আচ্ছা বলুন তো, বই খায় না মাথায় দেয়? অবশ্যই বই খায় - তবে তা খায় ইঁদুর আর উই পোকায়, আর মাথায় দেয় নিঃস্ব, হতদরীদ্র, অভাবী মানুষ; বালিশ না পেলে বইকেই বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে তারা, তারপরে দিব্যি মাথার নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি একটু বেশী স্ববিরোধী হয়ে গেলো না ? দরীদ্র মানুষ, যার সাধারণ বালিশ পর্যন্ত জোটে না, সে রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা মোটা রচনাসমগ্র পাবে কোথায় মাথায় দেওয়ার জন্যে? কিন্তু পেতো, যাদের পেটে দুটো ভাত না পড়লেও চলতো, কিন্তু ছাপা অক্ষর খেতে না পারলে যাঁদের খিদে মিটত না, সেই সমস্ত লোকেদের ঠিকই জুটে যেতো। তাঁরা সমাজে বই পোকা হিসেবে চিহ্নিত হতেন স্বগর্বে।
চেয়ে চিন্তে, কখনো লাইব্রেরী - তা সে স্কুল কলেজ হোক কিংবা পাড়ার বেপাড়ার ছোট বড় গ্রন্থাগার যেখান থেকেই হোক তাঁদের বইয়ের গন্ধ না শুঁকলে ঘুম আসতো না। সম্পন্ন বই প্রেমীরা যদি বুকের ওপর বই রেখে ঘুমান তাহলে দরীদ্র বই ভক্তরা, মাথায় রেখে। আমার এক পিসিমাকে দেখেছি, সন্ধ্যায় - তখন বিদ্যুতের আলো ছিল না , কুপির লাল আলোই ছিল সম্বল; কিন্তু তাতে কি, কুপির যতটা কাছে সম্ভব শারদীয়া ‘দেশ’ এর অমন মোটা, চওড়া বইটাকে দিব্যি খুলে রেখে, তিনি হয়তো দেখতাম পড়ে চলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা রমাপদ চৌধুরীর কোনো দীর্ঘ উপন্যাস। কেউ যাতে বিরক্ত না করতে পারে, দোতলায় - বারান্দার এক কোণে বসে নিরিবিলিতে চলতো তাঁর পড়া, এবং তা চলতো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই। খেতে ডাকলেও তাঁর কোনো খেয়ালই থাকতো না সে ডাকে সাড়া দেওয়ার। এমন নিবিষ্ট পাঠক আমি বাপের জন্মে দেখিনি। এটা ছিল গত শতাব্দীর আটের দশকের কথা।
চেয়ে চিন্তে, কখনো লাইব্রেরী - তা সে স্কুল কলেজ হোক কিংবা পাড়ার বেপাড়ার ছোট বড় গ্রন্থাগার যেখান থেকেই হোক তাঁদের বইয়ের গন্ধ না শুঁকলে ঘুম আসতো না। সম্পন্ন বই প্রেমীরা যদি বুকের ওপর বই রেখে ঘুমান তাহলে দরীদ্র বই ভক্তরা, মাথায় রেখে। আমার এক পিসিমাকে দেখেছি, সন্ধ্যায় - তখন বিদ্যুতের আলো ছিল না , কুপির লাল আলোই ছিল সম্বল; কিন্তু তাতে কি, কুপির যতটা কাছে সম্ভব শারদীয়া ‘দেশ’ এর অমন মোটা, চওড়া বইটাকে দিব্যি খুলে রেখে, তিনি হয়তো দেখতাম পড়ে চলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা রমাপদ চৌধুরীর কোনো দীর্ঘ উপন্যাস। কেউ যাতে বিরক্ত না করতে পারে, দোতলায় - বারান্দার এক কোণে বসে নিরিবিলিতে চলতো তাঁর পড়া, এবং তা চলতো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই। খেতে ডাকলেও তাঁর কোনো খেয়ালই থাকতো না সে ডাকে সাড়া দেওয়ার। এমন নিবিষ্ট পাঠক আমি বাপের জন্মে দেখিনি। এটা ছিল গত শতাব্দীর আটের দশকের কথা।
আরও কিছু দিন পরে দেখা গেল, দিব্যি আমাদের কোলে (ল্যাপটপ) এসে চড়ে বসেছে, কম্পিউটার।
তখন কোলে, বইয়ের পরিবর্তে কোল-কম্পিউটার শোভা পেতে লাগলো। প্রমাদ গুনল বই প্রকাশক থেকে লেখক, বইয়ের পসার কামী মানুষজন।
যদিও মানুষের মননশীলতা, তার মনের খিদে কখনো লুপ্ত হয় না। আজোও হয়নি, তখনও হয় নি। শুধু নতুন বিয়ে করা বউয়ের মতন কম্পিউটার যেন রাতারাতি বই প্রেমী মানুষের কাছ থেকে বইয়ের জায়গাটা কেড়ে নিতে শুরু করেছিলো।
এর ফলে বই যেন ক্রমশ দুয়োরানী হয়ে যাচ্ছিলো আর সুয়োরানী হয়ে উঠছিল কম্পিউটার। বইয়ের প্রতি ক্রমহ্রাসমান এই মোহ, চিন্তার ভাজ ফেলেছিল সংশ্লিষ্ট মানুষ ও চিন্তাবিদদের কপালে। চিন্তান্বিত হয়েছিল ইউনেস্কো ও। তখনই উঠে আসে বিশ্ব বই দিবস পালন করার ভাবনা। অবশেষে, ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুসারে, ১৯৯৫ থেকে শুরু হয় বিশ্ব বই দিবস পালনের সূচনা। ইউনেস্কো এর জন্যে ২৩ শে এপ্রিলের দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। এই বিশেষ দিনটিতে মৃত্যু হয়েছিল বিশিষ্ট স্পেনীয় লেখক মিগেল দে থেরভান্তেসের। লেখক হিসেব মিগেল দে’র মৃত্যু দিনকেই বেছে নেওয়ার কারণ, স্পেনেরই আর এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ভিসেল ক্লাভেল আন্দ্রেস, যিনি মিগেল দে’র জন্মদিন অর্থাৎ ৭ ই অক্টোবর তারিখটিকে বই দিবস হিসেবে পালন করার কথা শুধু সর্বপ্রথম ভেবেছিলেন তাই নয় তিনি তার এই আইডিয়ার কথা জানিয়েছিলেন তখনকার স্পেনের রাজা আলফানসো ত্রয়োদশকে ও। সেটা সেই ১৯২৬ সালের কথা। ফল স্বরূপ রাজা এই মর্মে একটি ফরমান জারি করেছিলেন ১৯২৬ এর ৬ই জানুয়ারী তারিখে। পরে যদিও জন্মদিনের পরিবর্তে মিগেল দে’র মৃত্যুদিন ২৩ শে এপ্রিলের দিনটিই পালিত হতে থাকে বই দিবস হিসেবে।
কিন্তু এতে বই আর ই- বইয়ের মধ্যে লড়াইয়ের জায়গাটা কোথায়? আছে, যে বাঙালী বই আর বউকে একাসনে বসিয়ে বলে বেড়ায় বই আর বউ একবার হাতছাড়া হলে আর ফেরৎ আসে না সেখানে এই লড়াইটা যে জমে যাবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে এই লড়াইয়ের কথায় যাওয়ার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে এই ই-বইটা আসলে কি! এই প্রসঙ্গে একটা ছোট ঘটনার কথা বলি তাহলে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যাবে। কয়েকদিন আগে আমার মেয়ে আমাকে দুটো বইয়ের কথা বললো; একটা Clarie Douglas এর লেখা থ্রিলার উপন্যাস The Girls who Disappeared আর একটা Old Path White Clouds, Thich Nhat Hanh এর লেখা। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আমার মেয়ে। বললো বাবা এই দুটো বই তুমি কলেজ স্ট্রিট থেকে যদি পাও একটু এনে দাও আমাকে। মেয়ের এমন আব্দারে আমি যারপরনাই খুশী হয়ে পরের দিনই ছুটলাম কলেজ স্ট্রিটে। দুটো বইই সাড়া জাগানো বই। কিন্তু তাতে কি! কলেজ স্ট্রীটের বড় বড় দোকান গুলোর প্রায় সব কটাতে খোঁজ করা হয়ে গেল, কিন্তু না, কোথাও পেলাম না। সবশেষে দুশো বছরের পুরনো, কলেজ স্ট্রীটের সেই প্রাচীনতম বই দোকান – দাশগুপ্তা’য় গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, অন্তত কোনো একটি যদি পাওয়া যায়। না বই পাড়ার ‘বড় দোকান’ বলে পরিচিত দাশগুপ্তা’য় ও একই কথা। নেই। তবে দাশগুপ্তায় বলল, অর্ডার দিয়ে যান আনিয়ে দেবো। সে এক ঝামেলা, কবে পাওয়া যাবে কোনো নিশ্চয়তা নেই। অগত্যা, মেয়েকে বললাম অ্যামাজনে গিয়ে অর্ডার করলেই তো হয়, বাড়িতে পৌঁছে দেবে। যুগ পাল্টে গেছে, চাল নুন সাবান, ঔষধ থেকে মোবাইল সবই তো অনলাইনে অর্ডার করে পাওয়া যাচ্ছে, বই ও যদি এইভাবে ঘরে বসে পাওয়া যায় তাতে ক্ষতি কি। কিন্তু মেয়ে বললো বাবা, হাতে আর মাত্র কটা দিন আছে, ইলেভেনের রেজাল্ট বেরিয়ে গেলেই টুয়েলভের পড়া শুরু হয়ে যাবে, এর মধ্যে পেলে ভালো হত। পড়ে ফেলা যেত। তাহলে এক কাজ করা যায়, বই দুটোর ডিজিটাল সংস্করণ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়, সেটা একবার ট্রাই করে দেখতে পারিস। মেয়েকে বলতে, মেয়ে গালে হাত দিয়ে বললো তার মানে তুমি ই-বুকের কথা বলছো! অগত্যা।
আক্ষরিক অর্থে ই-বুকের অর্থ হোল ইলেকট্রনিক বা বৈদ্যুতিন বই। অর্থাৎ বইয়ের ডিজিটাল
প্রতিলিপি বা ভার্চুয়াল রূপ। প্রাথমিক
ভাবে বলতে গেলে, বই বলতে আমরা সচরাচর যা দেখতে অভ্যস্ত সেই মুদ্রিত অক্ষরে বোঝাই
একাধিক ছাপা কাগজ যুক্ত শক্ত মলাট বন্দী কোনো অস্তিত্ব কিন্তু নয় এটি। মানে, কায়া
যুক্ত বই নয়; বইয়ের অশরীরী বা শরীর মুক্ত ছায়। তাই আমার মতে
একে ই-বুক বা ই-বই না বলে ছায়া বই বলা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে আর একটি ছোট উদাহরণ
দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে, ধরুন শিশির মঞ্চে একদিন আপনি গেলেন নাটক দেখতে,
জসিমুদ্দিনের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ এর অবলম্বনে নাটক, প্রখ্যাত নাট্যদল
‘নয়ে নাটুয়া’ এর নাট্যরূপ দিয়েছে। যাওয়ার সময়, ধরুন আপনার ঠাকুমা – বয়স্ক, হাঁটাচলা
ঠিকঠাক করতে পারেন না কিন্তু নাটক দেখতে ভীষণ ভালোবাসেন, বললেন – নাটকটা দেখার খুব
ইচ্ছে ছিল রে ভাই। তা আপনি কি করলেন পুরো
নাটকটাকেই আপনার মোবাইল ফোনে তুলে নিয়ে এলেন ক্যামেরার সাহায্যে। বাড়িতে এসে ঠাকুমার সামনে মোবাইলটা রেখে বললেন, দেখো পুরো
নাটকটাই তুমি এতে দেখতে পাবে। তা আপনার ঠাকুমা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ই দেখলেন কিন্তু
যেটা দেখলেন সেটা মঞ্চস্থ নাটকের ছায়ারূপ বা ভার্চুয়াল সংস্করণ। যাকে ছায়ানাট্য
বলা যেতে পারে।যথারীতি আমার মেয়েও ‘The Girls who Disappeared’ বইটিকে তাড়াতাড়ি করে পরিচিত যে ই-বুকস্টোর গুলো রয়েছে যেমন – অ্যামাজন বা গুগল প্লে বুক ইত্যাদী তাতে অনলাইন অর্ডার প্লেস করে দিল এবং দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো বইটির ডিজিটাল সংস্করণ; কেনার জন্য ছুটতে হোল না কোনো বইয়ের দোকান, সরাসরি পৌঁছে গেল মোবাইলের স্ক্রিনে পড়ার জন্য।
শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, গত শতাব্দীর নয়ের দশকে কম্পিউটার আসার পরে বই পড়ার প্রতি অনুৎসাহ দেখা দিয়েছিল, যেটা ২০০০ সালে মোবাইল এসে পড়ার পরে বিশেষ করে সবার হাতে হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল আসার পরে তা যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিল সকল মাত্রা।। ১৯৮৬ থেকে ভারতে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হলেও সাধারণ জনগনের মধ্যে তার ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পড়ে, টিকে থাকার জন্য বই তার নতুন বিবর্তিত রূপ খোঁজার চেষ্টা করছিল। এবং বলাই বাহুল্য সেই খোঁজেরই অন্তিম প্রাপ্তি হোল এই ই-বুক। যদিও ই-বইয়ের আবিষ্কার হয়েছিল এরও অনেক কাল পূর্বে। মাইকেল হার্ট নামের এক মার্কিন নাগরিক, ১৯৭১ সালে প্রথম ই-বুক তৈরি করেন, সেটি ছিল আমেরিকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র’ নামের একটি ১৪৫৮ শব্দের ছাপা কাগজ। কিন্তু ইন্টারনেট বা আন্তরজাল ব্যবস্থা প্রচলিত না হওয়ায় তা কেবলমাত্র কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে ইন্টারনেট পরিষেবা টু জি থেকে থ্রী জি, ফোর জি করে যত এগিয়েছে, তাল মিলিয়ে বই পাড়ার বই প্রকাশকেরাও রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র সকলের বইয়েরই ই-সংস্করণ প্রকাশ করা শুরু করেছেন। কখনো বইয়ের হার্ড কপিকে স্ক্যান করে, কখনো বা টাইপ করে তৈরি করা পি ডি এফ বা অন্যান্য ফাইলের মাধ্যমে মোবাইল, আই প্যাড, কম্পিউটারের স্ক্রিনে পাঠযোগ্য ই-বুক হিসেবে সেগুলিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। যেখানে বইয়ের হার্ড কপি এবং সফট কপি দুটোই উপলব্ধ। অধুনা বৈদ্যুতিন স্ক্রিনে বই পড়ার চল অনেক বেড়েছে যার ফলে লেখকেরা তাঁদের লেখার শুধু ই-সংস্করণ বের করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন। তার মানে এর কোনো হার্ড কপি থাকছে না। বইয়ের ইতিহাস যদি দেখি তাহলে সে খ্রিষ্টজন্মেরও প্রায় তিনি হাজার পূর্বেকার কথা যখন থেকে নাকি লিখে রাখার চল শুরু হয়েছিল; বলাই বাহুল্য সেই লিখিত রূপকে সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই প্রবর্তিত হয়েছিল বইয়ের ধারনা। প্রসঙ্গত লেখার জন্য কখনো ব্যবহার করা হয়েছে কীলক, কখনো খাগড়ার নল, কখনো বাঁশের কঞ্চি আবার কখনো পাখির পালক। লেখার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল লিখিত শব্দের সেই আলেখ্যকে ধরে রাখার প্রক্রিয়াও; সেই লক্ষে কখনো ব্যবহৃত হয়েছে মাটির ফলক কখনো পাহাড়ের গা, তারপরে ক্রমান্বয়ে প্যাপিরাস, পারচমেন্টের হাত ধরে সব শেষে এসেছে পেপার। কিন্তু বইয়ের জগতে সর্বাধুনিক যে বিপ্লবটি সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল এক জার্মান পাথর পালিশ শিল্পী জোহেন গুটেনবার্গের কারণে। যিনি কাগজের পৃষ্ঠদেশে মুদ্রিত অক্ষরকে দিয়েছিলেন নতুন গতি, নতুন শক্তি। পঞ্চদশ শতকের পাঁচের দশকে (১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে) এসে গুটেনবার্গের তৈরি সেই ছাপাখানা, মুদ্রণের জগতে নিয়ে এসেছিল এক অভাবনীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ছাপাখানার পূর্বে প্রচলিত থাকা ব্লক প্রিন্টিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে গিয়ে মুদ্রণের ইতিহাসে প্রবর্তিত হয়েছিল নতুন যুগের। তাই ৪৮ তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার অন্তিম দিনে উপস্থিত রাজ্যের মন্ত্রী তথা বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু বললেন বিশ্বের সেরা উদ্ভাবন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ কিংবা আইজ্যাক নিউটন কৃত অভিকর্ষ বলের খোঁজ পাওয়া নয়; গুটেনবার্গের দ্বারা ছাপাখানা আবিষ্কারই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রকৃত যুগান্তর আনতে পেরেছিল। কারণ সেই প্রথম, ছাপাখানার দৌলতে হাতে লেখা পুঁথির জায়গায় ছাপার অক্ষরে সংরক্ষিত হয়েছিল মানুষের ভাবনার জগতের শ্রেষ্ঠতম উপাদানগুলি; বইয়ের মাধ্যমে তা ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের ঘরে ঘরে। এবং বলাই বাহুল্য বইয়ের এই জয়যাত্রা শীঘ্রই পৌঁছে গিয়েছিল পড়ার ঘর থেকে শোবার ঘর পর্যন্ত। যে কারণে প্রখ্যাত আর্জেন্টিনীয় গ্রন্থাগারিক তথা সাহিত্যিক জর্জ হোর্হে লুইস বোর্হেস একবার বলেছিলেন, বই পাশে না থাকলে তাঁর ঘুম আসে না। “I cannot sleep unless I am surrounded by books”।
যবে থেকে মানুষ বই ছেড়ে হাতে হাতে মোবাইল ধরা শুরু করলো তবে থেকে বই ঢুকে পড়লো মোবাইল, আই প্যাড বা ই-রিডার ইত্যাদির ডিজিটাল স্ক্রিনে। যথারীতি বইয়ের হার্ড কপির জায়গায় এল সফট কপি , শরীরী বইয়ের প্রকাশকেরা অশররীরী বই প্রকাশ করতে লাগলেন। বইয়ের কায়া কপি বিক্রি করা দোকানদারেরা ওয়েব পেজ বানিয়ে অনলাইন বইয়ের ছায়া কপি বিক্রির স্টোর খুলে বসলেন। এমনকি বিশ্ব বই দিবসে, বই হিসেবে ই-বইয়ের অন্তর্ভুক্তি বাদ রইলো না। তাহলে লড়াইটা কোথায়? বই পড়া নিয়ে তো কথা। লড়াইটা আসলে বইকে বউ ভাবতে না পারার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। যে বই একান্তই তার নিজস্ব ছিল, তার গন্ধ, তার রূপ, তার প্রতি পৃষ্ঠায় থাকা রসাস্বাদনের অধিকার, তা ছিল তার একান্তই নিজের; যে বইয়ের খোলা বুকে মুখ গুঁজে মাঝের বন্ধন বিভাজিকা কে বক্ষ বিভাজিকা ভাবার যে ঐকান্তকিতা তাতে একটা অধিকার বোধ ছিল এবং সর্বোপরি তাকে চেটে পুটে নিংড়ে উপভোগ করার একটা ব্যাপার ছিল যা এককথায় এই ই-বইয়ের মধ্যে অমিল। সবথেকে বইয়ের ভাঁজে পাথরকুচি পাতা রেখে দেওয়ার আনন্দ এবং সেই পাতা থেকে গজিয়ে যাওয়া শেকড় যেন নিজের অস্তিত্বের কথা জাহির করাতো। ই-বইয়ে সেই স্বাদ পূরণের সুযোগ কোথায়। বউ পুরনো হলে কি তাকে অস্বীকার করা যায়; ঠিক সেই রকম, বইয়ের পাতা যতই হলুদ, পাণ্ডুর হয়ে যাক না কেন, তার বাঁধন যতই আলগা হয়ে যাক না কেন, তার পাতা ইঁদুরে উই পোকায় যতই খেয়ে যাক না কেন তাকে সাদরে রেখে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের মূল্যবোধ জড়িয়ে থাকে, যার সঙ্গে ই-বইয়ের নেই কোনো লেনাদেনা। দীর্ঘ সফর যাত্রায় কিংবা অবসরে বই সঙ্গী থাকলে, বউ না থাকলেও চলে। বড় নিবিড় সেই সম্পর্ক, ই-বইয়ের ক্ষেত্রে সেই সম্পর্ক কখনোই গড়ে উঠতে পারে না। কারণ ই-বই কিনে পড়ার অধিকার জন্মায় ঠিকই কিন্তু স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত সার্ভারের মধ্যে ভেসে থাকা বইয়ের ই-সংস্করণ তা নিতান্তই বারোয়ারি, যে তাকে কিনবে তাকে পড়ার অধিকার পাবে কিন্তু তাকে নিজের করে পাওয়ার অধিকার পাওয়া যাবে না। জর্জ হোর্হে লুইস বোর্হেস যিনি একদা বলেছিলেন, “জীবনে, যাপনে এমনকি জনশূন্য নিঃসঙ্গ দ্বীপেও যদি কেউ সত্যিকারের সঙ্গী থাকে সে হোল বই, বই আর বই” তিনি কি ই-বইয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা বলতেন। মনে হয় না। বিশেষ করে দীর্ঘক্ষণ ই-বই পড়ার ক্ষেত্রে যে চোখের ওপর চাপ পড়ে তা নিয়ে এখনই নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। উল্টে বই পড়া কোনো চাপের তো নয়ই বরং একরাশ শান্তির ঘুম ডেকে আনে চোখে। সবশেষে দেখে নেবো পরিসংখ্যান কি বলছে; হিসেব সংক্রান্ত যে তথ্যটি না দিলে লেখাটি সম্পূর্ণ হবে না, সেটা হোল - ই বইয়ের গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে একথা যেমন ঠিক তেমনি বই কেনার পরিমান ও কিন্তু বেড়েছে আগের তুলনায় বেশী। ৪৮ তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় সেই হিসেব দিলেন, বইমেলার পরিচালক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলারস গিলডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু শেখর দে; শ্রী দে গর্বের সাথে জানালেন ১২ দিন ধরে চলা এই বইমেলায় প্রায় ২৭ লক্ষ লোক এসেছেন এবং প্রায় ২৫ কোটি টাকার বই কেনাকাটা করেছেন, যা গতবারের থেকে দু কোটি বেশী। অর্থাৎ বইয়ের চাহিদা কমছে তো না, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চলুন হিসেব দেওয়া হয়ে গেল, এবার বই বনাম ই-বইয়ের লড়াইয়ে কে জিতলো তা ঠিক করুন আপনারাই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন