সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নিজের নিজের কক্ষপথে সবাই ঘোরে!

ঘরে থাকেন ভোগী আর ঘোরে থাকেন যোগী। চিড়িয়াখানায় - ধরা পড়া জীবজন্তু আর জেলখানায় দোষী সাব্যস্ত অপরাধী মানুষ। এমনকি বৈরাগী, তাঁরও - সে হোক না বৃক্ষতল ; দিনের শেষে তিনিও ফিরে আসেন তাঁর সেই গাছতলার পর্ণ কুটিরে। যাযাবর - সেও ঘুরে ঘুরে সেই তাঁবুতেই ফিরে আসে দিনান্তে। শালিক, বাবুই, ময়না, ফিঙে তারাও বাসায় ফেরে। নিজ কক্ষে ফেরার বাসনা মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে আদিম বাসনা। সৃষ্টির আদি লগ্নে, সেই গাছের বাকল পরা মানুষ গুলো পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে গুহায় ফিরতো। তাই কক্ষে ফেরা এক অনির্বাণ চিরন্তন সত্য। কিন্তু ফিরতে গেলে তো একটা পথ চাই। সে পথ এবড়োখেবড়ো কি মসৃণ যাই হোক না কেন কক্ষে ফেরার একটা কক্ষপথ চাইই চাই। কক্ষচ্যুত অস্তিত্ব আসলে বিলীয়মান অস্তিত্ব। ধরুন আমরা যে গ্রহে বাস করি সেই পৃথিবীও তার কক্ষপথে থেকেই দিব্যি টিকে রয়েছে হাজার হাজার বছর। পৃথিবী আজকে যেখানে আছে, সেখানে আবারো ফিরে আসতে হয়তো সময় লাগবে ৩৬৫ দিন কিন্তু ফিরে তো আসবেই। ফিরে আসার এই অন্তহীন বাসনা থেকেই নির্মাণ হয়েছে কক্ষের, আর সেই কক্ষকে ঘিরে নিরন্তর আবর্তিত হয়ে যাচ্ছে কক্ষপথ গুলো।

এই মহাবিশ্বের যাবতীয় অস্তিত্ব রহস্য লুকিয়ে রয়েছে নিজ নিজ কক্ষপথে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আবর্তিত হওয়ার মধ্যেই।

এমনকি জীবজগৎ এর বাইরেও রয়েছে নিত্য কক্ষে ফেরা এবং কক্ষপথে বিরামহীন আবর্তনের গল্প। বিজ্ঞানী ডাল্টনের পরমানুবাদ সেই গল্প-কথাকেই স্বীকৃতি দেয়। সেখানেও পরমানুর মধ্যে, নিত্য কক্ষপথ ধরে ঘুরে চলেছে ইলেকট্রন কণা। কক্ষচ্যুত হলেই বিপদ। বিলুপ্ত হয়ে পড়বে পদার্থের অস্তিত্ব তত্ত্ব।

এই পৃথিবীর হকার বেকার সক্কলে যে যার অভিষ্ট পূরণের লক্ষ্যে নিজ নিজ কক্ষপথ ধরে ঘুরে চলেছে। সাধু, সন্ন্যাসী মহাপুরুষ তাঁরাও কক্ষপথে থেকে কক্ষপথ মুক্তির সাধনা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

তবে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই কক্ষপথ পূর্ব পশ্চিমে ঈষৎ চ্যাপ্টা হলেও আদতে কিন্তু তাকে চক্রাকৃতিই হতে হবে।

আপনি আপনার নিত্য রোজনামচা যদি পর্যবেক্ষণ করেন দেখবেন ওই ঘর থেকে বেরনো আর ঘরে ফেরার গল্পই প্রতিদিনকার একমাত্র সত্য বাকি সব অনুষঙ্গ; হয় পার্শ্ব চরিত্র নয় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জনিত কিছু ঘটনার এদিক ওদিক। আসলে থোড়বড়িখাড়া না হয় খাড়াবড়িথোড়, কিন্তু আবর্তনের গতিপথ সেই চক্রাকারই। কোথাও কেউ যাচ্ছে না। খালি সরণ শূন্য ঘুরে যাওয়া। হয়তো প্রতিদিনের ডাল আলুচোকার জায়গায় একদিন একটু পাড়ার দোকান থেকে বিরিয়ানি নিয়ে এসে খাওয়া হল মাত্র। আসল লক্ষ তো পেট পোরানো। রোজ রোজ অফিস বাড়ি করতে করতে হেদিয়ে গিয়ে পাশের সিকিম গ্যাংটক ঘুরে আসার মতন। আসল লক্ষ বেঁচে থাকার কক্ষপথে টিকে থাকাই তো হল নাকি।

কিন্তু মুক্তি কি নেই। সেই তো বসন্ত, বসন্তের পরে গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মের পরে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আবারো সেই বসন্তের ব্যামো। কক্ষপথের দিনরাত্রি, কক্ষপথের ঋতুবদল সবই তো প্রশ্নপত্রের জানা কোয়েশ্চেন।

এর থেকে মুক্তি কি নেই? এমনকি সময় - সেও চক্রাকারে ছুঁয়ে যায় সময়ের দিকচিহ গুলোকে। বড় হেদিয়ে যাওয়া জীবনের কক্ষপথ। বৈচিত্র্য কোথায়। একমাত্র ছিটকে মহাশৃণ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াই উপায়। কিন্তু সে পাগলেও জানে। কিন্তু ছিটকে যেতে পারে কি, কক্ষে ফেরার বন্ধন থেকে চির মুক্তি পেয়ে। এটি একটা লাখ টাকার প্রশ্ন।

আর শুধু জানলেই বা কি, পাগলেও তো নিজের ভালোটা বোঝে। তাই চেতনে অবচেতনে কক্ষপথ  এক অবিকৃত সত্য। ছিল আছে থাকবে। চলুক না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...