সকাল দশটার শিয়ালদহ স্টেশন; কাতারে কাতারে মানুষ প্রতিনিয়ত ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে।
একটা হজঘট ভিড়ের ছবি কখনোই মুছে যায় না দৃষ্টি পথ থেকে। স্রোতস্বিনী নদীর মতন, নিত্য বহমান থাকে - সে অসংখ্য মানুষের অবিরত পদক্ষেপ ধারা।
নিরন্তর চলমান এই ভিড়ের মাঝে খ্যাত অখ্যাত, গেঁয়ো শহুরে, ধনী দরীদ্র, কৌশলী বোকা কারোরই কোনো আলাদা আইডেন্টিটি থাকে না।
তবু, এর মাঝেই কিছু ছবি যে কি অভূতপূর্ব তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে কোনো বিশেষ দিনের প্রেক্ষাপটে সেই ছবি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠে যে সহজে ভিড় তাকে গ্রাস করে নিতে পারে না।
যেমন এই ছবিটি।
এক অন্ধ গায়ক (ট্রেন সিঙ্গার), তাঁর কাঁধে ঝুলছে স্পিকার লাগানো ভারী একটা কাঠের বাক্স। সকাল ৮টা ২০'র ক্যানিং লোকালে উঠেছিলেন গান করতে তালদী স্টেশন থেকে। শিয়ালদহ এ নেমেছেন, সঙ্গে স্ত্রী, তিনি আবার বা হাত দিয়ে ক্যাসিওটাকে এমন বুকের কাছে ধরে রেখেছেন যেন সরস্বতীর হাতে ধরা বই। ডান হাতে ধরা, তাদের ছোট্ট মেয়ের হাত।
কিন্তু তাতেই কি আর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়! হাত দুটো বন্ধ তো কি হয়েছে, কাঁধ তো রয়েছে। দৃষ্টিহীন স্বামীর যে ঐ কাঁধ ই ভরসা। ভিড়ের মধ্যে ঐ ভরসার কাঁধটাই যে তার শেষ সম্বল, এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি দিনটি ছিল ৮ই মার্চ, বিশ্ব জুড়ে সেদিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় ঘটা করে। নারীর অধিকার রক্ষায় খরচ হয়, কোটি কোটি মরমী শব্দ। কিন্তু নারী কি অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে শুধু বিপন্ন পক্ষ হয়েই থেকে যাবে নাকি সেও কাউকে বেঁচে থাকার জন্যে তার শক্ত কাঁধটাকে বাড়িয়ে দেবে অনাবিল, সহজ সাবলীলতায়!
যেমন এই মহিলাটি, শুধু যে তাঁর অন্ধ স্বামীরই অন্ধের যষ্টি হয়ে উঠেছেন তাই নয়; আন্তজার্তিক
নারী দিবসের ঘনঘটায় যেন এই নারীকেই পুরো সমাজের যোগ্য দিশারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখলাম আমি।। তাঁর না ঝুঁকে পড়া কাঁধ, দীপ্ত ভঙ্গিমা অসম্ভব এক আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল যেন। শুধুই প্রেরণা কিংবা করুনার পাত্র নয়; এই নারীই যেন সেই মুহূর্তের পুরো সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যথার্থ মশাল বাহক হয়ে উঠলো আমার চোখে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন