সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পাঁচ এর পাঁচালী!

ধরা যাক একজনের নাম রমেশ। সে প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমানা নিয়ে বেশ বড় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। একদিন সে ওদেরই এলাকার পাঁচু বাবুর কাছে দেখা করতে গেল এই নিয়ে। বিপদে আপদে এই পাঁচু বাবুই তাকে বুদ্ধি দিয়ে হেল্প করেন। "দাদা, কি করি, বটু যে কিছুতেই মানতে চাইছে না!" সব শুনে পাঁচু বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, "পাঁচ জনকে ডাক, ডেকে বস। দেখি মানে না কেমন।" পাঁচের কথা শুনতেই হবে। তবে হ্যাঁ বাংলার পাঁচের কিন্তু একটা দুর্নাম আছে। কিন্তু তাতে কি! পাঁচকে নিয়েই তো 'পঞ্চায়েত' গঠিত হয়, তারপরে সেই পঞ্চায়েতের দখল নিয়ে কম মারামারি, রক্তক্ষয় তো হয় না। পঞ্চ নদীর দেশ, পঞ্চ পান্ডব এবং তাদের একমাত্র স্ত্রী দ্রৌপদীকে এই কারণেই বলা হয় পাঞ্চালি। পাঁচের কি মহিমা দেখুন, আমাদের ইন্দ্রিয় ও তো পাঁচটি। বলতে নেই, সেই ইন্দ্রিয় পঞ্চের মায়ায় পড়েই আমাদের যত অনিষ্ট সাধন। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় ও সেই পাঞ্চ জন্য। মহাভারতে কৃষ্ণের হাতে দেখা যায় এই পাঞ্চ জন্যকে। স্কন্দ পুরানে অবশ্য পাঞ্চজন নামে এক দুরাচারী দৈত্যের কথা বলা হয়েছে। যাকে বধ করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। সেই দৈত্যের নামেই কৃষ্ণের হাতে ধরা শঙ্খের এমন নাম। সে যাই হোক সেই পাঁচ ই তো হোল। এদিকে রমেশ আবার পাঁচু বাবুর জন্য গাছের কটি ঝুনো নারকেল নিয়ে গিয়েছিল। মানুষটা খুবই ভালো। শিব চতুর্দশীর দিন জন্ম বলে, শিবের নামে নাম - পঞ্চানন। ছোট করে সবাই পাঁচু বলে। রমেশের পরিবার, সবিতা তো পাঁচ বাবুর প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। তাছাড়া বুদ্ধি দেওয়ার জন্য দক্ষিণাও তো কিছু দিতে হবে। কি মুশকিল, হাতের ব্যাগ হাতেই থেকে গেছে। মাঝ রাস্তায় এসে মনে পড়লো। "ইস্...!" "ঠিক ভুলে গেছি, এটা ওটা পাঁচ কথায়..!" এখানেও সেই পাঁচ কথা। কেউ মারা গেলে পর্যন্ত সাধ করে বলা হয় পঞ্চ ভূতে বিলীন হয়ে গেলেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে আমাদের নশ্বর দেহের সৃষ্টির মূলেও নাকি রয়েছে এই পঞ্চ ভূত ও তাদের সমষ্টি তত্ব। সর্বোপরি প্রকৃতির অপার সৃষ্টি রহস্যের সমস্ত সুলুক সন্ধান ও তো জানতে সেই পাঁচ ভূতের শরণাপন্ন হতে হয়। ক্ষিতি, তেজ, অপো, মরূৎ ও ব্যোম, অর্থাৎ মাটি, আগুন, জল, বায়ু ও আকাশ। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান না হলেও এই পাঁচ আঙুলেই নাকি এই পঞ্চ ভূত সমাহিত থাকে। যেমন- কনিষ্ঠায় জল, অনামিকায় আকাশ, মধ্যমায় পৃথ্বী, তর্জনীতে বায়ু ও বৃদ্ধাঙ্গুলে অগ্নি। বুঝুন একবার। এবারে আসি কাজের কথায়। রমেশ ফেরার সময় রাস্তার দুদিকে সব দেখতে দেখতে হাঁটছিল। কোথাও কোথাও আবার ইতিউতি ফুল ফুটে আছে। দেখে ওর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। ফুল বলতে, দেশে ঘরে যেমন হয় ওই পুকুরে পাড়ে রাঙা জবা, উঠোনে নয়নতারা। মিন্টুদের বারান্দায় আবার সাদা অপরাজিতার লতা বেয়ে গেছে সুন্দর। কিন্তু সবেরই ওই পাঁচ পাঁপড়ি। মোড়টা ঘুরেই অধিকারী দের বিষ্ণু মন্দির। বহু প্রাচীন। পঞ্চ রত্ন।

পাশের দিঘির জল থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে রমেশের ঘর্মাক্ত কপালে। মন্দিরের গা বেয়ে প্রকান্ড একটা গোলাজ ফুলের গাছ উঠে গেছে প্রায় চূড়া ছুঁই ছুঁই। সারাবছর ফুলে ভর্তি থাকে তার ডালাপালা। গাছের পাতাগুলো বেশ লম্বাটে, পুরু। হাওয়ায় একটা ফুল একেবারে রমেশের পায়ের তলায় এসে পড়ে। কি অপূর্ব রক্তিম আভা পাঁপড়ির সুডৌল সীমান্ত জুড়ে। যেন কোনো শিল্পীর করা সুন্দর কারুকাজ। রমেশ গুণে গুণে দেখে এরও সেই পাঁচটিই পাঁপড়ি। সেটাই কি ফুলটির এত গুছিয়ে সুন্দর থাকার কারণ!

রমেশ পা চালিয়ে হাঁটে বাড়ির দিকে। আসার সময় সবিতা পই পই করে বলে দিয়েছিল," মনে করে পাঁচফোড়ন নিয়ে এসো কিন্তু!" তাই তো - এখানেও সেই পাঁচ! রমেশ প্রথমেই গ্রামের মোড়লের ঘরে ঢোকে। হাতের রেখায় পাঁচ হতে আর চার দাগ গুণতে হবে তাকে। পাঁচ জনের পাঁচ কথায় ভড়কে গেলে চলবে না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...