সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ক্রিয়েটিভ ক্রীতদাস!

দিন তো মাত্র ২৪ টি ঘন্টার। অথচ কত কাজ বাকি, এমন হা হুতাশ করার লোকের সংখ্যা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। ২৪ এর জায়গায়, দিন তো আর ২৬ ঘন্টার হবে না , এ কথা বলার মধ্যে কিন্তু আশ্চর্য রকমের একটা সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি ভাব রয়েছে। তোমরা প্রলেতারিয়েত, ছোটলোক দৈনিক আট ঘন্টার বেশী কাজ করবো না - ও সব কথা তোমাদের মুখেই সাজে। এই নিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই টড়াই ও সব বড্ড ব্যাকডেটেড। সোজা কথা আমাদের চাই আরোও বেশী সময়। স্বামী বিবেকানন্দ না কে যেন বলেছিলেন, মানুষ জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। এই সময়ে স্বামীজী বেঁচে থাকলে নিশ্চিত ভাবে তাঁর বয়ান বদলে ফেলতেন। আরে ঘুমোবার সময় কোথায়?


ও সব ছোটবেলাকার কথা মনে করিয়ে লাভ কিছু হবে না। দশ পয়সার লজেন্স চুষেই হেব্বি মজা পেয়েছি তখন, কাগজের ঠোঙায় কুড়ি পয়সার ছোলা ভাজা খেতে খেতে মনে হয়েছে ,ওহ্ এর চেয়ে আর ভালো কিছু হবেই না। তখন গন্ডা গন্ডা বাচ্চা জন্ম নিতো মানুষের পেটে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের আইডিয়া - কি দরকার! ভগবান জন্ম দেন, তার অন্ন ও দিয়ে পাঠান। লে হালুয়া। কার কি করার আছে। জমিতে একবারই চাষ হতো, আষাড় মাসের শুরুর দিকে বীজতলা ফেলা আর তারপরে রুয়ে দেওয়া, ব্যাস্। তারপরে ধানকাটার আগে অবধি আর কোনো কাজ নেই। বটগাছের ছায়া থেকে দু চোখ ভরে লকলকে ধান ক্ষেতের শোভা দেখো যতখুশি। চন্ডি তলা, শীতলা মন্ডপ তো রয়েইছে পরচর্চার জন্যে। থেলো হুকোয় টান দিতে দিতে কত যে সময় গেছে, তারপরেও সময় বেশী হয়ে উপচে উপচে পড়তো একেবারে। বিভূতি বাবু ওরকম অভাবী সংসারের কথা লিখলেন 'পথের পাঁচালী' তে, ভাবুন তো সেই অভাব দূর করার কিন্তু কোনো প্রচেষ্টার কথা সেভাবে তাঁকে ভাবায় নি। আসলে অভাব ছিল কিন্তু মনের মধ্যে সেই অভাব মেটানোর সুতীব্র আকাঙ্খা ছিল না, তাকে অবৈধ সন্তানের মতোই ফেলে আসা হতো নির্জন কোনো দূর্গম ভাগাড়ে। অভাব সয়ে গিয়েছিল। তখন মানুষ অভাবের দাসত্ব করতে রাজী ছিল অনায়াসে, কিন্তু অবসরের সেই সুখযাপনে কোনো খামতি ছিল না।
পেটের দায়ে আট ঘন্টাই যথেষ্ট। কিন্তু আকাঙ্খা, সেই আকাশচুম্বী আকাঙ্খার সামনে মানুষ আজ বড় অসহায়। কাজের সময়ের মা বাপ সব্বাই প্রয়াত হয়েছেন এখন। আরোও একটু সময় পেলে আরোও বেশী উপার্জন, আরোও বেশী পাওয়া যাবে সুখ সাধনের দুর্মূল্য গ্যাজেটস, আরোও বেশী চোব্য চোষ্য লেহ্য পেয, আরোও বেশী উচ্ছিষ্ট, আরোও বেশী উদযাপনী উৎসবের শুভ মহরৎ। অভাব এখনোও রয়েছে! না হলে এত চাই এর ভিড় কেন চারিধারে। দিন রাত - আরোও চাই, আরোও চাই, আরোও লাইকস চাই আরোও কমেন্টস চাই, চাই আরোও শেয়ার। নিত্য নতুন টার্গেট চলে আসছে জীবনে, তাকে অ্যচিভ করতেই হবে যে। এই কখনো পূর্ণ না হওয়া উদগ্র আকাঙ্খার কাছে হার মানছে দৈনিক আট ঘন্টার কাজের কনসেপ্ট।
সেই যে বিড়ি বাঁধছে কোলে কুলো রেখে মহিলাটি, তিনিও জানেন আরোও কয়েকশো বিড়ি বেশী বাঁধলে আরোও কিছু টাকা আসতো। আরোও বেশী বানাও, আরোও বেশী কামাও, আরোও বেশী খাও আরোও বেশী পিও আরোও বেশী জিও। জিনা তো হ্যায় না।
বর্তমানে, নতুন ক্রীতদাস শ্রেনী তৈরি হয়েছে সমাজে। তা হোল ক্রিয়েটিভ ক্রীতদাস। চির অতৃপ্ত আকাঙ্খার কাজে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকা এই ক্রীতদাসেরা আরোও সময় চায় দিনের।
কাজের সময় বাড়ানোর দাবী উঠছে, এবং ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ছে ছোঁয়াচে সংক্রমণের মতো। দ্রুত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...