সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাসকট আসছে কোলকাতা বইমেলায়!

এমনিতে বইমেলায় বিক্রিবাটা কম হয় না। গত বছর, ২০২৪ এই প্রায় ২৩ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য হলেও লক্ষ্মী জোটেনি এতদিন বইমেলার কপালে । কথাটা খানিক উদ্ভট শোনালেও একেবারেই মিথ্যে নয়। সেই হিসেবে লক্ষ্মী ছাড়াই ৪৭ টা বইমেলা অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে  কথায় আছে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী।
তাই অবশেষে, ৪৮ তম বছরে এসে কোলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা তার লক্ষ্মীকে পেতে চলেছে, তবে  হিন্দুদের ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী কে নয়; সৌভাগ্য আনয়নের প্রতীক হিসেবে, যাকে পরিভাষায় মাসকট বলা হয়ে থাকে।


কোলকাতা বইমেলার মাসকট উন্মোচিত হোল!
অভিধান খুলে মাসকট শব্দের কোনো এক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ পেলাম না। যা পেলাম তা হোল – মাসকট হোল কোনো ব্যক্তি অথবা কোনো প্রানী বা কোনো বস্তু যাকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। 
ইংরেজি অভিধানে মাসকট শব্দটি  বেশিদিন হোল আসে নি। মাত্র দেড়শো বছর আগে, ১৮৮১ সালে এর প্রবেশ সূচিত হয়েছে।   শব্দটি আসলে একটি ফরাসি শব্দ। প্রথম শোনা যায় ১৮৬৭ সালে। তার আগে ফ্রান্সে এই শব্দটি জুয়ার আসরে একটি অপশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হত। প্রথম জাতে ওঠে এডমণ্ড অড্রন নামে এক ফরাসি গীতিনাট্যকারের হাত ধরে।  তিনি ‘লা মাসকট’ নামে একটি অপেরা রচনা করেন যা ১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এই অপেরায় দেখা যায় একজন ইটালিয়ান চাষির জীবনে কিভাবে এক কুমারী মেয়ে সৌভাগ্যের জোয়ার বয়ে আনে। মেয়েটি যতদিন কুমারী থাকে ততদিন চাষিটির জীবনে কোনো কষ্টই থাকে না। অপেরাটিতে ওই মেয়েটিই ছিল  চাষির কাছে মাসকট বা পয়া। যাকে গোদা বাংলায়  লক্ষ্মী বলা যেতে পারে। ক্রীড়া ক্ষেত্রেই প্রথম এই মাসকট ব্যবহারের প্রচলন দেখা যায়। ১৯০৮ এ আমেরিকার শিকাগোয় জীবন্ত পশু শাবককে মাসকট হিসেবে ব্যবহারের কথা জানা যায়। যদিও তারও আগে ১৮৮৬ তে নিউ ইয়র্ক টাইমস এ লেখা হয় লিটল নিক নামে একজনের কথা যে নাকি বোস্টন ব্রাউন বেসবল টিমের কাছে শুধু নয় পুরো দেশের কাছেই পয়া হয়ে উঠেছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস ছোট্ট নিককে বোস্টন ব্রাউন টিমের মাসকট বলে অভিহিত করেছিল। মাসকট সংস্কৃতি কালে কালে তার গুরুত্ব বাড়িয়েছে।  ক্রীড়া ক্ষেত্র থেকে তা এখন বিভিন্ন বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা শুধু নয় ছোট বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি জাপানের পুরসভা ও আমেরিকার নাসা’র মতন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও মাসকট ব্যবহার কে প্রায় অপরিহার্য করে ফেলেছে। যার ছোঁয়াচ শেষ পর্যন্ত এসে লাগলো কোলকাতা বই মেলার পরিচালক গোষ্ঠী পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের গায়েও। 

সম্প্রতি গিল্ডের প্রেসিডেন্ট ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে উন্মোচিত হতে দেখা গেল  কোলকাতা বই মেলার প্রথম মাসকটের  ছবি।
এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো বর্তমানে মাসকট ব্যবহারের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সংস্থার সৌভাগ্য আনয়ন বা প্রতিষ্ঠানের সমর্থক – পৃষ্ঠপোষকদের মনোরঞ্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।  মাসকট ব্যবহারের এখন প্রধানতম উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে বিপণন বা সোজা বাংলায় মার্কেটিং।
১৬ই ডিসেম্বর, শহরের একটি হোটেলে হয়ে যাওয়া মাসকট উন্মোচনের অনুষ্ঠানে  সেকথার উল্লেখ শোনা গেল গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের মুখে।  বইমেলার দিনগুলোতে, প্রাঙ্গণের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাবে এই মাসকট গুলিকে। বেশ কয়েকটি, এইরকম মাসকট জোন থাকবে বইমেলায়। এছাড়াও মাসকটের ছবি আঁকা চিনে মাটির বিভিন্ন সামাগ্রী বিশেষ করে চায়ের কাপ এবং টি শার্ট – এবারের বইমেলা বিপণনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে চলেছে বলে খবরে প্রকাশ।    প্রসঙ্গত এ বছর বইমেলা শুরু হচ্ছে জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ থেকে; চলবে ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ পর্যন্ত। শেষ কয়েকবছরের মত, এবারেও  (সল্টলেক, করুণাময়ী অঞ্চল) সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ার বৃহত্তম বইমেলার শিরোপা পাওয়া আমাদের সকলের প্রিয় কোলকাতা বইমেলা।কিন্তু কি আছে মাসকটের ছবিতে? এইখানে একটা টুইস্ট আছে।
কারণ, মাসকটের কথিত সৌভাগ্য তথা ভাগ্যলক্ষ্মী আনয়নের শুভেচ্ছা বার্তা  জানাতে কিন্তু লক্ষ্মী কে নয় জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁসের ওপরেই ভরসা রেখেছেন বইমেলার আয়োজক সংস্থা গিল্ড। মাসকট হিসেবে ছবিতে দেখা যাবে গোল ফ্রেমের চশমা পরিহিত দুটো হাঁসকে। তাদের মধ্যে একটি ধুতি ও তার ওপরে নীল কোট পরে আর অন্যটি শাড়ি পরে আছে। হাতে বই ধরে তাদেরকে পাঠরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে ছবিতে।
গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বললেন বইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দেবী সরস্বতীর ইমেজ।  তাই মাসকট হিসেবে দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁসকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।   
প্রসঙ্গত বলে নেই মাসকট শব্দটার সঙ্গে পূর্ব পরিচিতি থাকলেও তা নিতান্তই ছিল মুখে দেখা পর্যায়ের।  কোলকাতা বইমেলা এই প্রথম তাদের মাসকট লঞ্চ করছে খবরটা কাগজে পড়ার পরেই এই ব্যাপারে খতিয়ে জানার চেষ্টা করি। কিন্তু একটা বিষয়ে বিশেষ করে কোনো একই সংস্থার মাসকট আর তার লোগোর মধ্যে  উদ্দেশ্যগত কোনো তফাৎ আছে কি না এই নিয়ে ধন্দ যেন কিছুতেই কাটতে চাইছিল না।   কোলকাতা বইমেলার তো এমনিতে একটা লোগো রয়েছে। বহু পরিচিত। বইমেলার কথা উঠলেই সেই খোলা বইয়ের পৃষ্ঠদেশ সম্বলিত স্কেচ এবং একটা বিশেষ হরফে লেখা কোলকাতা বই মেলা কথাটি যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের সামনে। সোজা কথায় লোগো হোল একটি সংস্থার পরিচিতি ছাপ। অনেকটা সামনে বসে থাকা রিসেপশনিষ্টদের মত; সেক্ষেত্রে মাসকট হোল কোম্পানির রিলেশন ম্যানেজার।  মাসকট তার সাংস্কৃতিক আবেগ দিয়ে সংস্থার গ্রাহক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করে।  এইভাবেই হয়তো মাসকট, সংস্থার সৌভাগ্য আনয়নে তার ভূমিকাকে সুনিশ্চিত করে। লোগোর কিন্তু সে অর্থে বিপণনের কোনো দায় নেই যতটা দায় প্রাথমিক পরিচিতি দানের ক্ষেত্রে রয়েছে।
যাই হোক,  বইমেলার মাসকট প্রাপ্তি তার লক্ষ্মী প্রাপ্তিতে কতটা সাহায্য করবে তা জানা যাবে আগামী সময়েই। তবে যেতে যেতে আরও একটা বিষয়ে মনে করিয়ে দিই এবারের বইমেলার ফোকাল থিম দেশ কিন্তু জার্মানি। ১৯৭৬ থেকে এই প্রথম। যদিও কোলকাতা বইমেলার আয়োজনই হয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা দেখে। যাই হোক সে অন্য গল্প। অন্যদিন হবে ক্ষণ। 



 

তথ্য ঋণ – Mascots by Jeff Marzick
Times of India
ও আনন্দবাজার পত্রিকার দৈনিক খবরের কাগজ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...