বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের শেষ লগ্নে, তাঁর
আবির্ভাব। পরের তিন দশকে, মৃত্যুর আগে
পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যহের আঙিনায় নায়কের ন্যায় বিচরন করা এক দুরতিলঙ্ঘ্য
জ্যোতিষ্ক। জেলে (১৯৪৯ -৫০) বসে
লেখেন জীবনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস – ‘উত্তরঙ্গ’। তাঁর কথিত কমিউনিস্ট পার্টির
সদস্য হওয়া থেকে শুরু করে পার্টির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্রবই তাঁর জেল যাত্রার
প্রধান কারণ ছিল। কারণ ১৯৪৯ এ, দেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু জেলমুক্তি হলেও
ভাত কাপড়ের লড়াই থেকে মুক্তি পান না সহজে।
যদিও সে লড়াইয়ের বৃত্তকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলার পেছনে তাঁর নিজের দায়
কিছু কম ছিল না। কারণ ততদিনে বন্ধু দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ বিচ্ছিন্না দিদি গৌরী দেবীকে
ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। অথচ হাতে কোনো কাজ নেই। কারণ জেল থেকে ফিরে আসার পরে একমাত্র
সম্বল ইচ্ছাপুর অস্ত্র কারখানার চাকরিটাও চলে যায় তাঁর। তবে আর চাকরি করা নয়। এবারে একজন পূর্ণ সময়ের লেখক হিসেবেই জীবিকা নির্বাহ করবেন
বলে স্থির করলেন তিনি।
ছোটবেলায় পড়াশুনায় ভীষণ পরিশ্রমী ছিলেন বলে তেমন সুনাম নেই। বরং উল্টোটাই সত্যি। পড়ায়
ফাঁকি দিতেন বলে বাবা ছেলেকে ভিটে ছাড়া করেছিলেন। ১৪ বছর বয়সেই (১৯৩৮) জন্মস্থল ঢাকার
অদূরে মুন্সিগঞ্জের রাজনগর থেকে তাঁকে চলে আসতে হয়েছিল নৈহাটিতে, দাদার কাছে।
কিন্তু তাতেও পলায়নপর জীবনের ছবিটার কিছুমাত্র বদল হয়নি। ফিরে গেছেন ঢাকায়, বাবা ঢাকেশ্বরী
কটন মিলে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কাজ ছেড়ে আবারও ফিরে এসেছেন
নৈহাটিতে।
একমাত্র বিবাহ পরবর্তী সময়েই, তাঁর জীবনে আসে সেই মহাবোধিসম পরিবর্তন। জগদ্দলের
কাছে আতপুরের বস্তিতে ছোট্ট এক ছামরার ভাড়ার ঘরে নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে যখন থেকে
থাকতে শুরু করলেন, বুঝতে পারলেন জীবনের দায়ের কাছে তিনি কতটা অসহায়। একমাত্র কঠিন
শ্রমই পারে বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত দুবেলার দু মুঠো ভাত জোগাড় করে দিতে। আর সেই
শর্তেই কখনো বাজারে কাঁচা সব্জী নিয়ে বসেছেন তো কখনো বড়লোকদের পাড়ায়, মাথায় ঝাঁকা
বয়ে ডিম ফেরী করে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তাতেও
সপ্তাহের তিন চার দিন স্ত্রী গৌরী দেবী এবং তাঁকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে।
রূঢ় বাস্তবের এই কঠিন জমিতে দাঁড়িয়েই শ্রমের
প্রতি এক গভীর মমত্ব বোধের স্ফুরণ হতে দেখা যায় তাঁর মধ্যে। আর মূল্যবোধের এই বদলই আগামীদিনের এক শ্রম নিষ্ঠ
তারকা কলমজীবীকে জন্ম দেয় বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র খচিত আকাশে, তিনি সমরেশ বসু।
তথ্যের অপ্রতুলতা কাটিয়ে নিখুত ভাবে ফুটিয়ে তোলার নেশায় সমরেশের শরীর দিনে দিনে ভেঙ্গে পড়ছিল কিন্তু তাঁর সেদিকে খেয়াল ছিল না। এমনকি বার কয়েক সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে চিঠি লিখে তাঁর সময়মত লেখা শেষ না করতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু তথ্য সংগ্রহে কোনোরকম আপোষ করতে তিনি নারাজ। “লেখাটা কিছু over due হয়ে যাচ্ছে” বলে খেদ প্রকাশ করেছেন আবার একই সঙ্গে তিনি যে এক্ষেত্রে ‘একেবারেই নিরুপায়’ সে কথাও সম্পাদককে মনে করিয়ে দিয়েছেন চিঠিতে।
ভূমিকায় সাগরময় ঘোষ লিখছেন, “আমার উদ্বেগ হচ্ছিল ওঁর শরীর নিয়ে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। চষে ফেলছেন বাঁকুড়া, শান্তিনিকেতন”। শুধু কি বাঁকুড়া, শান্তিনিকেতন! তথ্য সংগ্রহে ছুটে গেছেন দিল্লি গোয়ালিয়র, আগরতলায়। কারণ তিনি যার জীবন নিয়ে লিখছেন তিনি একজন শিল্পী, তাই তাঁর শিল্প শৈলী বোঝা ভীষণ জরুরি। রামকিঙ্করের হঠাৎ মৃত্যু হওয়াতে, সমরেশকে যেন আরও বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। দিল্লি গিয়েছেন রামকিঙ্করের ছাত্র সমরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। কারণ দিল্লিতে যক্ষ – যক্ষীর মূর্তি তৈরি করতে গিয়ে মূর্তি নির্মাণের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত কুলু উপত্যকার পাথর কে কি ভাবে রামকিঙ্কর ছেনি বাঁটুলী দিয়ে কেটে তার শিল্পিত রূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেটা সমরেন্দ্রের কাজ দেখে বুঝে নিতে চাইছিলেন তিনি। গোয়ালিয়র গিয়ে দেখা করেছেন ধীরেন দেব বর্মার ছেলে প্রণব দেব বর্মার সঙ্গে। সমকালীন এক শিল্পী যিনি সদ্য প্রয়াত হয়েছেন তাঁর সম্পর্কে তথ্যের অপ্রতুলতা কাটিয়ে ওঠা সমরেশের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি শুধু ছাত্রদের মধ্যেই তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব সীমাবদ্ধ না রেখে দেখা করেছেন রামকিঙ্করের একদা সতীর্থদের সঙ্গে ও। দিল্লিতে গিয়ে কথা বলেছেন বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ চৌধুরী ও বনবিহারী ঘোষেদের সঙ্গে।
আগরতলায় গিয়ে কথা বলেছেন শিল্পী বিপুলকান্তি সাহার সঙ্গে। দেখা করেছেন রামকিঙ্করের দ্বিতীয় স্ত্রী রাধারানীর সঙ্গে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। উদ্বিগ্ন সাগরময় ঘোষ বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সমরেশকে। কিন্তু তিনি “অবিশ্রান্ত এবং একই সঙ্গে অতৃপ্ত ও”! লিখেছেন সাগরময় ঘোষ। এত পরিশ্রমের পরেও সাগরময় ঘোষ কে চিঠি লিখে সমরেশ জানাচ্ছেন, “রামকিঙ্কর – যে ভাবে এগিয়ে যেতে পারা উচিত, পারছি না। কেবলই মনে একটা দ্বন্দ কাজ করছে – আমি সব খুঁটিনাটি বিষয় এখনও আয়ত্ত করতে পারি নি”। প্রকৃতই এক শ্রম নিষ্ঠ কলমজীবীর আত্মছলনাহীন বয়ান শুনতে পাই এই কথার মধ্যে।
তথ্য সূত্র ঃ
কালকূট ও বাংলা সাহিত্য, শ্রীতম মজুমদার।
ইতিহাস এষণা, সৌমিত্র শ্রীমানী
‘দেখি নাই ফিরে’ ১৯৯২, প্রথম সংস্করণ। (আনন্দ
পাবলিশার্স)
সমরেশ বসুর সম্পর্কে আরও লেখা পড়ুনঃ
বিজ্ঞাপন লেখকের সংশয় সত্যি হোল সমরেশের জীবনে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন