সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রামনাথের রাম নাম!

আরাম নেই জীবনে, শুধুই পেটের দায় রামনাথের। উদয়াস্ত জল বয়ে এনে দেয় ধর্মতলায়, ফুটপাতের খাওয়ার দোকান গুলোতে। রুটি রুজির ধান্দায়, বিহারের সমস্তিপুর থেকে সুদূর কোলকাতায় এসেছিল অনেক দিন আগে। বউ, ছেলে মেয়ে থাকে, বিহারে। দেখা হলেই আগে, 'রাম রাম, ভাইয়া' বলে হাত ঠেকায় কপালে।

চৈত্রের প্রবল রোদের ঝাঁঝ কিন্তু রামনাথের বিরাম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রামনাথ যখন বাঁকে করে দু কাঁধে দুটি ভারী জলের টিন বয়ে নিয়ে যায়স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে রাম নামতবে তার বলার মধ্যে কোনো লালিত্য থাকে না। থাকে যন্ত্রনাথাকে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কাতর আকুতিদীর্ঘ শ্বাসের শ্লেষযেন প্রেসার কুকার নির্গত হুইসেল বেজে উঠছে বুকের হাপর ঠেলে। বলে উঠছেএবার তো ক্ষমা দাও। এক একটা রাম নাম যেন ভগবান শ্রীরামের ধনুক নিঃসৃত এক একটা তীরের ফলা। সুতীক্ষ্ণ শেলের মতো নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অহরহআছড়ে পড়ছে ক্ষীর ননী খাওয়া তথাকথিত আরামে থাকা সমাজের বুকে।
আজ রাম নবমী। মিছিল বেরিয়েছে; জয় শ্রী রাম ধ্বনি উঠছে গর্জে গর্জে। রামনাথ খানিক দূরে ধর্মতলার ফুটপাত থেকে সে মিছিল দেখে আর একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে তার মনে পড়ে যায় রামকুঞ্জ'র কথা। রামকুঞ্জ তার ছেলে। রামকুঞ্জ গতকাল রাত্রে ফোন করে বলেছে, ক্লাস ইলেভেনে সে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হতে চায়। রামনাথ বোঝাতে পারে নি তাকে যে তার পক্ষে এর খরচ সামলানো কতটা কষ্টের। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে মেয়েটার, কি করবে রামনাথ বুঝে উঠতে পারে না; ঘাড়ের কাছে, আইবুড়ো মেয়েটা যেন উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে চলেছে। দিনকাল খারাপ, কখন কি বিপদ হয়।
রামনাথ কে পাশের পান দোকানী, হরিবংশ ডাকে মিছিলে যাওয়ার জন্য। মিছিল থেকে মুহুর্মুহু ভেসে আসে জয় শ্রী রাম ধ্বনি। হরিবংশ স্থির থাকতে পারে না। গলা ফাটিয়ে, সেও চিৎকার করে ওঠে জয় শ্রী রাম বলে। কিন্তু রামনাথের আজ কি হয়েছে, কেন যে তার এমন মনে হচ্ছে আজ - মনে হচ্ছে, তার কানের কাছে কারা যেন প্রতিনিয়ত যুদ্ধে নামার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধে নামতে হবে, কিন্তু কার বিরুদ্ধে!
জীবনের একাধিক যুদ্ধে পরাজিত রামনাথের সব গুলিয়ে যায়।
হরিবংশ তাকে হাত ধরে টানতে থাকে। আরে চল চল, চল না।
রামনাথ ভাবছে, মিছিলে সকলে ভগবান রামের কথাই বলছে, কেউ তো রামনাথ বা রামনাথদের কথা বলছে না!
রামনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর হাবিজাবি যা তা ভাবতে ভাবতে কখন যে অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে রাম নাম, বুঝতেও পারে না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...