সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গাজন ও শিব দুর্গার সঙ!

শিব দুর্গা ঘুরছেন, বাজারে দুপাশে সারি সারি দোকান, মাঝখানে যেটুকু পথ রয়েছে তাতে আবার পাতাই পেতে সারিবদ্ধভাবে ফল, সব্জী আবার কোথাও কোথাও গামছা, কাপড় ইত্যাদি নিয়ে বসেছে খুচরো দোকানদারেরা
বৈশাখ মাস, দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই কাঁথি সুপার মার্কেটের ভেতরকার রাস্তাগুলো - ধুলো জলে মাখামাখি হয়ে বেশ কাদা কাদা হয়ে গেছে। শৌখিন ক্রেতারা তাদের জামা কাপড় গুলোকে পা থেকে খানিকটা ওপরে তুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার মধ্যেই কেনাকাটা, দরদাম চলছে বেশ। একশো করে কিলো, মিষ্টি বেগুনফুলি আম - দোকানদারের হাঁক ডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে বাজার। এক আধটা রিক্সা, সাইকেল ঢুকে পড়লে বেশ গোলযোগ বেধে যাচ্ছে। মশলা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে, বাখারির মড়ার ওপরে রাখা গোল ঝুঁড়িতে সাজানো রয়েছে ছোলা, মটর, ঝুরি ভাজা, আঁচার তেল, পেঁয়াজ লঙ্কা কুঁচির বিভিন্ন আকৃতির কৌটা গুলো। খুব ব্যস্ততা; দোকানের চারিদিকে ইয়ং ছেলে মেয়েদের ভিড় জায়গাটিকে আরোও সংকীর্ণ করে দিয়েছে।


এইরকম হজঘট পরিস্থিতির মধ্যে যদি শিবঠাকুর একেবারে সস্ত্রীক মা দুর্গাকে নিয়ে হাজির হন তো কেমন হয় ব্যাপারটা।বাজারে উপস্থিত ধনীগরীবখ্যাতঅখ্যাতউঁচুনীচু যত যেই থাকুনশিব আর দুর্গার থেকে তো বড় কেউ নন। তাই সকলেই শিব দুর্গাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আমিও সকলের মতো উদগ্রীব হয়ে হাঁক পাড়লাম, ' শিবদাবলে।
একটু দাঁড়ান প্লিজ। শিব ঠাকুর থামতেই দুর্গা দাঁড়িয়ে পড়লেন পাশাপাশি। স্বাভাবিক। দুর্গার হাতে দেখি এক মানুষ সমান বড় একটা ত্রিশূল ধরা; সি এফ এল লাইটের আলো পড়ে চকচক করছে তার ফলা। শিব আবার ত্রিশূল ছেড়ে সানাই বাঁশি হাতে ধরে আছেন। 
সামনে পেছনে সন্ন্যাসী ভক্তদের লাইন। সাদা ধুতির ওপরে কায়দা করে গামছা আঁটা। কাঁধ বেয়ে পৈতের মতো সুতোর গাছা ঝুলছে পেটের ওপরে। একজন ভক্তর হাতে দেখি - জরিকাগজ, ফুল এবং অনেকগুলো গামছা বাঁধা একটা মস্ত বাঁশের দন্ড ধরা, একে দেউল বলে। মার্কেটের বড় বড় দোকানের সামনে, সেই দেউলকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখছেন সন্ন্যাসীরা। তারপরে দোকানদারের মঙ্গল কামনায় ফুল পাতা তন্ডুল নিবেদন করছেন মহাদেব শিবের উদ্দেশ্য। সঙ্গে রয়েছেন এই সঙ সাজা শিব দুর্গা দুজন; গাজনে সঙ সাজা একটা বহু পুরনো রীতি। বিশেষ করে শিব ও দুর্গার মান অভিমান ও তাঁদের একে অপরের মান ভাঙানোর গানই গাওয়া হয় গাজনে। যার ফলে গাজনে শিব দুর্গার সঙ সাজাটা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও, বাঁকা একটা বেল গাছের ডালকে ঘোড়ার মতো করে, বাজনার তালে তালে নাচ দেখান যিনি সেই গদাধর ভুঁইয়াও রয়েছেন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। অনেক কাল ধরে তিনি এই কাজ করছেন। কাঁথি শহরের অদূরে, বিল চালতি গ্রামের প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দিরে, দু মাস ধরে চলে গাজন। এই সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ন্যাসীরা ঘর ঘর ঘুরে মাধুকরী করেন। কখনোও বা আসেন বাজারে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সব জায়গাতে চড়ক হয়ে গেলেও, এখানে হয় নি। যেদিন হবে, স্থানীয় ভাবে তাকে বড়ভোগের দিন বলা হযে থাকে। সেদিন মন্দির প্রাঙ্গণে বসবে মেলা, গাজন গান হবে এবং সন্ন্যাসীদের নানারকম কষ্টকর কসরৎ দেখা যাবে, তার মধ্যে আগুনে গড়াগড়ি খাওয় থেকে শুরু করে বটি কাতান, দা’য়ের ওপর ঝাঁপ দেওয়ার রোমহর্ষক ব্রত খেলাও রয়েছে।

তা বেশ, শিব দুর্গা যেই না পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন, সটান শুরু হয়ে গেল ফটো সেশনের পালা। ক্লিক ক্লিক শব্দে, সঙ সাজা শিব দুর্গা দুজন, সোজা মোবাইলের ইমেজ গ্যালারীতে ঢুকে পড়লেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, নাম কিশিব বললেন তাঁর নাম দিবাকর ঘোড়াই।
দুর্গাকে জানতে চাইলাম, আপনার নাম? রামপদ ঘোড়াই।
আপনারা কি একই পাড়ার? হ্যাঁ আমরা দুজন বন্ধু।
সঙ সাজায় এখনোও পর্যন্ত পুরুষ লোকেরাই মহিলা সাজেন। আগের দিনে যাত্রা পালা গুলোয় এমনটা দেখা যেতো। সেই চল এখনোও রয়ে গেছে চৈত্র মাসের এই গাজন যাত্রায়।
এত কথা শোনার পর, দুর্গা বেশী রামপদ ঘোড়াই বললেন কি, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও হেভি লাইক কমেন্টস পাবে।
অগত্যা, তাই করলাম। দুর্গা মা থুড়ি দুর্গা বাবার আদেশ অমান্যি করবো অত সাধ্যি কোথায়!



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...