সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

খবরের রূপকথা ও নিল দেশাই!

রাজনৈতিক বাইটসের ভিড়ে, প্রায়শই আসল খবর হারিয়ে যায় নিত্যদিনের কচকচানির মত খুনধর্ষণ, চুরি রাহাজানির খবর আর তেমন করে আমাদের নাড়া দেয় না। খবরের দুনিয়ায় এখন, অপরাধ মনস্কতার রমরমা বাজার; যা সাধারণ মানুষদের এক একজনকে প্রায় অপরাধ বিজ্ঞানীতে পরিনত করেছে। 
রাজনৈতিক নেতাদের নিত্য চুলোচুলি, অরুচিকর বিবৃতির লড়াই কলতলার তরজা সর্বস্ব সংবাদের ঠেলায় ভালো খবরগুলোর জায়গা - হয় ভেতরের পাতায় কোনো অজ্ঞাতপাঠ নিউজের মত চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে নয় গুরুত্বহীনের তকমা পেয়ে, সম্পূর্ণ ভাবে হাপিস হয়ে যাচ্ছে খবরের দুনিয়া থেকে। এখন খবর কাগজ খুললে, নির্মলা মিশ্রের সেই বহু পরিচিত গানের কথা মনে চলে আসে। 'এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না, যাতে মুক্তো আছে।
এখন প্রশ্ন, সত্যিই কি মুক্তো নেইনাকি মুক্তো খোঁজায় আর তেমন উৎসাহ নেই আমাদের? উত্তর অন্বেষণ করতে গিয়ে দেখলামমুক্তো নেই কথাটি একেবারেই ঠিক নয়। বরং আমরাই এগুলিকে তথাকথিত পাতা ভরানো খবর বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু যেটা বলার কথা সেটা হল, সংবাদ পত্রের এই তথাকথিত 'না চলা খবর গুলোর মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে থাকে সেই স্পার্ক যা মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তাকে দিতে পারে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছা শক্তি। উদ্দীপনার মহৎ শিখা হাতে, অন্ধকার গহ্বরেও জ্বালিয়ে দিতে পারে রূপকথার মহার্ঘ আলোকশিখা।
বাস্তবের জল সেঁচা এই ধরনের খবরগুলি কিন্তু রূপকথার গল্পের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। এই সূত্রে আমার মাথায় একটা ভাবনা আসে, যদি এই ধরনের খবরগুলোকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে, বেশ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয় তো কেমন হয়। সেই মতো, একটা শিরোনাম ঠিক করি খবরের রূপকথা চেষ্টা করবো, যখন যেমন পাবো, এই ধরনের নিউজগুলোকে গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করার।


নিল দেশাই! 
এবার ভূমিকা ছেড়ে বরং খবরের গল্পে ঢোকা যাক। আজকের খবরের যিনি নায়ক, তিনি গুজরাটের নাভসারি জেলার তালোধ গ্রামের বাসিন্দা। নাম নিল দেশাই। ৫২ বছর বয়সী এই মানুষটি এখনও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেননি। কিন্তু সে তো অনেকেই আছেন এইরকম। এটর মধ্যে তো কোনো নতুনত্ব নেই। কিন্তু এর মধ্যে যেটা চমকের ব্যাপার সেটা হল, ইতিমধ্যে এই নিল দেশাই মহাশয়, ২৬ বার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। সবশেষ পাওয়া খবর অনুসারে, এবারে তিনি ২৭ বারের জন্য পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন
কিন্তু এর থেকেও বড় টুইস্টটা এলো, যখন জানলাম - তিনি বারংবার উচ্চমাধ্যমিকে বিফল হওয়া সত্ত্বেও কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। ৯/৭/২০২৫ তারিখে প্রকাশিত, টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার সকালের এডিশনে, শ্রী বিশাল পাটাডিয়ার করা এই খবর পড়ে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হোল এই অসাধ্য সাধন?
সেটা বলার আগে, এই ভদ্রলোকের আরও কিছু কীর্তির কথা বলে নিলে মন্দ হয় না। রূপকথার মতো তাঁর জীবন জার্নিতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরোও একটি গৌরবের পালক। তাঁর গ্রামে, সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি সরপঞ্চ নির্বাচিত হয়েছেন। দল মত নির্বিশেষে গ্রামের ৮০% ভোটার তাঁকে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিশ্ব উষ্ণায়ণের বিপদাশঙ্কা নিয়েও তিনি যথেষ্ট ভাবিত। কিন্তু তিনি তাঁর ভাবনাকে শুধুমাত্র ড্রয়িং রুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রীতিমত মাঠে নেমে বন সৃজনে ব্রতী হয়েছেন তিনি। বিখ্যাত জাপানি উদ্ভিদবিদ Akira Miyawaki ' উদ্ভাবিত অতি অল্প জায়গার মধ্যেও বিভিন্ন দেশী প্রজাতির গাছপালা রোপণ করে, অল্প সময়ের মধ্যে বনাঞ্চল গড়ে তোলার পদ্ধতি অবলম্বন করে, তিনি নাভসারিত অন্তত সাত সাতটি বনের জন্ম দিয়েছেন। হরিয়ালী গ্রুপ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠা করে, সেই সংস্থার ব্যানারে, তিনি একটি দেড়শো বছরের প্রাচীন কুয়োর সংস্কার করেছেন। শুধু তাই নয় তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা নাভসারিতে আরোও ২০টি কুয়ো খননের, যাতে বর্ষার জল ধরে, তাকে ভবিষ্যতে চাষের কাজে লাগানো যায়। 
এবারে বলবো, তাঁর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার অভূতপূর্ব গল্পকথা, যা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা দীর্ণ নেতিয়ে পড়া জীবন যাপনকে দিতে পারে পুনুরুজ্জীবনের নতুন সাহস শক্তি।
নিল দেশাই, ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। দুবছর পরে, ১৯৯১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতে যথারীতি তিনি পাশ করতে পারেন নি। এখানেই তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, জীবনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা নিল দেশাইয়ের ভবিষ্যতের দৌড়। ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ ড্রপ আউট ছাত্র ছাত্রীদের মত উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য হওয়ার পরে থামিয়ে দিতে পারতেন তাঁর পড়াশোনার পর্ব। ঢুকে যেতে পারতেন কোনো কল কারখানায়নাম লেখাতে পারতেন কোনো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু নিল দেশাই তেমন বান্দা ছিলেন না। সহজে থামবার পাত্র, তিনি নন মোটেই। তাই মাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিত্তিতেই তিনি ভর্তি হয়ে যান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিপ্লোমা কোর্সে। ১৯৯৬ পাশ করেন, এবং টুকটাক কাজ করেন। কিন্তু তাতে তাঁর উচ্চাশা সম্পৃক্ত হতে পারছিল না। ইতিমধ্যে, ২০০৫ সালে গুজরাট সরকার, ডিপ্লোমাধারীদের ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দিলে, নিল দেশাই ভি. এস প্যাটেল কলেজ থেকে, জৈব রসায়নবিদ্যায় পরপর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। এবং সবশেষে, ২০১৮ সালে, গুজরাটের বারাদোলি স্থিত উকা তারাশাদিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে লাভ করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। তার গবেষণার বিষয় ছিল, বিভিন্ন অ্যাসিডিয সংস্পর্শে আসা স্বল্প কার্বন যুক্ত স্টিলের ক্ষয় রুখতে, কার্যকরী পরিবেশ বান্ধব প্রতিরোধক উদ্ভাবন। 
সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক বোধহয় এইভাবেই প্রবল ইচ্ছা শক্তি দিয়ে ভগবান মেরামত করে দেন। কিন্তু এত সবের পরেও, ডক্টরেট নিল দেশাই কি এবারে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে পারবেন? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...