সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজ্ঞাপন লেখকের সংশয় সত্যি হোল, সমরেশের জীবনে!

 দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল অবশেষে ‘দেশ’ এর পাতায় ফুটে উঠল ‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলার একদিন’ হয়ে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম জীবনীমূলক উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ র প্রথম কিস্তি এই উপশিরোনামেই পৌঁছল পাঠকের দরবারে। শিল্পী রামকিঙ্কর বেজের সাথে কবি গুরুর প্রথম সাক্ষাতের গল্প দিয়ে শুরু হোল সমরেশ বসু  রচিত ধ্রুব উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। এখানে ধ্রুপদী’র পরিবর্তে ধ্রুব শব্দটি ব্যবহারের কারণ হিসেবে কিছু কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদী অর্থাৎ ক্লাসিক উপন্যাস অনেক লেখা হয়েছে এবং আগামী দিনে আরো লেখা হবে। কিন্তু ‘ধ্রুব’ অর্থাৎ এক এবং একমাত্র উপন্যাস হিসেবে ‘দেখি নাই ফিরে’ কে প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন আর কেউ নন, বাংলা সাহিত্য পত্রিকার সর্বকালের অন্যতম সেরা সম্পাদক,  সাগরময় ঘোষ।

প্রায় দুশোর মতো ছোট গল্প এবং একশোর কাছাকাছি উপন্যাস লেখার সফল কারিগর সমরেশ বসু নিজেও যেন সর্বস্ব পণ করেছিলেন এই উপন্যাস লিখতে। যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাক্ষী ছিলেন, সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। 
১৯৮৭ সালের ৩রা জানুয়ারী, ‘দেশ’ এর সাপ্তাহিক সংখ্যায় ‘দেখি নাই ফিরে’র প্রথম পর্ব বেরোতেই সাড়া পড়ে যায়।
উনিশ বছর বয়সী রামকিঙ্করের সঙ্গে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনের অংশটি যেন পাঠকের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে থেকে যায় চির কালের মতো। প্রথম পর্বেই সমরেশ বিধৃত করেন এই মহাকাব্যিক দ্যোতনায় ভরা দ্বৈত সংলাপ খানি। যেখানে রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে বলছেন, “শোন, কাছে আয়। তুই, তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে।" “একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি – সামনে।" সমরেশ লিখছেন, গুরুদেবের এই প্রত্যাদেশমূলক উক্তিটি স্মরণ করে রামকিঙ্কর বললেন, “হ্যাঁ, আমিও আর ফিরে দেখি নাই।" রামকিঙ্করের এই কথাটি সমরেশের মনে ধরেছিল। তিনি উপন্যাসটির নামকরণ করার প্রশ্নে রামকিঙ্করের সেই অমোঘ প্রত্যুত্তর - ‘আমিও আর ফিরে দেখি নাই’ কেই  শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছিলেন।  সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে তা প্রকাশও করেছিলেন অকপটে।  বলাই বাহুল্য, উপন্যাস বেরনোর পরে বোঝা যায় তিনি তাঁর ভাবনা বদলাননি। আগেই বলেছি সমরেশ তাঁর উপন্যাসের প্রথম কিস্তিতেই কিস্তিমাৎ করেছিলেন। পাঠক সমাজে উঠেছিল সুগভীর আলোড়ন।  সম্পাদকের টেবিল ভরে যাচ্ছিল অভিনন্দন এবং প্রশংসার আতিশয্যে ভরা চিঠি চাপাটিতে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখায় ফুটে ওঠে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কথাও। ১৯৯২ সালের ১লা জানুয়ারি, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কথাশিল্পী সমরেশ বসুর অনন্য আলোকপাতে রূপকথা হয়ে যাওয়া শিল্পী রামকিঙ্করের বিচিত্র জীবনচর্যা সম্বলিত অনবদ্য উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। বইটির ভুমিকায় সাগরময় ঘোষ লিখছেন সেই অভিনন্দিত অমৃত পানের মধ্যে বিষময় তিক্ততার কথা। “একদিকে যেমন উচ্ছ্বাস, অভিনন্দনপত্র, অপরদিকে কিছু উড়োচিঠিও আসতে লাগলো এ লেখা বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে। থাকতো লেখকের প্রাণনাশের হুমকিও।" "যদিও হত্যা বা মৃত্যু কে ভয় পাবার মতো লেখক সমরেশ ছিল না” - সমরেশের স্থিত প্রজ্ঞায় অগাধ আস্থাশীল সাগরময় ঘোষ অকপটে লিখে গেছেন সে কথা।  কিন্তু সেই সমরেশই কেন মৃত্যুর কথা শুনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন।
সেই কথা লিখতেই এই নিবন্ধের অবতারনা। ১৯৮৭ এর ৩রা জানুয়ারি উপন্যাসের প্রথম কিস্তি বেরনোর ১০ দিন পরে অর্থাৎ ১৩ ই জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় দীর্ঘ একটি বিজ্ঞাপনী আলেখ্যে লেখা হয় উপন্যাসটি নিয়ে। সেই লেখার শুরুতেই যে কথা লেখা হয় তাতেই তৈরি হয় মহা সংকট। “সাহিত্যিক সমরেশ বসুর এটি শেষ কীর্তি কিনা তা বলা না গেলেও বলা যায় এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।"
সমরেশ বসুর গোচরে এলে তিনি এতটাই দুঃখ পান  যে সপাট পত্র লেখেন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ কে। সেই পত্র টি এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

শ্রদ্ধাস্পদেষ ু
সাগরদা,
বাংলাদেশ থেকে সময়মত ফিরতে পারিনি বলে শান্তিনিকেতনে যেতে পারলুম না। ১০ ই জানুয়ারি অনুষ্ঠান দেখা থেকে বঞ্চিত হলুম। গতকাল রাতে সুনীলের মুখে শুনলুম, আপনি আজ কলকাতায় ফিরবেন।

আজ  আনন্দবাজারে ‘দেখি নাই ফিরে’ র যে বিজ্ঞাপন টি বেরিয়েছে তার প্রথম লাইনটি পড়ে আমি বিস্মিত এবং মর্মাহত হয়েছি। এটি ই আমার শেষ লেখা (কীর্তি) কিনা , এ কথা লেখার মানে কি? বিজ্ঞাপন লেখক কি আমার কোষ্ঠী দেখে মৃত্যু দিন অথবা আর কোনো দিন লিখতে পারবো না,  একথা ভবিষ্যৎ বাণী করতে চেয়েছেন? অত্যন্ত আপত্তিকর। দুঃখও পেয়েছি। আপনাকে আমার মনের কথা না লিখে পারলুম না। যদি অন্যায় হয়ে থাকে ক্ষমা করবেন।
সশ্রদ্ধ প্রণাম সহ,
সমরেশ

যদিও এই চিঠি পাওয়ার পরে, আনন্দবাজার তাদের ১৮ ই জানুয়ারির পাতায় পুনরায় একটা বিজ্ঞাপন বার করে। পূর্বের লেখার সংশোধন করে তাতে লেখা হয়, “সাহিত্যিক সমরেশ বসুর দীর্ঘ গবেষণার ফলশ্রুতি এই উপন্যাস যেমন অনন্য তেমনি হয়তো তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।"

কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, কে জানতো যে বিজ্ঞাপন লেখকের সেদিনকার করা সেই ভুল ব্যাখ্যাই একদিন নিষ্ঠুর সত্যে পরিনত হবে সমরেশের জীবনে! সত্যি সত্যিই তো উপন্যাসটি শেষই করে যেতে পারলেন না সমরেশ বসু। তার আগেই এমনই এক বসন্তের দিনে, চির বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী সাহিত্যিক সমরেশ বসু।  ১৯৮৮ সালের ১২ ই মার্চ ছিল লেখকের চলে যাওয়ার সেই দিন।
থমকে গেল উপন্যাসের ৬৫ তম পরিচ্ছেদের প্রকাশ।  অসমাপ্ত থেকে গেল 'দেখি নাই ফিরে'।

সমরেশ বসুর সম্পর্কে আরও লেখা পড়ুন ঃ 
নিদারুন সমাপতন, সমরেশ বসু এবং রামকিঙ্করের মৃত্যুতেও! 
                    

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...