অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগে, যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যেদিন তাঁর দুই দেহ রক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিতে হল, অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ৩১ শে অক্টোবর, সেদিন কোথায় ছিলেন তাঁর বড় ছেলে রাজীব? ইন্দিরার কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী তখন প্রয়াত। চার বছর আগে, ১৯৮০ তে এক বিমান দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। তাই রাজনীতি বিমুখ রাজীব, মায়ের অনুরোধে অনিচ্ছা সত্তেও কংগ্রেস এর যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তখন। শোনা যায় গুলির শব্দ পেয়ে ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসেছিলেন রাজীব পত্নী সোনিয়া। কিন্তু ঘটনা ঘটার সময় কি রাজীব দিল্লির প্রধানমন্ত্রী বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন না। কোথায় ছিলেন রাজীব তখন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমরা বলে নেব এক অদ্ভুত নাটকীয় পরিস্থিতির কথা। যার সাক্ষী ছিল সেদিন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তি মহকুমা শহর, কাঁথি। প্রসঙ্গত, কাঁথি শহরের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ মহকুমা প্রশাসনিক কার্যালয়ের ঠিক দক্ষিণ মুখে রয়েছে সরকারি খেলার মাঠ, অরবিন্দ স্টেডিয়াম। স্থানীয়দের কাছে খাসমহল ময়দান। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ওখানেই। ময়দানে সেদিন সভা চলছিল যুব কংগ্রেস এর। প্রধান বক্তা হিসেবে রাজীব গান্ধী তখন মঞ্চে ভাষন দিচ্ছিলেন। হঠাৎ, সেই সভাস্থলে এসে হাজির হলেন তদানীন্তন ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রনব মুখোপাধ্যায়। তাঁর চোখে মুখে স্পষ্টতই ছিল উদ্বেগের ছাপ। দূত মারফত বক্তব্যরত সেই তরুন, সুদর্শন নেতার কাছে গেল তাঁর মাতৃ বিয়োগের বার্তা। বার্তা পাওয়ার পর, মাঝ পথেই তিনি বক্তব্য থামিয়ে নেমে গেলেন মঞ্চ থেকে। এবং তৎক্ষণাৎ প্রনব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রওনা দিলেন রাজধানী দিল্লির উদ্দেশ্যে। The Telegraph এর এক রিপোর্ট অনুসারে রাজীব সেদিন কাঁথি থেকে বেরিয়ে স্থলপথে প্রথম কোলাঘাটে পৌঁছেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল কোলাঘাট থেকে হেলিকপ্টারে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোলকাতার দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছানো। রাজীবের সঙ্গে আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত সে সময়, দূরদর্শন সবার ঘরে সেভাবে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষের কাছে খবরের কাগজ বাদ দিয়ে যাবতীয় সংবাদ প্রাপ্তির এক এবং একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিয়ো। যথারীতি ৮৪ র ৩১ শে অক্টোবরও আমাদের সবার আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়েছিল আকাশবাণীর সন্ধ্যার বুলেটিনের দিকে। তখন আমার বয়স নয়। তবু বড়দের উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা আমাদের বেশ ভালোই স্পর্শ করেছিল। উৎকর্ণ হয়ে সকলে তাই রেডিয়োর খবরে কান পাতি। এবং যথারীতি সন্ধ্যার বুলেটিনে শুনতে পাই ইন্দিরার আকস্মিক প্রয়াণে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার পেলেন সেদিনকার কাঁথি ফেরৎ কংগ্রেসের যুব নেতা রাজীব গান্ধী। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত, তিনিই এই দায়িত্বভার সামলাবেন। এক বিরল ঐতিহাসিক সন্ধি ক্ষণের সাক্ষী থাকলাম আমরা। দেশের ইতিহাসে প্রথম দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী মায়ের অকাল মৃত্যুতে তাঁর ছেলের সেই পদে অভিষিক্ত হওয়ার ঘটনা। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মরমী স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রসঙ্গত, রাজীব গান্ধীরও মৃত্যুর সঙ্গে রয়েছে কাঁথির এক করুন সংযোগের কাহিনী। রাজীব নিজে কাঁথির উদ্দেশ্য লেখা এক বার্তায় বলেছিলেন, I have an emotional relationship with Contai. সেই বার্তা এসেছিল তাঁর মৃতুর দু দিন আগে। সেই রোমহর্ষক কাহিনী অন্য কোনো দিন বলার ইচ্ছে রইলো।
জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন