রাজনৈতিক বাইটসের ভিড়ে, প্রায়শই আসল খবর হারিয়ে যায়। নিত্যদিনের কচকচানির মত খুন, ধর্ষণ, চুরি রাহাজানির খবর আর তেমন করে আমাদের নাড়া দেয় না। খবরের দুনিয়ায় এখন, অপরাধ মনস্কতার রমরমা বাজার; যা সাধারণ মানুষদের এক একজনকে প্রায় অপরাধ বিজ্ঞানীতে পরিনত করেছে।
রাজনৈতিক নেতাদের নিত্য চুলোচুলি, অরুচিকর বিবৃতির লড়াই ও কলতলার তরজা সর্বস্ব সংবাদের ঠেলায় ভালো খবরগুলোর জায়গা - হয় ভেতরের পাতায় কোনো অজ্ঞাতপাঠ নিউজের মত চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে নয় গুরুত্বহীনের তকমা পেয়ে, সম্পূর্ণ ভাবে হাপিস হয়ে যাচ্ছে খবরের দুনিয়া থেকে। এখন খবর কাগজ খুললে, নির্মলা মিশ্রের সেই বহু পরিচিত গানের কথা মনে চলে আসে। 'এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না, যাতে মুক্তো আছে।'
এখন প্রশ্ন, সত্যিই কি মুক্তো নেই, নাকি মুক্তো খোঁজায় আর তেমন উৎসাহ নেই আমাদের? উত্তর অন্বেষণ করতে গিয়ে দেখলাম, মুক্তো নেই কথাটি একেবারেই ঠিক নয়। বরং আমরাই এগুলিকে তথাকথিত পাতা ভরানো খবর বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু যেটা বলার কথা সেটা হল, সংবাদ পত্রের এই তথাকথিত 'না চলা’ খবর গুলোর মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে থাকে সেই স্পার্ক যা মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তাকে দিতে পারে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছা শক্তি। উদ্দীপনার মহৎ শিখা হাতে, অন্ধকার গহ্বরেও জ্বালিয়ে দিতে পারে রূপকথার মহার্ঘ আলোকশিখা।
বাস্তবের জল সেঁচা এই ধরনের খবরগুলি কিন্তু রূপকথার গল্পের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। এই সূত্রে আমার মাথায় একটা ভাবনা আসে, যদি এই ধরনের খবরগুলোকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে, বেশ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয় তো কেমন হয়। সেই মতো, একটা শিরোনাম ঠিক করি ‘খবরের রূপকথা’। চেষ্টা করবো, যখন যেমন পাবো, এই ধরনের নিউজগুলোকে গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করার।
কিন্তু এর থেকেও বড় টুইস্টটা এলো, যখন জানলাম - তিনি বারংবার উচ্চমাধ্যমিকে বিফল হওয়া সত্ত্বেও কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। ৯/৭/২০২৫ তারিখে প্রকাশিত, টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার সকালের এডিশনে, শ্রী বিশাল পাটাডিয়ার করা এই খবর পড়ে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হোল এই অসাধ্য সাধন?
সেটা বলার আগে, এই ভদ্রলোকের আরও কিছু কীর্তির কথা বলে নিলে মন্দ হয় না। রূপকথার মতো তাঁর জীবন জার্নিতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরোও একটি গৌরবের পালক। তাঁর গ্রামে, সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি সরপঞ্চ নির্বাচিত হয়েছেন। দল মত নির্বিশেষে গ্রামের ৮০% ভোটার তাঁকে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিশ্ব উষ্ণায়ণের বিপদাশঙ্কা নিয়েও তিনি যথেষ্ট ভাবিত। কিন্তু তিনি তাঁর ভাবনাকে শুধুমাত্র ড্রয়িং রুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রীতিমত মাঠে নেমে বন সৃজনে ব্রতী হয়েছেন তিনি। বিখ্যাত জাপানি উদ্ভিদবিদ Akira Miyawaki 'র উদ্ভাবিত অতি অল্প জায়গার মধ্যেও বিভিন্ন দেশী প্রজাতির গাছপালা রোপণ করে, অল্প সময়ের মধ্যে বনাঞ্চল গড়ে তোলার পদ্ধতি অবলম্বন করে, তিনি নাভসারিত অন্তত সাত সাতটি বনের জন্ম দিয়েছেন। হরিয়ালী গ্রুপ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠা করে, সেই সংস্থার ব্যানারে, তিনি একটি দেড়শো বছরের প্রাচীন কুয়োর সংস্কার করেছেন। শুধু তাই নয় তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা নাভসারিতে আরোও ২০টি কুয়ো খননের, যাতে বর্ষার জল ধরে, তাকে ভবিষ্যতে চাষের কাজে লাগানো যায়।
এবারে বলবো, তাঁর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার অভূতপূর্ব গল্পকথা, যা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা দীর্ণ নেতিয়ে পড়া জীবন যাপনকে দিতে পারে পুনুরুজ্জীবনের নতুন সাহস ও শক্তি।
নিল দেশাই, ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। দুবছর পরে, ১৯৯১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতে যথারীতি তিনি পাশ করতে পারেন নি। এখানেই তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, জীবনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা নিল দেশাইয়ের ভবিষ্যতের দৌড়। ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ ড্রপ আউট ছাত্র ছাত্রীদের মত উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য হওয়ার পরে থামিয়ে দিতে পারতেন তাঁর পড়াশোনার পর্ব। ঢুকে যেতে পারতেন কোনো কল কারখানায়, নাম লেখাতে পারতেন কোনো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু নিল দেশাই তেমন বান্দা ছিলেন না। সহজে থামবার পাত্র, তিনি নন মোটেই। তাই মাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিত্তিতেই তিনি ভর্তি হয়ে যান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিপ্লোমা কোর্সে। ১৯৯৬ এ পাশ করেন, এবং টুকটাক কাজ ও করেন। কিন্তু তাতে তাঁর উচ্চাশা সম্পৃক্ত হতে পারছিল না। ইতিমধ্যে, ২০০৫ সালে গুজরাট সরকার, ডিপ্লোমাধারীদের ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দিলে, নিল দেশাই ভি. এস প্যাটেল কলেজ থেকে, জৈব রসায়নবিদ্যায় পরপর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। এবং সবশেষে, ২০১৮ সালে, গুজরাটের বারাদোলি স্থিত উকা তারাশাদিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে লাভ করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। তার গবেষণার বিষয় ছিল, বিভিন্ন অ্যাসিডিয সংস্পর্শে আসা স্বল্প কার্বন যুক্ত স্টিলের ক্ষয় রুখতে, কার্যকরী ও পরিবেশ বান্ধব প্রতিরোধক উদ্ভাবন।
সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক বোধহয় এইভাবেই প্রবল ইচ্ছা শক্তি দিয়ে ভগবান মেরামত করে দেন। কিন্তু এত সবের পরেও, ডক্টরেট নিল দেশাই কি এবারে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে পারবেন? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন