ইতিমধ্যে ১৯০২ এর ৪ ঠা জুলাই স্বামীজীর অকাল প্রয়ান হলে রবীন্দ্রনাথ ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বন স্কুলে আয়োজিত
শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন বটে তবে সভাপতির ভাষণের
কোনো প্রামানিক রেকর্ড রাখার কথা সেসময় কেউই সেভাবে বিবেচনা করেন নি। প্রসঙ্গত এই
সভায় রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি মনোনীত করার পেছনেও ভগিনী নিবেদিতার প্রধান ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। কোলকাতায় আসার পর, ভগিনী
নিবেদিতার সঙ্গে যতজন গুণী মানুষের সখ্যতা গড়ে ওঠে তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞানী জগদীশ
চন্দ্র বসু এবং সাহিত্য জগতের রবীন্দ্রনাথের নাম অন্যতম। আগামী দিনে রবীন্দ্রনাথ
যে বাংলার সাহিত্য সৃষ্টির জগতে প্রতিনিধিত্ব করার মত জায়গায় থাকবেন এই ব্যাপারে মোটের
ওপরে নিশ্চিতই ছিলেন নিবেদিতা। এবং এই সূত্রে, বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে
যোগসাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা অন্তর থেকে উপলব্ধি করতেন নিবেদিতা। তবে এই বিষয়ে
আলোকপাত করা আজকের প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।
মূলত রবীন্দ্রনাথ স্বামীজী কে কি চোখে দেখতেন সেই নিয়েই আমার এ পর্যায়ের খোঁজ
সীমাবদ্ধ থাকবে। ভালো করে দেখলে, রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ এই দুই সমসাময়িক
গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মধ্যে সম্পর্কের স্রোত কখনোই দ্বিমুখী ছিল না। কারণ মাত্র ৩৯
বছর বয়সে গত হয়ে যাওয়ার পরে বিবেকানন্দের
দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিচারের সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। যদিও রবীন্দ্রনাথের
লেখা গানের ভীষণ বড় ভক্ত ছিলেন বিবেকানন্দ কারণ ১৮৮৭’র আগস্ট মাসে তখনও
নরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বামীজী হননি, বৈষ্ণবচরণ বসাকের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় ‘সঙ্গীতকল্পতরু’
নামে একটি গানের বই সম্পাদনা করেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা ১০ টি গান সেই সংকলনে স্থান
পায়। যে গানগুলি ঠাকুর রামকৃষ্ণকে প্রায়ই গেয়ে শোনাতেন বিবেকানন্দ। যেমন – ‘গগনের থালে রবি-চন্দ্র-দীপক জ্বলে’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, কিংবা
‘মহাসিংহাসনে
বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’ প্রমুখ।
এছাড়া বিবেকানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রায় নিশ্চুপই ছিলেন। এই
দুই মহারথীর মধ্যে একবারই সম্পর্কের দ্বিমুখ খুলে যায়। সেটা বিবেকানন্দের মৃত্যুর
কিছু সময়ের আগে। বিংশ শতব্দীর শুরুর দিক তখন, বাংলার শিল্প সংস্কৃতিতে নবজাগরণের
নতুন ঢেউ এসে পড়ার মুখে। সেই রকম এক সন্ধিক্ষণে, ভারতকে জানার উদ্দেশ্য নিয়ে কোলকাতায়
এলেন ওকাকুরা কাকুজোও নামের এক জাপানী শিল্প সমালোচক। তখন কলকাতাই ভারতের
প্রশাসনিক রাজধানী। ১০ মাসের তাঁর কোলকাতা স্থিতি কালে তিনি প্রথমেই দেখা করেন
স্বামীজীর সঙ্গে, উল্লেখ্য স্বামীজী সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে তাঁর কথিত
নীরবতা ভেঙে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার কথা বলেছিলেন। কি বলেছিলেন স্বামীজী
তাঁকে? “এখানে আমার
সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। আপনি রবীন্দ্রনাথের কাছে
যান। তিনি এখনও জীবনের মধ্যে আছেন”।
স্বামীজীর কথা মতো ওকাকুরা দেখা করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তারপরে বিবেকানন্দের
সম্পর্কে কি বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য এ ক্ষেত্রে। “If you want to know India, study
Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative”.
সেই শুরু। তারপরে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথকে
দেখা গেছে বিবেকানন্দ সম্পর্কে মুখর হতে। কখনো প্রবন্ধে, কখনো বক্তৃতায় কখনো বা
নিকটজনকে লেখা পত্রে তিনি বারবার
বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে সরব হয়েছেন।
‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ (বঙ্গদর্শন, ১৩১৫ ভাদ্র
সংখ্যা) নামের আর একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ
মনীষীদের মধ্যে একজন বলে উল্লেখ করতে পিছপা হন না। রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে
বিবেকানন্দকে চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায়ের সঙ্গে তুলনা করেন।
কখনো সরলাবালা সরকারকে লেখা পত্রে (১৯২৮, ৯ই এপ্রিল) বিবেকানন্দের ভারতীয় তরুন
সমাজের মধ্যে বিপুল ইতিবাচক প্রভাবের কথা স্মরন করে আপ্লুত শব্দ বর্ষণ করেন তো কখনো
ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে (১৯৩০, ১৫ই জানুয়ারি) লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ
প্রতিষ্ঠিত বেলুড়মঠের কথা তুলে শ্রদ্ধাপ্লুত হয়ে পড়েন। ‘বেলুড়মঠে শুনেছি, বিবেকানন্দের ছবির সামনে রোজ অম্বুরি তামাকের ভোগ দেওয়া হয়।’
কলম ধরেছেন স্বামীজী প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’
পত্রিকাতেও। স্বামী অশোকানন্দকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বানী
সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে লেখেন – বিবেকানন্দের বানী সম্পূর্ণ মানুষের উদ্বোধন
বলেই কর্মের ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে মুক্তির বিচিত্র পথ দেখায়।
কিন্তু এসবের পরেও বিবেকানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অস্বচ্ছতা
কাটে না। হয়তো বিবেকানন্দের আয়ু আরও একটু দীর্ঘায়িত হলে এই দুই মহান মনীষী একে
অপরকে সরজমিনে পরখ করে দেখার নিরিখে এই দুর্বোধ্য ধোঁয়াশা কেটে যাওয়ার একটা
সম্ভাবনা তৈরি হতে পারতো।
তথ্য সূত্র -
প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য র
রবীন্দ্র পত্র সমগ্র: কালানুক্রমিক, বিজন ঘোষাল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন