যাই হোক, ২৬ তারিখে যেদিন ঘটনা জানাজানি হোল, পূর্ব পরিকল্পনা মতো সুভাষের মেজদা বাড়িতে
ছিলেন না। রিষড়ার বাগান বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, সপ্তাহন্তের ছুটি কাটানোর নাম করে। দিনটি
ছিল রবিবার। প্রসঙ্গত শিশির কুমার বসুও
সেদিন তাঁর বাবার সঙ্গে রিষড়ার বাগানবাড়িতেই ছিলেন। যথারীতি জানাজানি হওয়ার পরে, রিষড়ায়
খবরটি এসে পৌঁছতে প্রায় বেলা দু টা বেজে যায়। খবর নিয়ে আসে, শিশির কুমার বসুর অন্য
দুই খুড়তুতো ভাই অরবিন্দ এবং গণেশ। এসেই বলতে শুরু করে, “ভয়ঙ্কর খবর;
রাঙাকাকাবাবুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না”। বলাই বাহুল্য, খবর পাওয়ার পরেই মেজদা শরৎ বসু চলে আসেন এলগিন রোডের বাড়িতে। আত্মীয়
স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই এসে পৌঁছায় একে একে। এসে পৌঁছায়, খবরের গন্ধ পাওয়া কিছু সাংবাদিকেরাও। এদের মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকার সুরেশ চন্দ্র
মজুমদার, নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র ও এ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নৃপেন ঘোষরা ছিলেন অন্যতম।
যদিও সুভাষের গৃহত্যাগের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক
ভাবে জানানো হয় আরও একটু পরে। পাকাপাকি ভাবে এই নিয়ে কথা বলতে, সেইদিনই সন্ধ্যায়
শরৎ বসু তাঁর ১ নং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ডেকে নেন দুজন সাংবাদিককে। একজন
আনন্দবাজারের সুরেশ চন্দ্র মজুমদার এবং অন্য জন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের। স্বভাবতই
খবর কাগজে সুভাষের গৃহত্যাগ সংক্রান্ত খবরটি ছেপে বেরোয় ২৭ শে জানুয়ারীর সকালে।
উল্লেখ্য আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ব্যতীত
অন্য কোনো পত্রিকায় কিন্তু এই খবরটি প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি নেতাজী ভবন মেট্রো
স্টেশনের দেওয়ালে এই দুটি পত্রিকার পেপার কাটিং দেখতে পেয়ে যারপরনাই অবাক হয়ে যাই
আমি। কারণ খবরটি প্রকাশিত হওয়ার দিন ছিল মহানিষ্ক্রমণের দশ দিন পরে অর্থাৎ ২৭ শে
জানুয়ারীর ভোরে। খবরে কি লেখা হয়েছিল সেটা
বলার আগে জেনে নেবো সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে পুলিশের কানে খবরটি এসে পৌঁছানোর
আগে বাড়ির লোকেরা ঠিক কি কি ভাবে সুভাষকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল। এই প্রসঙ্গে বলে
নেই, সুভাষ কোথায় চলে যেতে পারে এই প্রশ্নে বাড়ির বেশিরভাগ লোকেরই মত ছিল কোনো
মন্দির অথবা তীর্থস্থান গুলোতে থাকতে পারে সুভাষ। সেই মতো দল বেঁধে কেউ গেছে
কালীঘাট মন্দিরে তো কেউ কেওড়াতলা মহা শ্মশানে। কয়েকজন তো বেশ জোরের সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন
- কোথাও না পাওয়া গেলে হাজারীবাগের ছিন্নমস্তার মন্দিরে ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে
সুভাষকে। অনেকে আবার “উত্তর ভারতের তীর্থস্থানগুলোতে খোঁজ করা হোক” বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।
এর মধ্যে, বেশ কয়েকটি জায়গায় টেলিগ্রামও পাঠিয়ে রাখছিলেন শরৎ বসু; বেশির ভাগই কোনো
না কোনো মঠ বা আশ্রমে। তার মধ্যে কোনটা গেল পন্ডিচেরীতে, কোনটা আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে। বলাই
বাহুল্য, শরৎ বসু এই সব করে যাচ্ছিলেন যাতে কেউ না ধরতে পারে যে সুভাষের
গৃহত্যাগের খবরটি তাদের কাছে আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু যিনি ঘুণাক্ষরেও কিছু
জানতেন না এই ব্যাপারে সেই প্রভাবতী দেবী অর্থাৎ সুভাষের মা যখন জানলেন সুভাষের
গৃহত্যাগের খবর তখন তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? শিশির কুমার বসু তাঁর লেখা ‘বসু
বাড়ি’ তে লিখছেন, “ মাজননীর (প্রভাবতী দেবী) মনের কথা ঠিক কখনো ধরতে পারিনি। তাঁর
চিন্তার শেষ ছিল না, কিন্তু তিনি স্থির ও অবিচল ছিলেন”। প্রসঙ্গত, পুলিশও এ
ব্যাপারে প্রথম থেকেই অন্ধকারে ছিল। পুলিশের টনক নড়েছিল ২৭ শে জানুয়ারীর বিকেলে, অর্থাৎ
ভোরে খবর কাগজের পাতায় সুভাষের গৃহত্যাগের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পুরো এক বেলা পরে। এই
প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, সর্ব সমক্ষে এই খবর চলে আসার পরে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তর
ব্রিটিশ প্রশাসনের অন্য নানা দপ্তরেরও ঘুম ছুটে গিয়েছিল। ২৭ তারিখের সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া
রেডিওর স্পেশাল বুলেটিনে সুভাষের ঝরিয়ার কাছে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর প্রচার করে খানিকটা
বাহাদুরি নেওয়ারও চেষ্টা করেছিল তখনকার উদভ্রান্ত প্রশাসন। যদিও খবরটি সত্য ছিল না বলে
পরে তুলে নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, সুভাষের গ্রেপ্তারী সংক্রান্ত খবরটির যে পুরো দস্তুর
একটি মিথ্যে রটনা ছিল সেটি সুভাষের মা কে অবগত করানোর দায়িত্ব পড়েছিল শিশির বসুর
ওপরেই। ‘বসু বাড়ি’ তে শিশির বসু লিখছেন, “মাজননী শুনলেন, কিন্তু বিশেষ কিছু মন্তব্য
করলেন ন”। এখানেও সেই হিরন্ময় নীরবতা, কোনোভাবে
নিজের মানসিক উদ্বেগকে প্রকাশ্যে আসতে না দেওয়ারই প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় প্রভাবতী
দেবীর মধ্যে।
বলাই বাহুল্য, সুভাষের মহানিষ্ক্রমণের পরের দশ দিন অর্থাৎ ১৬ই জানুয়ারীর রাত থেকে
২৫ শে জানুয়ারী পর্যন্ত সে অর্থে ঘরে বাইরে কারোর মনেই সুভাষকে নিয়ে কোনো হেলদোল
ছিল না। ২৬ তারিখে প্রথম বাড়ির লোক এবং আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবেরা জানতে পারেন
যে সুভাষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আসল বিস্ফোরণটি ঘটে ২৭ শে জানুয়ারীর
ভোরে, সংবাদ পত্রের পাতায় সুভাষের গৃহত্যাগের খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরে। ভিত কেঁপে
যায় প্রশাসনের। কি লিখেছিল সেদিন খবর কাগজে?
আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল, “গত রবিবার অপরাহ্ন হইতে শ্রীযুত সুভাষচন্দ্র বসুকে তাঁহার বাসভবনে আর দেখিতে
না পাওয়ায় তাঁহার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনবর্গের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার হইয়াছে। সকলেই ইহা অবগত আছেন যে তিনি
অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছিলেন। গত কয়েকদিন যাবত তিনি সম্পূর্ণ মৌনাবলম্বন করেন এবং সকলের
সহিত এমনকি আত্মীয়স্বজনের সহিত ও দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করিয়া ধর্মচর্চায় সময় অতিবাহিত করিতেছিলেন। তাঁহার স্বাস্থ্যের বর্তমান
অবস্থা বিবেচনা করিয়া উদ্বেগের মাত্রা অধিকতর বৃদ্ধি পাইয়াছে। বিভিন্ন স্থান অনুসন্ধান করিয়া
কোনো ফল হয় নাই। সংবাদ ছাপিতে দেওয়ার সময় পর্যন্ত গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন
নাই বলিয়া জানা গেছে”।
আগেই বলেছি, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান
স্ট্যান্ডার্ডেই কেবলমাত্র এই খবর বেরিয়েছিল। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে হেডিং হয়েছিল
- What Has happened to Subhas Ch. Bose? Unexpected exit from Home. বাকি খবরের বয়ান কম বেশী আনন্দবাজার পত্রিকার মতনই
ছিল। আসলে খবরের খসড়াটিও লেখা হয়েছিল শরৎ বসুর ১ নং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। ‘বসু বাড়ি’ তে শিশির কুমার বসু পরিষ্কার লিখেছেন
সে কথা। “সকলে চলে যাবার পর বাবা সুরেশবাবুকে (সুরেশ চন্দ্র মজুমদার) সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসলেন। খবরের কাগজে পরের দিন সকালে কী লেখা হবে তার আলোচনা করলেন এবং আমার বিশ্বাস একটি খসড়াও তৈরি করলেন। আনন্দবাজার অফিসে একটা টেলিফোন করার পর সুরেশবাবু চলে গেলেন”।
এর প্রায় দু মাস পরে, ১৯৪১
এর ৩১ শে মার্চ উডবার্ন পার্কের বাড়িতে দুজন অবাঙালি মানুষ এলেন সুভাষের সংবাদ
নিয়ে। কিন্তু সে অন্য গল্প।
মহানিষ্ক্রমণের প্রথম পর্ব পড়ুন নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে!
মহানিষ্ক্রমণের পরেঃ ১৬ থেকে ২৬শে জানুয়ারী!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন