Happy birthday, রবি ঠাকুর! কেক কাটা চলছে, চকলেট রঙের গোল পিষ্টক পিন্ডের বুক চিরে তুলে আনা ত্রিভুজাকৃতি এক টুকরো কেক, অনিন্দ্যর হাতে ধরা সবুজ হাতলওয়ালা ছুরির অগ্রভাগে কিঞ্চিৎ বেসামাল লাগছে। পাশেই সিফন সুতোর ফুল তোলা, ধবধবে সাদা জমিনের টেবিল ক্লথ ঢাকা দেওয়া চেয়ারে, তির্যক হেলান দিয়ে বসানো হয়েছে পুষ্প মাল্য শোভিত কবিগুরুর, কাঠের ফ্রেম বন্দী ফটোকে। আগে, রবি ঠাকুরের মুখে ছোঁয়াও; তারপরে বাকিরা। হাততালি, হৈ হুল্লোড়, মোমবাতি জ্বালানো, ও হ্যাঁ - ব্লু টুথ দিয়ে, ইউ টিউব থেকে খুঁজে খুঁজে বার করা কপিরাইট মুক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বাজছে ছোট্ট সাউন্ড সিস্টেমে।
এখন এটাই চল। শিব ঠাকুর থেকে শুরু করে সরস্বতী, সব দেব দেবীরাই এখন যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে শিখে গেছেন। ইউ টিউব নির্গত মন্ত্র ধ্বনিতেই তাঁদের পূজা সম্পন্ন হচ্ছে আজকাল। রবি ঠাকুর তো এই সেদিনকার, ১৮৬১; অনেক আধুনিক! রবীন্দ্রজয়ন্তীর শুভদিনে, ছেলে মেয়েদের হিজিবিজি গলায় কবিতা আবৃত্তি, হারমোনিয়াম নিয়ে 'তুমি রবে নীরবে..' বলে গান করার চল, সে সব গত শতাব্দীর কথা। ফাল্তু সেন্টিমেন্ট। পাড়ার ছেলে মেয়েরা অন্তত এক মাস আগে থেকে 'ডাকঘর' নাটকের মহড়া শুরু করে দিতো। ওসব এখন প্রাগৈতিহাসিক রূপকথা। তখন তারিখটা ছিল পঁচিশে বৈশাখ। এখন নাইনথ্ মে। ছুটির দিন। খ্রীষ্ট ভক্তদের কাছে যেমন ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ, বাঙালীর কাছেও তেমনি একটা পঁচিশ তারিখ ছিল, সেটা বৈশাখ মাসের। এখনোও আছে, তবে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে তা অনেক আগেই নির্বাসিত, সেটা এখন আগাপাশ্তলা ইংরেজি তারিখে ভর্তি। এখন ২৫শে বৈশাখ খুঁজতে গেলে বেনীমাধব শীল বা মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকা দেখতে হবে। পাড়ার মোড়ে, স্বাধীনতা দিবস থেকে শুরু করে ২৬শে জানুয়ারি, নেতাজী থেকে স্বামীজীর সকলেরই জন্মদিন পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথই বা বাদ পড়েন কেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করে অনেকদিন কিছু বিটকেল আঁতেল রবি ঠাকুরকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এখন রবীন্দ্রনাথ সার্বজনীন, দূর্গা পূজার মতোই বারোয়ারী। সব অনুষ্ঠানেই যেমন হয়, পূজা শেষ তো চন্ডী পাঠ শেষ। তারপরে শুরু হবে চটুল হিন্দি গান আর তার সঙ্গে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে নাচন কোদন। আরে ভাই রবীন্দ্রনাথকে কতদিন এইভাবে আটকে রাখবে! তর্ক বেঁধে যায় রবীন্দ্র বাগীশ মনোজের সঙ্গে। জানিস, অমিতাভের 'ইয়ারানা' সিনেমায় ওই যে, 'ছুঁ কর মেরে মন কো...' গানটা আসলে গুরুদেবের - 'তোমার হল শুরু, আমার হল সারা' থেকে নেওয়া। তারপরে, 'অভিমান' ছবির সেই সুপারহিট গান- 'তেরে মেরে মিলন কে এ ...'! থাক থাক, ও সব জানা আছে - মনোজ কোনোরকম গণেশ কে থামিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালায়। বড় রবীন্দ্র ভক্ত হয়েছে। দাঁড়িয়ে শুনছিল টনি। এবার মুখ খোলে। ঐশ্বর্য রাইয়ের 'চোখের বালি' দেখেনি মনে হয় মালটা। ফিদা হয়ে যেতো। সত্যি গুরু যা একটা ছেড়ে গেছে মাইরি, সাধে কি লোকে গুরুদেব বলে! আরে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে না ফেসবুকে রিল বানিয়ে ছাড়তো দেখতিস, কেমন। পুরো ভাইরাল হয়ে যেতো। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, ছবি আঁকা, গুরু যেখানে হাত দিয়েছে পুরো তুলে ছক্কা, মাঠের বাইরে। আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ সিনেমা করেছেন? সেটা বলতে পারবো না ভাই। ওই তো মাস্টারমশাই যাচ্ছেন। ও জয়ন্ত দা, শুনুন না! আজকের রবীন্দ্রজয়ন্তী বলে কথা, একটু ছাড়ুন না ভেতরের মালপত্র । কি বলছিস বল। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ সিনেমা করেছেন জানো? মুচকি হেঁসে, টিউশন মাস্টার জয়ন্ত বলে, হাঁ করেছেন। । অ্যাঁ... তাই? ১৯৩০ সালে 'নটীর পূজা ' নামে একটি সিনেমা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরিচালক ছিলেন। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় পর্যন্ত করেছেন। দেখলি তো! শোন, বলি - রবীন্দ্রনাথের জন্য না বিদেশের সুন্দরী মেয়েগুলো পাগল হয়ে যেত। শুনিস নি কিশোর কুমারের সেই গান, 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী..' গুরুদেবের এলেম ছিল বলতে হয়। মাস্টার জয়ন্ত আর দাঁড়ায় না। এর পরে আরোও কি শুনতে হবে কে জানে!
জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন