সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিয়ালদহে সৈকত ছত্র!

সারি সারি রঙীন ছাতা, হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোনো সমুদ্র সৈকতে এসে পড়েছি। যেভাবে, নামী সি বিচ গুলোয় বড় বড় রঙিন ক্যানোপি (ছাতার ছাউনি) বিশিষ্ট ছাতার তাঁবু গাড়া থাকে, তাদের কোনোটার নীচে হয়তো শাঁসওয়ালা ডাব বিক্রি হচ্ছে, কোনোটায় হয়তো চটপটি আবার কোনোটায় পাঁপড়ি চাট। 

সাধারণত, পলিয়েস্টার কাপড়ে তৈরি, এই সকল রঙচঙে ছাতার ছাউনির নীচে অনেক সময় দোকান ছাড়াও, সুদৃশ্য বেতের চেয়ার পাতা থাকতে দেখা যায়, অনেকটা বাড়ির উঠোনের মতো। যে কারণে, হোটেল কিংবা রেস্তরাঁর লাউঞ্জে অথবা কোনো পান ভোজের আসরে, মুক্ত আকাশের নীচে এই ধরনের ছাতার ব্যবহার প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে। যে জন্যে এই ধরনের ছাতাগুলোকে প্যাটিও ছাতাও বলা হয়ে থাকে। স্প্যানিশ ভাষায় প্যাটিও কথার অর্থ বারান্দা বা উঠোন। তবে আমি এই ধরনের ছাতাকে প্যাটিও না বলে সৈকত ছত্র বলবো। কারণ সৈকতের সঙ্গে এই ধরনের ছাতার সম্পর্ক প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। যেখানে এইরকম প্যাটিও ছত্র তলে বসে চেয়ারাসীন পর্যটকদের প্রায়শই চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দূরের উত্তাল ঊর্মিমালায় ভাসমান নৌকা কিংবা অন্য কোনো জলযানকে, নিবিষ্ট দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়। তবে এটি দীঘা বা মন্দারমনির মতো কোনো সমুদ্র তীরবর্তি বেলাভূমি নয়, এটি একটি রেলওয়ে টার্মিনাল, যেটি কিনা দেশের অন্যতম ব্যস্ত টার্মিনাল হিসেবে পরিচিত সেই শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে থাকা উন্মুক্ত পরিসরে সম্প্রতি এমন সারি বদ্ধ রঙীন ছাতার ছাউনি দেখার পরে এবং এর সঙ্গে সমুদ্র সৈকতের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে যারপরনাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।  

তবে শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরেটা তো এমনিই একটা সমুদ্রের মতো। জন সমুদ্র। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। প্রতিনিয়ত ব্যস্ত মানুষের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে আবার ফিরেও যাচ্ছে যথারীতি। রঙীন ছাতাগুলি থেকে প্রতি মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে রেডিমেড জামাকাপড়, জুতো বিক্রির লোভনীয় দর ঘোষণার হাঁক ডাক। "একশো করে" দুটো শার্ট কিংবা দুশোয় নামী কোম্পানির জুতো। চাকা লাগানো ঠেলায় ঢেলে রাখা আছে জুতো, জামা কিংবা জিন্সের প্যান্ট - পছন্দ মতো বেছে নিতে পারলেই হলো। ঠেলার মাঝখানে, লম্বালম্বি দাঁড় করানো নলাকৃতি, অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাটের ওপর মেলে রাখা ছাতার ধার থেকে আবার ঝুলছে বৃত্তাকার ঝালর। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই ঝালরকে, পরিভাষায় ছাতার ক্যান্টিলিভার বলা হয়। ছাতা যখন আছে, জল ছত্র থাকবে না তাই বা কি করে হয়। পুদিনা পাতা দিয়ে কিংবা লেবু চিনির বরফ মেশানো শরবতের বিস্তর চাহিদা এখানে। ঠেলার ওপরে লাল শালু দিয়ে মোড়া জলের পাত্র, সামনে লেবু আর পুদিনা পাতার তরতাজা প্রদর্শন, রোদে পোড়া সময়ে, প্রায় অমৃত পানের তৃপ্তিতে, হিমেল শরবত পূর্ণ প্লাস্টিকের গেলাসে চুমুক দেন এখানে ঘর্মাক্ত মানুষজন। এখানেই শেষ নয়। রঙীন ছাতার তলাতেই বসে ইয়ার ফোন কিংবা গরিলা গ্লাস বিক্রির পসরা। কোনোটায় হয়তো বিক্রি হচ্ছে নানা কিসিমের বেল্ট, সঙ্গে নানাধরনের মানিব্যাগ ও পাওয়া যাচ্ছে, ঠেলার ওপরে ডাই করা।

চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মানুষজন কে। চলে দরাদরি, নেওয়া না নেওয়ার কথা কথকতা। প্রিয়জনের জন্য কোনো পছন্দের জিনিসটি কেনার পরে যে মুগ্ধতার দীপ্তি খেলে যায় ক্রেতার চোখে মুখে তা এককথায় দেখার মতো।      কেনাকাটা, নেড়ে চেড়ে দেখা, কেতাবী কথা - এ সব কিছুর নীরব সাক্ষী থাকে এই রঙীন ছাতা গুলি। বিকিকিনির নয়া রুপকথা। ঘুরে ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালারা হয়তো ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছে এইভাবে রঙীন ছাতা গুলোর নীচে। দাঁড়াতে না দিলে চাকা তো রয়েইছে।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...