সুভাষচন্দ্র বসুর
মহা মহানিষ্ক্রমণ ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিরল অতিজাগতিক ঘটনা। মহানিষ্ক্রমণের পরে নয় নয় করে পেরিয়ে গেছে আট দশকেরও বেশী সময়।
কিন্তু মহানিষ্ক্রমণের রোমাঞ্চ, আজও ভারতীয় মননে এক অভিযান
সংকুল বীরত্বের অনুভব বয়ে আনে। যদিও ১৯৪১ সালের ১৬ ই জানুয়ারীর রাত্রে
ঘটে যাওয়া সেই রোমহর্ষক অন্তর্ধানের ঘটনা কিন্তু পাঁচ কান হতে বেশ সময় লেগেছিল। ইতিহাসবিদ তথা নেতাজীর ভ্রাতুষ্পুত্র
শিশির বসুর ছেলে সুগত বসু তাঁর এক লেখায় লিখছেন - প্রায় ১৪ জন ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট এলগিন রোডের বাড়িটা ঘিরে রেখেছিল। তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছিল, সুভাষ ডিনারে কীসের স্যুপ খেলেন। কিন্তু আসল পরিকল্পনার কথা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
শুধু পরিকল্পনাই নয়, সুভাষ যে দোতলার ঘর থেকে বেরোলেন
এবং তারপরে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওয়ান্ডারার গাড়িতে চেপে সন্তপর্ণে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তার কোনো
কিছুই জানতে পারলো না। তখন প্রায় রাত ১ টা
৩৫, পূর্ব পরিকল্পনা মতো সুভাষচন্দ্র তাঁর ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ব্রিটিশ লাইফ ইন্সিউরেন্স
কোম্পানির ট্রাভেলিং ইন্সপেক্টর মোহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে; তাঁর পরনে ছিল বাদামী লম্বা কোট, মাথায় কালো ফেজ-টাইপ টুপি এবং চওড়া পায়জামা। উল্লেখ্য এই পোশাক কেনা হয়েছিল মহানিষ্ক্রমণের প্রায় তিন সপ্তাহ আগে, মধ্য কোলকাতার
(ধর্মতলা স্ট্রিট) ওয়াচেল মোল্লার দোকান থেকে। সুভাষের মেজদা শরৎ বসুর ছেলে
শিশির বসু গিয়েছিলেন এই পোশাক কিনতে; তাঁর সঙ্গে ছিলেন পেশোয়ার থেকে আসা নেতাজীর
সহযোগী মিয়াঁ আকবর শাহ। পরে নেতাজী পেশোয়ার পৌঁছলে আকবর শাহ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
উল্লেখ্য ১৯৪০ এর জুলাই মাসে সুভাষ শেষ বারের মত (একাদশ তম) ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। জেলবন্দী (প্রেসিডেন্সি জেল) সুভাষ, নভেম্বর মাসে আমরন অনশন শুরু করলে, সুভাষের শারীরিক অবস্থার ভীষণ অবনতি হয়। ঘাবড়ে যায় ব্রিটিশ প্রশাসন। সুভাষ কে তখন তারা ঘরেই নজরবন্দী করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে গৃহবন্দী হয়ে সুভাষ বাড়িতে আসেন। বাড়িতে আসা থেকেই সুভাষ তাঁর ভাইপো শিশির বসুর সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনার নীল নকশা তৈরি করার কাজ শুরু করেন।
সুভাষচন্দ্রের মা প্রভাবতী দেবী তখন বাড়িতেই। তিনিও কোনোকিছু টের পাননি। শুধু শিশির বসু আর ইলা নামের সুভাষের এক ভাইঝি যে সুভাষের দেখভাল করতেন বাড়িতে এই দুজনই সুভাষের এই পরিকল্পনার মূল সহযোগী ছিলেন। মহানিষ্ক্রমণের পূর্বে ইলা এবং শিশির দুজনে একদিন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যান পুজো দিতে। উদ্দেশ্য মা ভবতারিণীর কাছে সুভাষের যাত্রাপথের মঙ্গল কামনা করা। প্রসঙ্গত বলে নিই, এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য নেতাজীর ঐতিহাসিক মহানিষ্ক্রমণ পর্ব বা মহানিষ্ক্রমণের দিন ঘটে যাওয়া বহু চর্চিত ঘটনাপুঞ্জের চর্বিতচর্বণ নয়। মূলত মহানিষ্ক্রমণ পরবর্তী ঘটনাক্রম ও তার প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমে এই সংক্রান্ত পরিবেশিত খবরের উপরে আলোকপাত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মহানিষ্ক্রমণের দিনে অর্থাৎ ১৬ই জানুয়ারীর সন্ধ্যায় সুভাষের করা একটি ঘোষণার কথা অবশ্যই বলে নেওয়ার দরকার। যদিও এই ঘোষণার ব্যাপারে শিশির বসু আগে থেকেই সব জানতেন। তো যাই হোক, ঘোষণা মতো বাড়ির সবাই জেনে গেল যে সেদিন সন্ধ্যা থেকে সুভাষ এক ব্রত শুরু করবেন; যে কারনে কার্যত তিনি আর ঘরের বাইরে বেরুবেন না, কারুর সঙ্গে কথা এমনকি টেলিফোনেও কোনো কথা বলবেন না।। একশো ভাগ নির্জনবাসে কাটাবেন। এর জন্য প্রস্তুতি হিসেবে সুভাষের থাকার ঘরটিকে বড় বড় বেডশিট দিয়ে তিন ভাগে ভাগ করা হোল। সুভাষের খাট সহ উত্তরের দিকে অংশটিকে আলাদা করে দক্ষিণের বাকি পরিসরকে দুই ভাগে ভাগ করা হোল। দরজার মুখে একটি ছোট টেবিল রাখা হোল যার ওপরে বাড়ির ঠাকুর সর্বেশ্বর এসে এসে শুধু দুবেলার খাওয়ার রেখে যাবে এবং খালি থালা নিয়ে চলে যাবে। যথারীতি এই খবর কানে যাওয়ার পরে, সুভাষের মা প্রভাবতী দেবী ১৬ই জানুয়ারী রাত্রেই এলেন সুভাষের ঘরে। উদ্দেশ্য ব্রত শুরুর আগে ছেলেকে নিজের সামনে বসিয়ে খাওয়ানো। বলাই বাহুল্য সুভাষ এবং তাঁর মায়ের সেটাই ছিল শেষ সাক্ষাৎ। ব্রিটিশ পুলিশকে অন্ধকারে রাখতে, সুভাষ কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন নিজের বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গেও এই নাটকটি করতে। সুভাষ চাইছিলেন তাঁর এই গৃহত্যাগের খবরটি যে করে হোক দিন চারেক যেন ‘লিক’ না হয়। মহানিষ্ক্রমণের আগে এক সন্ধ্যায় সুভাষ, তাঁর ভাইপো শিশির বসুর কাছে এই নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “এলগিন রোডের আমাদের এই বাড়িটি এত বড় এবং এত রকমের লোকজন এখানে যাওয়া আসা করে যে খুব বেশীদিন লাগবেনা খবর ফাঁস হতে”।
“দিন চারেক যদি চেপে রাখতে পারো তাহলে তার মধ্যেই আমি পগার পার হয়ে যাবো”। কিন্তু কার্যত দেখা গেল সুভাষের গৃহত্যাগের এই খবরটি প্রকাশ্যে এল প্রায় দশ দিনের মাথায়, ২৬শে জানুয়ারীর ভোরে। পুরো ব্যাপারটাই পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। শরৎ বসুর কাছ থেকে সবুজ সিগন্যাল পাওয়ার পরেই ২৬শে জানুয়ারীর আগের দিন, শনিবারের রাতের খাওয়ার অভুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। যথারীতি ঠাকুর সর্বেশ্বর পরের দিন খাওয়ার দিতে এসে এটা দেখার পরেই বাড়ি জুড়ে হৈচৈ শুরু হয়, এবং চতুর্দিকে খবর রটে যায় যে সুভাষকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি গৃহত্যাগী হয়েছেন।
পরের অংশ পড়তে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে!
সুভাষের মহানিষ্ক্রমণ ও সংবাদ পত্রে প্রকাশিত খবর!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন