সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কথার কথা!

সৌন্দর্য বাপু গাছে ফলে না! দাঁড়াও দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও। কথায় আছে বলে বেদবাক্য তো নয়। এই যে দিনরাত আহ্ ফুল, ওহ্ ফুল বলে এত শিহরিত হও, সেই ফুল কি গাছে ফলে নাকি ঘরের ওয়ার্ডরোবে!

খালি কথার কথা; অতীতের কিছু বুড়ো হাবড়া চন্ডিতলা, শীতলাতলায বসে, থেলো হুঁকোয় টান মারতে মারতে এমন অনেক ভুলভাল কথার ফতোয়া দিয়ে গেছে। যত্ত সব ফুট কাটা, গেঁয়ো কথা। তাছাড়া বেদবাক্য হলেই কি তার সাত খুন মাফ! ও সব মুখেন মারিতং জগৎ মার্কা বাণী। নাহলে কি আর বেদের অপর নাম শ্রুতি হয়! সব কথা ব্যাদে আছে বলে অনেক দিন চলেছে, আর নয়। এখন হোয়াটসাপ, ফেসবুক, ইনস্টার যুগ। খালি বললেই হলো! এতদিন এসব ছিল না বলেই চলছিল, কিছু তো একটা বলতে হবে নাকি! শুধু কথাতে তো আর চিড়ে ভেজে না। কথার মাঝে একটু প্রবাদ প্রবচনের পাঁচফোড়ন না ছেটালে কি আর কথকতা জমে! এইভাবে মুখে মুখে বলতে বলতে কত এগোবেগো কথাই যে প্রবচন হয়ে গেছে তার হিসেব প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবীশের কাছেও নেই। হিসেবের কথা যখন উঠলোই তখন হিসেব করে কি লাভ সে প্রশ্ন তো উঠবেই; কারণ কথাতেই তো আছে সব হিসেবই শেষ পর্যন্ত নাকি শূন্যতে এসে ঠেকে। দেখুন মজা। কতকগুলো হেদো মানুষ যাদের কাছে সঞ্চয়ের জন্য না ছিল কোনো রোকড়া না ছিল তাকে জমিয়ে রাখার কোনো সুব্যবস্থা। ব্যাংক, চিট ফান্ড কিংবা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ছিল সুদূরপরাহত। ছিল কেবল মহাজনী কারবার। যখন সঞ্চয় না জানি কোন্ মুলুকের ভূত, কেবল ঋণের বোঝাই চেপে ঘাড় মটকাতো ওই ওগাবগা মানুষ গুলোর। তা দিনের শেষে, প্রেমিকার গালে আদরের চুমু লেপে দিতে দিতে এই টুক আপ্তবাক্য তো না বললেই নয়। অভাবেই তো মানুষের ভাবের উদয় হয়। তবে অভাবে স্বভাব নষ্ট হওয়ার কথা বলে গেছেন বটে বনমালী জেঠু কিন্তু সারাজীবন তিনি একটিও ভাবের কথা বলেননি। এই নিয়ে জেঠিমার অনেক অনুযোগ ছিল। যাকগে বড়দের দোষ দেখতে নেই। ওতে নাকি পাপ হয়। তা তো হবেই। বুড়ো গুলো কম রসিক তো ছিলেন না। তাছাড়া মুরোদও কিছু কম ছিল না তাদের! শুধু কথার বন্দুকেই যে কত বাঘ সিংহ মেরে এসেছেন এরা যুগের পর যুগ ধরে, তার কোনো লেখাজোঁকা কোথাও নেই। তবে মন্দের ভালো, লেখা নেই বলে কেউ কপিরাইটও দাবী করে না। শুধু বলেই খালাস, খরচা আছে বলে কেউ আপনার কাছ থেকে একটা কানাকড়িও ক্লেম করবে না। ভাবুন একবার, শুধু কথায় আছে বলে সুদখোররাও নিজেদের মহাজন বলে জাহির করে এসেছে দীর্ঘদিন। নাহলে, মানুষকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে ও নিজেদেরকে মহাজন উপাধিতে ভূষিত করে রাখার কৃতিত্ব তো কম বড় সাফল্য নয়। আলফ্রেড নোবেল জানলে চিটিংবাজীর নোবেল পুরস্কারটি নিশ্চিতভাবে আমাদের গ্রামের 'প্রখ্যাত মহাজন' রামেশ্বর দাদুকেই দিয়ে যেতেন। এই দেখুন, হচ্ছিল গাছে ফলার কথা, চলে এলাম মহাজনী কারবারে। যাকে বলে ধান ভাঙতে শিবের গাজন গাওয়া আর কি। তবে হ্যাঁ বুড়োদের এলেম ছিল বটে; দেখুন কোথায় জুতো সেলাই আর কোথায় চন্ডি পাঠ, কি অসাধারণ জৌলুস এই কথাগুলোর আজোও; উঠতে বসতে তথাকথিত এই 'সোশাল' সমাজেও দিনরাত আমরা এই সব কথাই আউড়ে চলেছি। হয়তো ভবিষ্যতেও করে যাবো। এইরকমই হয়তো কথার খই ফুটে যাবে আমাদের মুখে। আচ্ছা খই তো হাঁড়িতে ফোটে, এখন অবশ্য ভুজিয়াওয়ালার দোকানে ওঠে। কিন্তু সে যতই অকথা কুকথা বলি না কেন, সেই স্বভাব দার্শনিকদের কিন্তু আজ বড় অভাব। চন্ডিতলার সমাজ বর্তমানে 'সোশাল সমাজে' উঠে এসেছে ঠিকই কিন্তু একটাও কথা প্রবাদ হয়ে উঠতে পারে নি। দেখা যাক আগামী দিনে কোনো অভাবের কালে যদি ভাবের উদয় হয় কি না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...