সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নেতাজীর জন্মদিনে সিঙাড়া ভোগ!

সাধারণত কোনো ভগবানের উদ্দেশ্যেই ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে নেতাজীকে সিঙাড়া ভোগ দেওয়ার কথা শুনে চমকে যাবেন না যেন। আসলে নেতাজী ভক্ত মানুষজনের কাছে নেতাজী যে ভগবানের চেয়ে কিছু কম নন এই নিয়ে সে অর্থে কোনো দ্বিমত নেই।
যদিও এর পূর্বে এই ধরনের খবর সাধারনের নজরে আসেনি। কিন্তু পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে অবস্থিত রায়েদের বাড়িতে এমনটাই হয়ে আসছে দীর্ঘকাল।  কারণ পূর্বস্থলীর এই রায় বাড়িতে, ১৯৩২ সালে একবার নেতাজী এসেছিলেন। রায় বাড়ির তখন দুই ভাই রমেশ্চন্দ্র এবং সুরেশ্চন্দ্র - সুভাষ চন্দ্রের অনুগামী হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। এছাড়াও রমেশচন্দ্রের স্ত্রী শিবভাবিনী দেবী তখন জেলা কংগ্রেসের অন্যতম পদাধিকারীনী ও ছিলেন। প্রসঙ্গত নেতাজী তখনও জাতীয় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন নি ঠিকই কিন্তু ইতিমধ্যে (১৯২৩ সাল) সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। কাজ করেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও। সুভাষ প্রথমবার গ্রেপ্তার হন ১৯২৪ এ, একেবারে শেষের দিকে। গ্রেপ্তার করে সুভাষকে বার্মায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত বার্মায় বন্দী ছিলেন সুভাষ। উল্লেখ্য সুভাষ তাঁর এই প্রথম বন্দীদশায় প্রচুর চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় মেজদা (শরৎ বসু) এবং মেজ বৌদি কে। এবং মুক্তি পাওয়ার পরে বার্মা থেকে নিয়ে এসেছিলেন একটি সুন্দর বুদ্ধ মূর্তি। যেটি বর্তমানে নেতাজী ভবনের মিউজিয়ামে রাখা আছে। আসলে নেতাজীর পূর্বস্থলীতে আসার প্রেক্ষাপটটাকে ভালো করে বোঝার জন্যই এত কথার অবতারণা। প্রসঙ্গত সুভাষ ১৯২৭ এ বার্মা থেকে ফিরেই জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮ এ, কোলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জি ও সি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) হিসেবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে আবারো গ্রেপ্তার হন। ১৯৩০ এ কোলকাতা পুরসভার ভোট ঘোষণা হলে সুভাষ জেলবন্দী অবস্থাতেই প্রার্থী হন। বলাই বাহুল্য সেই ভোটে তিনি বিজয়ী হন এবং মেয়র নির্বাচিত হয়ে তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু তথা পূর্বতন মহানাগরিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের চেয়ারে আসীন হন। প্রসঙ্গত ১৯২১ এ সুভাষ আই সি এস ত্যাগ করে আসার পরে দেশবন্ধুর আদর্শেই অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই দেশবন্ধু যখন ১৯২৪ এ কোলকাতার মেয়র হিসেবে শপথ নিলেন, সুভাষ কোলকাতা পৌরসভার সি ই ও বা মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার নিযুক্ত হন।  সুভাষের জীবনের নানা সময়ের বিশেষ করে ১৯৩২ এর আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার এই সালতামামী কিছুটা ধান ভাঙতে শিবের গাজনের মতন শোনালেও এই নিবন্ধের সুচীমুখ কে সুস্পষ্ট করে তোলার পক্ষে এর ভূমিকা কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ১৯৩০ এ গান্ধীজীর বিখ্যাত ডান্ডি অভিযানের মাধ্যমে দেশ জুড়ে তখন লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। তার প্রভাবে পড়েছিল বাংলাতেও; বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই আন্দোলন ছুঁয়েছিল তার সর্বোচ্চ সীমা। এদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল মৃত্যুতে বাংলার কংগ্রেস শিবির তখন কার্যত কর্তাহীন এবং দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল।  এক শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তরুন সুভাষ আর অন্যটিতে চট্টগ্রামের যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। দুজনেই নিজেদের অনুগামীদের নিয়ে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই সময় নেতাজী বাংলার বিভিন্ন জেলায় চষে বেড়িয়েছেন এবং সেই সূত্রে এসেছিলেন বর্ধমান জেলাতেও। ১৯৩২ এর আগে নেতজী বর্ধমানে এসেছিলেন ১৯৩০ এ;  গিয়েছিলেন কালনার জ্ঞানানন্দ আশ্রমে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ গৌরবানন্দ অবধূত; ধর্মচর্চার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নানাভাবে তাঁর আশ্রমে ঠাই দেওয়ার কাজ করে যেতেন। তাঁর সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেন সহ অনেক বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে নেতাজী ১৯৩০ এ কালনায় এসে এই আশ্রমে কাটিয়েছিলেন প্রায় দু দিন ও দু রাত ।  নেতাজীর ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, খাওয়ার টেবিল সহ বিছানা এখনও সংরক্ষিত রয়েছে এই আশ্রমে। প্রতি বছর ২৩ শে জানুয়ারী কালনার এই আশ্রমে যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে নেতাজীর জন্মজয়ন্তী পালিত হয়ে থাকে। এদিকে ১৯৩০ এ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, আন্দোলনের আঁচ তখন মধ্য গগনে; বাংলায় এর প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশী। দেশের মধ্যে বাংলা থেকেই সর্বাধিক ১৫০০০ লোক কারাবন্দী হয়েছিলেন। নেতাজী তখন বাংলায় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন চরকির মতন। সেই সূত্রে ১৯৩২ এ  কাষ্ঠশালী থেকে মেড়তলা যাওয়ার পথে তিনি রায় বাড়িতে এসেছিলেন সেবার। বাড়িতে  কিছুক্ষণ বসেও ছিলেন। যে চেয়ারে বসেছিলেন, নেতাজীর স্মৃতিধন্য সেই চেয়ারটিকে যত্ন করে রাখা রয়েছে রায় বাড়িতে। রায় বাড়ির বর্তমান উত্তরসূরি তপন রায় বা গৌতম রায়দের মতে প্রত্যেক বাড়িরই একজন কুলদেবতা থাকেন। নিত্য তাঁকে পূজা অর্চনা করা হয়। তেমনি রায় বাড়ির কুলদেবতা হলেন নেতাজী।  বিশেষ করে ২৩ জানুয়ারী, নেতাজীর জন্মদিনে তাঁর প্রতিকৃতির সামনে বিশেষ সিঙাড়ার ভোগও দেওয়া হয়। সিঙাড়া ভোগ দেওয়ার অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। নেতাজী যেদিন রায় বাড়িতে এসেছিলেন, শিবভাবিনী দেবী সিঙাড়া বানিয়ে খাইয়েছিলেন নেতাজীকে।  
প্রসঙ্গত ১৯৩২ এই নেতাজী পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয় বন্দী করে। যেখানে তাঁর মেজদা শরৎ চন্দ্র বসু ও তখন জেল বন্দী হয়ে ছিলেন।  উল্লেখ্য সুভাষ ১৯৩৩ এ জব্বলপুর জেল থেকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ইউরোপে চলে যান এবং সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এমিলি শেঙ্কলের, যার সঙ্গে ১৯৩৭ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; অবশ্য সে অন্য গল্প।

তথ্য ও সংবাদ সূত্র:
১) বসু বাড়ি, শিশির কুমার বসু
২) বাংলায় আইন অমান্য আন্দোলনের ইতিহাস, চিত্তরঞ্জন মিশ্র 
৩) সংবাদ প্রতিদিন এর ১৭ই জানুয়ারী, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এই সংক্রান্ত খবর।


নেতাজী সম্পর্কে আরও লেখা পড়ুন। 

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসঃ এক ওড়িয়া যুবকের গল্প! 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...