"তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জানো না"!
এ শহর কোলকাতা কি জানে, তার অলিগলি, রাজপথে কত বৈচিত্র্য ছড়িয়ে রয়েছে? ঝা চকচকে হোটেল, রেস্তোরাঁ, নিয়ন বাতির আলোর মাঝেও সে অজানা, অচেনা বৈভব যে এক কুহকী মায়া হয়ে জেগে থাকে তথাকথিত নাগরিক যাপনের চমক হীন জীবন যাত্রার মাঝেও, তার খোঁজ রাখে কয়জনা!তাই কালী কলকাত্তেয়ালী হয়েও, খাস কোলকাতার মধ্যেই তিনি, বছরের পর বছর ধরে প্রবাসী বিহারীদের দ্বারা পূজিতা দেবী হিসেবে বিরাজ করেন। সেই ১৯৫৭ সালের কথা, তখন বেলেঘাটার অবস্থান ছিল কোলকাতার এক প্রান্তে। বলা হোত - যার নেই পুঁজি পাটা, সে যায় বেলেঘাটা।সদ্য দশ বছর হয়েছে তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার। দেশ গঠনের কাজ চলছে, পুরোদমে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়। তিনি, সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা করলেন সেই সময়ে। এবং যথারীতি হাসপাতাল গড়ার জন্য বেছে নিলেন তখন কোলকাতার সীমান্তবর্তী অঞ্চল এই বেলেঘাটাকে, কারণ সল্টলেক তখনও আত্মপ্রকাশ করে নি। তাই বেলেঘাটাই ছিল তখন পূর্ব কোলকাতার সবথেকে প্রান্তিক অঞ্চল। জন্ম হলো বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালের। সেই সময়ে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী তথা ঝাড়ুদার সুইপারের কাজে বাঙালীরা সেইভাবে আগ্রহী ছিল না। তারপরে আবার সংক্রামক রোগের হাসপাতাল তাই কাজের লোক আনতে হয়েছিল বিহার থেকে। প্রধানত তুরি ও বাসফোর সম্প্রদায়ের বিহারীদের তুলে এনে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল সে সময়ে। তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, নব নির্মিত আই ডি হাসপাতালেরই ক্যাম্পাসের মধ্যে। টিনের শেড করে। এখন সেই টিনের শেড নেই। কিন্তু থেকে গেছে তাদের কলোনীর দেবী, চৈত্র কালী মায়ের ছোট্ট মন্দিরখানি। আই ডি হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ঠিক সামনে, পশ্চিম দিকে - পাঁচিলের গা ঘেঁষে, চাতালের ওপরে মন্দিরটির অবস্থান। চাতালের ওপর এক চিলতে মন্দিরটি, চার চালা বিশিষ্ট চূড়াকৃতি ছাদ ও দালান স্থাপত্যের আদলে নির্মিত; মাথায় কাঠ গোলাপ, পিপুল, আম, বট, নিম, কদম্বের ঘন ছায়া, যেন ঝাড়খন্ডের একখন্ড বনভূমি, মন্দিরের সামনে লাল সিঁদুর লেপা হাঁড়ি কাঠ, পাশে বাম দিকে এক খন্ড ত্রিভুজাকৃতি শিল খন্ড পোঁতা, তাকে গাঁও রাখোয়া দন্ড বলা হয়। যেন কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনা স্থল।
চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিনে হয় মায়ের বিশেষ পুজো। দিনের পুজো দিনের আলো থাকতেই শেষ হয়ে যায়। চৈত্র মাসে পুজো হয় তাই মাকে চৈত কালী আবার কেউ কেউ চেত কালী ও বলে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোনো বিগ্রহ নেই মন্দিরে। মন্দিরের দেওয়ালে মা কালীর ছবি রয়েছে শুধু।
সেই গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে শুরু হয়েছে এই চৈত কালীর পুজা। শুরু
করেছিলেন মুন্সী তুরি ও ভেঙ্কু তুরিরা, সবার সহযোগিতা ছিল।পুজোয় প্রথম থেকেই ছাগল বলি দেওয়ার রীতি চলে আসছে। এবছর ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। আই ডি হাসপাতালের চৈত কালীর পুজো উপলক্ষে তুরি সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়াও আশেপাশের বহু ভক্ত ভিড় করেন পুজো দেওয়ার জন্য। ফলমূল ভোগ দেন, ধুপ জ্বালান নিম গাছের গোড়ায়।
পুরোহিত বলতে তুরি সম্প্রদায়েরই কেউ পুজো করার দায়িত্ব নেন।তবে এই পুজোর বিশেষ আকর্ষণ হলো, পাঁঠা বলি দেওয়ার কাজ যিনি সম্পাদন করেন, সেই ভুবনেশ্বর ঘোষ, তাঁর স্ত্রী সবিতা দেবীর শরীরে মায়ের ভর হওয়া। মায়ের ভর হওয়ার পূর্বে, তিনি হাসপাতালের কোয়ার্টারে বসবাসকারী কর্মচারীদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে চাল ভিক্ষা নিয়ে আসেন নতুন গামছায় বেঁধে। সেই চাল আবার মুঠো মুঠো করে মায়ের বিশেষ আশীর্বাদী চাল হিসেবে ভক্তদের হাতে তুলে দেন তিনি। প্রসঙ্গত ভুবনেশ্বর বাবুর বাবাও এই বলি দেওয়ার কাজ করতেন। এলাকার ভক্ত মানুষ, মায়ের ভর গ্রস্থ এবং সেই সময়ের জন্য বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত সেই মহিলার কাছ থেকে নিজেদের ভূত ভবিষ্যত জানার চেষ্টা করেন। খুবই গাম্ভীর্যের দৃষ্টিতে দেখা হয় ব্যাপারটাকে।
পুজো উপলক্ষে সারা কোলকাতা থেকে বিশেষ করে তুরি সম্প্রদায়ের মানুষজন ঝেঁটিয়ে এসে উপস্থিত হন মন্দির প্রাঙ্গণে। ছেলে বাচ্চা, মহিলাদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ এবং আনন্দের ঢল দেখা যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন