ্যম। যে ভাষায় প্রকৃতির অনুপম সৃষ্টি মহিমাকে নিরন্তর অনুবাদ করে চলেন কবি ও সাহিত্যিকেরা। করে তোলেন সাধারনের পাঠ যোগ্য। প্রকৃতি তার অনন্য সৃষ্টি রহস্য নিরন্তর বুনে চলে পৃথিবীর আনাচে কানাচে, সর্বত্র। এটা সত্যি যে তাকে খালি চোখে দেখা যায় এবং তার সৌন্দর্যের মধুর লীলা মনের মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভালোলাগার আবেশও তৈরি করে কিন্তু তার মর্মোদ্ধার করার প্রশ্নে পুরো ব্যাপারটা অন্ধের হস্তি দর্শনের মতোই থেকে যায় অব্যক্ত। আর এখানেই সাহিত্যের ভূমিকা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। সাহিত্য তার অনুপম সাবলীল ভাষায় শুধু যে প্রকৃতির পাঠোদ্ধারই করে তাই নয় তার ভাবার্থ কে সার্থক অনুবাদের মাধ্যমে করে তোলে সাধারনের বোধগম্য। । সাহিত্যের কল্যানে প্রকৃতির রহস্যময় সৃষ্টিলেখা হয়ে ওঠে প্রকৃতির সহজ পাঠ।
বিগত কয়েকমাস ধরে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত
ইচ্ছায় আমাদের চারপাশে, যত্র তত্র ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির অমুল্য কিছু সৃষ্টি
সম্ভারকে সাহিত্যের ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। তারই কিছু বাছাই করা লেখার
সংকলন থাকলো এখানে, সুন্দর ছবি সহ।
প্রথমঃ
প্রিয়তমার
হাতের ফুল সজ্জা যেন। তপোবনের নিভৃতে লাবণ্যময় উন্মুক্ত বাহু লালিত্যের শোভা বর্ধনের
অনন্য এই উপকরণ গুলো এমনিই ফুটে থাকে পথের ধারে, ঘাসের পরে।
আসলে সৃষ্টি করেন সৃষ্টিকর্তা কিন্তু তাকে অনুবাদ করে সাধারণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন অগণিত সাহিত্য সেবী মানুষজন। তাঁরাই স্রষ্টার আসল অনুবাদক।
ভুজঙ্গের ন্যায় উত্থিত তার দেহ বিভঙ্গ। বিষধর ফণীর চুম্বন স্পৃহা তার মঞ্জরী শোভিত পুষ্প দন্ডের হালকা ঝুঁকে পড়া শিখর ভাগে; দৃশ্যত এক ভয়ঙ্কর, সবুজ সর্পের আবেশ ছড়ানো এই তৃণ মঞ্জরীর শিরায় শিরায়।
কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় শিল্পী তার সৃজন কার্যে কতটা খুঁতখুঁতে।
আসলে শিল্পী মানুষটি বড় অগোছালো এবং ভীষণ ভুলো ধরনের। এমন অপরূপ সৃষ্টি কর্মও তাই
গুছিয়ে রাখা দুরস্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোথায় কোথায় যে ফেলে রাখেন অনাদরে, তার ঠিক থাকে না। বন বাদাড়, জলাভূমি, পথের দুধারের ধুলো মাখা পরিসর - কোনোকিছুই ব্রাত্য নয় তাঁর কাছে।
;
তাঁর অনুপম
শিল্প কলা ফুটিয়ে তোলার কাজে অকৃত্রিম এই এলোমেলো বুকগুলোকেই ক্যানভাস করে গড়ে নেন তিনি।
আসলে শিল্পী মানুষটি ভীষণ অন্তর্মুখী। শিল্প কৃতির মান রক্ষার ব্যাপারে তিনি যতটা তৎপর ততটাই উদাসীন শিল্পের প্রচারে।তার স্থির বিশ্বাস সময় তার সুবিশাল গ্যালারিতে নিশ্চয়ই তুলে রাখছে তাঁর দৃশ্যমান সমস্ত পার্থিব ক্যানভাসকে, যত্ন করে সাজিয়ে রাখছে আনমোল কোনো অলংকারের মতন।
চতুর্থ ঃ
খুব সন্তর্পনে ধরার চেষ্টা করেছিলাম মুক্তোর দানা গুলোকে। টোকা লেগে কিংবা কোনো বদখেয়ালী হাওয়ার অদৃশ্য আদরের ছোঁয়ায় যদি খসে পড়ে ঝুরঝুর করে তবে অনর্থ হবে ধরাতলে। ভারী মন খারাপ হবে রোদেরও। দিনের নব কৌমার্য হরনের বাসনা তার অপূর্ণই থেকে যাবে। ভোরের অতিথি হয়ে এসে সবুজ দুর্বা দল শাখায় মুক্তোর হার পরিয়ে খানিক উপহার হস্তান্তর করার ভঙ্গিতে প্রতিসরণের বিচ্ছুরণে ঝলমল করে ওঠার সে'বিপন্ন বিস্ময়' জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন সফল হবে না যে।
তাই খুব সাবধানে,
গোপনে
গোপনে অনেক অনেক রিয়েল নির্ভেজাল মুক্তোর সন্ধান দিয়ে দিলাম।ঝিনুকের সুপ্তি সজ্জা খুঁজে আর যেতে
হবে না সমুদ্রের অতল গভীরে।
পঞ্চম ঃ
ওরকম ৩৬০° কোণের জঙ্গল; চারিদিকে ঝোপ ঝাড়,
ডালাপালা, লতা গুল্মে ঘিরে থাকা একেবারে গা ছমছমে
পরিবেশ;
সূর্যের আলো কদাচিৎ যদি ঢুকেও পড়ে এখানে বেরনোর রাস্তা
খুঁজে পায় না। মনে হয় যেন কোন্ মূল্যবান গুপ্তধন আগলাচ্ছে এই নিভৃত, ছায়াচারী অরন্যটি!
স্বপন
বুড়োর লেখা কোনো গোয়েন্দা গল্পের ভয়ানক রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা পটভূমির মতো তার
গা ঝিমঝিম করা আবেশ।
রহস্যের
ঘোর আরোও বাড়িয়ে দেয় জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিলভার কালারড্ ফোর
হুইলার।
গাছের পাতা
গুলো থেকে টুপিয়ে পড়া শিশিরের জলে গাড়িটির কাঁচ কেমন অস্বচ্ছ, ঘোলাটে। মাঝে মধ্যে হালকা হাওয়ায় ছায়াগুলো দুলে দুলে উঠছে ভুতের মতো।
যাক গে, সব দেখে শুনে আমারই একটা রহস্য গল্প লেখার
ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু থাক। পরে হবে ক্ষণ।
কি জানি
হয়তো গভীর রাত্তিরে দপ করে গাড়িটির হেডলাইট জ্বলে ওঠে কি না। তবে কে আর দেখতে
আসছে।
ষষ্ঠ ঃ
প্রকৃতি কখনো নিরাশ করে না।
দেখি তার ও লাগে নিজেকে দেখার জন্য, জল ভরা বড় আয়না। হাওয়ায়
দুলে দুলে, কখনো কম্পিত কখনো নিস্পন্দ যেন আসবে প্রিয় কত দিন বাদে, তাই সাজঘরে আজ তরুণ উদ্যম, নবরূপে সেজে ওঠার প্রেরণা।
সপ্তমঃ
পুষ্প
মঞ্জরী যতটা না ফুল ভারে নেতিয়ে পড়ে , তার থেকে নিজেকে প্রেমাবনত করে সাজিয়ে তোলার তাগিদ থাকে বেশী।
জ্যামিতিক
নিখুঁত কৌণিক সজ্জায় একটার পর একটা মঞ্জরী দন্ড গ্রন্থিত
হয় উপহারের ডালির মতন। প্রিয়তমের পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখতেই যে তার এমন অপরূপ, অপূর্ব সাজ।
এমনকি
মাটির সে গভীর টানকেও উপেক্ষা করে সলজ্জ ভঙ্গিমায়, ভোরের পর ভোর আকাশের পানে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকে সবিস্ময়ে। কখন আসবে সে, প্রবল অনুরাগ ভরে তাকে চয়ন করে নেবে নিজের
করে।
অষ্টম ঃ
পৃথিবীকে
সাজানোর দায় সবার! তা সে আকাশ মেঘে ঢাকা হোক কি নীল নির্মেঘ, ধরা তলে নিত্য ফুটে চলে সে চমৎকার!
আনন্দে, শোকে, লীলায় কিংবা লাস্যে সবেতেই তার সৌন্দর্যের মহিমা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর
আনাচে কানাচে ছড়ানো থাকে সে অমূল্য প্রতিভার সাক্ষর। শুধু তাকে চয়ন করে আপন করে
নিতে হয় নিজের মতন।
নবমঃ
সকালে, হেমন্তের রোদে বেশ একটা রেশমী প্রলেপ লেগে
থাকে যেন। কুয়াশার সাদা জলকণার মধ্য দিয়ে আলোক বিচ্ছুরিত হয় বলে হয়তো। দারুন একটা আয়েসি ভাব থাকে তার বিস্তারে।
কার্তিকের
সবুজাভ হলুদ ধানক্ষেতের ওপরে ছড়িয়ে পড়া হৈমন্তী ভোরের আলোয় তাই দেখা যায় সেই
বিরল লেবু রঙের আভা। না দেখলে সত্যিই তা বিশ্বাস করা যায় না।দেখতে, দেখতে তাই মনে চলে আসে নীচের দুই লাইন।
রেশমী
হৈমন্তী,
ভোরের
সুকান্তী
দশমঃ
তোমার সুললিত
কর স্পর্শে বুজে যাক আমার আঁখি পল্লব, এই আমার একান্ত অভিপ্রায়!
ছবির ফুলটি
হোল লজ্জাবতী ফুল, এই প্রথম দেখলাম আমি। লজ্জাবতী গাছ দেখেছি আগে, গাছ নাড়িয়ে লজ্জা পেয়ে যাওয় লজ্জা পত্রের
ধীরে ধীরে চুপসে আসার দৃশ্যও দেখেছি তারিয়ে তারিয়ে, কিন্তু ফুল এই
প্রথম।
পথের ধারে, মাঠে, ঝোপে ঝাড়ে
এমনিই অযত্নে বেড়ে ওঠে। আসলে নিভৃতেই যেন লজ্জাবতী তার রূপ লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতে
বেশী ভালোবাসে, পাছে কেউ ছুঁয়ে ফেলে এই ভয়ে হয়তো।
পাদটীকা:-
ওপরের লেখায় কর শব্দটি ব্যবহার করেছি দুটো অর্থে। কারণ কর মানে যেমন রশ্মি হয়
আবার হাত ও হয়। রশ্মি বলতে সূর্য রশ্মি, কিন্তু সূর্যের আলোর স্পর্শে তো আর লজ্জাবতী
লজ্জা পায় না, পায় হাতের ছোঁয়ায়। একই ভাবে আঁখি পল্লব বলতে লজ্জাবতীর পাতার কথা বলতে
চেয়েছি।। কারণ হাতের ছোঁয়ায় লজ্জাবতীর পাতা ঝিমিয়ে গেলেও ফুল কিন্ত থাকে আগের
মতোই নিঃসংকোচ এবং আগের মতোই সমান প্রিয়দর্শিনী।
একাদশঃ
প্রকৃতি তার সেরা সৃষ্টি
গুলোকে সকলের অলক্ষ্যেই রচনা করে থাকে। আনাচে কানাচে, লতা পাতার দেহাতি ভিড়ের মধ্যে, সকল বিদগ্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে
এমনিই এক কেতাহীন অবস্থায় আপন শোভার মহিমা ছেড়ে যায়। যে চেনার তাকে ঠিকই চিনে
নিতে পারে। রইল বাকি মান পত্র, তা তো তোলাই থাকে কালের দেরাজে। আর কি, চাই!
দ্বাদশ ঃ
স্বপ্ন আসলে, ভালোলাগা রঙের
ছোঁয়া লেগে থাকা!
প্রকৃতির লুকোনোর কিছু নেই আবার দেখানোর ও কিছু নেই। যা কিছু থাকে, খোলা অ্যালবামে। তবে একটা ব্যাপারে প্রকৃতি কিন্তু বেশ খুঁতখুঁতে। হোক না সে বুনোফুল, তবু তাকেই সে সাজাবে তার সকল শক্তি দিয়ে। শোকেসে তোলার আগে রূপচর্চার সকল সুন্দর প্রসাধনী দিয়ে তাকে নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে তুলতে প্রকৃতির যেন কোনো ক্লান্তি নেই।
চতুর্দশ ঃ
কেউ দেখুক
আর না দেখুক,
প্রকৃতি থামে না। তার আপন
খেয়ালেই সে সাজিয়ে যায় আমাদের চারদিকের ভুবনকে।
আপনি আমি
লাইক কমেন্ট শেয়ার করবেন এই আশায় প্রকৃতি বোধহয় ফুল ফোটায় না।
সৃষ্টির
আপন খেয়াল রয়েছে। সে খেয়াল কারোর কাছে দায়বদ্ধ নয়। যাবতীয় দায় শুধু সৃষ্টির
তাগিদের কাছে। কেবল তার অনুপম রচনার পুঙ্খানুপুঙ্খ সৌন্দর্যের দিকটাকে মাথায় রেখে
সে দিনরাত এক করে সাজিয়ে যায় আমাদের চারদিকের সুবিশাল এই প্যনোরামিক ওয়াল কে।
আপনি দেখুন
আর নাই দেখুন তার কিচ্ছু যায় আসে না। কালের গ্যালারি তে ঠিকই থেকে যায়।
পঞ্চদশ ঃ
আলতা
রঞ্জিত কুমুদ বর্ণা তরুণীর পদ শোভা সৃষ্টি করে দুধে আলতা রঙের স্নিগ্ধ ব্যঞ্জনা।শরতের প্রভাতে ফোটা স্থলপদ্মের রঙে দেখি সেই একই রক্তিম গোলাপী আভা।
শরতের জল হাওয়াতেই ফোটে, তবু ব্রাত্য শরতের হাটে। পদ্ম, শিউলি, শাপলা, কাশ এরা তো আছেই, অনন্য সুন্দর শারদীয়
মুদ্রা। তার পাশেই থাকুক না হয়, শুভ্র পাঁপড়ি, দিব্য রাগের সানন্দ প্রিয়
শুভ্রা।
ইচ্ছে হয় হৃদয়ের আঙিনায় ফুটিয়ে তুলি এই ফুল!
রোজ
প্রভাতে যার স্বর্গীয় শোভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে হৃদয়নাথের শুভ মুখ; যার অলৌকিক আনন্দ ধারায় স্নাত হবে হৃদয়
সম্রাটের অঙ্গ রাগ,
উচ্ছল বন্দনায় গীত হবে তৃপ্তির
প্রেম গান,
শিরায় শিরায় প্লাবিত হবে
উজ্জয়িনী স্রোত ধারা,
আমার এসবই দেখার বাকি, শোনার বাকি সে উচ্ছসিত রূপ ধারার সকরুন, বিনম্র উল্লাস।
অষ্টাদশ ঃ
স্ফুরিত অধরে জাগা পুলক যেন উপচিয়ে ওঠে সে
বেগুনী বর্ণে উদ্ভাসিত সুডৌল পাঁপড়ি ব্যঞ্জনায়।
কি যেন নাম
না জানা অনুভবের প্রতিবিম্ব হয়ে ফুটে থাকা এই ফুল সজ্জায আনমনেই লেগে যায় অশেষ ভালোলাগার সে
মধুর, পেলব ছোঁয়া; চুঁইয়ে পড়ে তা প্রভাতের শিশির ভেজা স্নিগ্ধতায়, প্রবাহিত হয়ে
যায় রোদেল মিহি স্রোতে, অবগাহনের যদি ইচ্ছা হয়ও এই স্ফুরিত
পাঁপড়ি জোছনায়, তো ক্ষতি কি!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন