সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্মতলার শিমুলতলা ও বসন্ত!

পৃথিবীতে যে কটি জায়গা রয়েছে যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ছবি হয়ে উঠতে পারে, কোলকাতার ধর্মতলা অবশ্যই তাদের মধ্যে একটি। অনেকটা আলিবাবা চল্লিশ চোর গল্পের সেই খাজানা ভর্তি গুহার মতন, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব অবস্থা হয় এখানে এলে। সিগন্যালের লাল সবুজ, এখানে যে ধরনের নাটকীয়তা আনে যানবাহনের গতি মুখরতায় তা এককথায় স্বর্গীয় অথবা নারকীয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।


ধর্মতলার শিমুলতলা!

মানুষজনের তুমুল ব্যস্ততা দেখে মনে হয় কুম্ভমেলার মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি এই বেরিয়ে গেল হাত থেকে। বিশেষ করে দূরপাল্লার বাস স্ট্যান্ড গুলোর দিকে, বোঁচকা বুঁচকি, লটবহর সমেত মানুষের ছুটে যাওয়ার দৃশ্য ধর্মতলার একটি অতি পরিচিত ছবি। এখানে সবাই ছুটে চলেছে নিশ্চিত অথবা অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে। নিত্য যাতায়াতের তোড়ে, ধর্মতলা যেন কোনো সুনাব্য নদীখাত, শত শত মলিন অমলিন, সুখে দুঃখে থাকা মুখচ্ছবি গুলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ভেসে চলে কাতারে কাতারে যানবাহনের চলমান জানালার ধারাস্রোত ধরে।

কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও দু একটা পাগল রয়েছে যারা কে সি দাশের মিষ্টি দোকানের সামনে দাঁড়িয়েও, অবলীলায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে টিপু সুলতান মসজিদের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে পারে। কতজন যে মেট্রো হলের সামনে, সান্ধ্য ভ্রমণের ঢঙে ফুটপাতের এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘুরে বেড়ায়; তার মধ্যে কতজন কেনাকাটা করে আর কতজন শুধু দাম দস্তুর করতে করতেই সময় কাটিয়ে দেয় তার কোনো ইয়াত্তা নেই। ধর্মতলার প্রকৃত অর্থেই কসমোপলিটন সংস্কৃতি। এখানে যে কোনো ধর্মের যে কোনো বর্ণের এবং যে কোনো ভাষা ভাষী মানুষই চলাফেরা করেন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। । ধর্মতলা ধর্মেও আছে আবার জিরাফেও। মাঝে মাঝে বিপ্লবের আগুনেও হাওয়া দেয় এই ধর্মতলা। বহু আন্দোলন এবং মতবাদ তৈরীর আঁতুড়ঘর এই ধর্মতলা। কোলকাতার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক গ্র্যান্ড হোটেল থেকে শহিদ মিনার; ফুটপাতের তিরিশ টাকার আলুচোখা ডাল ভাতের হোটেল থেকে ডেকারস লেনে টুঁ মারা ধর্মতলা দিয়েই হয়। রাজস্থানী শরবতের রাজকীয় গ্লাসে অনায়াসে দুটি স্ট্র চুবিয়ে, প্রেমিক প্রেমিকা দুজনকে দেখা যায় এখানে ফলের রসের আস্বাদন নিতে। ধর্মতলায় তাই আর পাঁচটা ঋতুর মতন বসন্ত ও আসে তার পসরা সাজিয়ে।

ট্রাম রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শিমূল গাছটি তাই প্রতি বসন্তে হয়ে ওঠে লালে লাল। নীচ দিয়ে যাওয়া ট্রামের মাথায় কখন যে তা ঝরে পড়ে নিঃশব্দে, কেউ টেরও পায় না। শুধু ট্রাম রাস্তার ধারেই বা কেন, মেট্রো চ্যানেলের মাথায় লালে লাল শিমুল ভর্তি ডালায় নিত্য লুকোচুরি খেলে চড়ুই আর ভাত শালিকেরা। ফুটপাতের ওপর বিছিয়ে পড়ে থাকে শাখা ছিন্ন শিমুল ফুল।
এই বসন্তেও তার ব্যত্যয় হয় নি। চোখে পড়তেই তুলতে গেলাম, মানে ছবি তুলতে গেলাম। । আমার উৎসাহ দেখে ডিউটিরত এক পুলিশ কর্মী জিজ্ঞাসা করলেন আমার বাড়ি কোথায়! পুলিশের কাছে আর ডাক্তারের কাছে নাকি নিজের নাম আর বাসস্থান লুকোতে নেই। তাই বলেই দিলাম। "আজ্ঞে নরেন্দ্রপুর"!
"সে কি নরেন্দ্রপুরে শিমুল গাছ নেই"?
যারপরনাই অবাক সেই পুলিশের প্রশ্নে আমার উত্তর যেন তৈরিই ছিল।
সবিনয়ে বললাম, "আজ্ঞে, আছে, ফুটেছেও বেশ; তবে ধর্মতলার শিমুলতলা কি আর পাওয়া যাবে সেখানে"?
শুনে পুলিশ মহোদয় তো বেজায় খুশি, এক মুখ হাঁসি নিয়ে বললেন, "তুলুন তুলুন, ভালোই বলেছেন"!


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...