সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শোলার হাতীঃ বিদেশের মাটিতে, উপহার হিসেবে তুলে দিলেন নরেন্দ্র মোদী !

প্রদীপ জ্বালানোর পূর্বে যেমন সলতে পাকাতে হয়, তেমনি প্রত্যেক সফল প্রতিমা নির্মাণের পেছনে থাকে অনেকগুলি পর্ব পেরোনোর ইতিবৃত্ত প্রথমে, দড়ির বাঁধনে বেঁধে, নির্মাণ করতে হয় একটি খড় কাঠের আদল তারপরে ক্রমে ক্রমে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়, এরপরে থাকে রোদে শুকানোর পালা, তারপরে আবার মাটি লেপা... এবং সবশেষে রং তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা হয় মূর্তির চুড়ান্ত মৃন্ময় রূপ একজন সফল শিল্পীর জীবনেও থাকে অনেকগুলি পর্যায় অতিক্রম করার ইতিহাস
বর্তমানে ৬৫ বছর বয়সী, শোলা শিল্পী সমীর সাহার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই কিশোর বেলায়, যখন তার ১৫ বছর বয়স মুর্শিদাবাদে জন্ম ও বড় হওয়া, সমীর তখন কোথাও শোলার কাজ হচ্ছে দেখলেই, এক দৃষ্টিতে, শিল্পীর হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকতেন কেমন করে সেই শিল্পী শোলার ওপর খুদে খুদে, সুন্দর সুন্দর নকশা তুলছেন, তা নিবিড় ভাবে নিরীক্ষণ করতেন সে অর্থে, কেউ হাতে ধরে শেখায়নি তাকে তারপরে নিজেই একদিন, ছেনি হাতে, শোলার ওপরে শুরু করে দিলেন খোদাই করার কাজ সেই শুরু। কিন্তু নিজের এলাকার সেই ক্ষুদ্র পরিসর থেকে প্রথমে জেলা এবং তারপরে রাজ্য স্তর থেকে ক্রমে জাতীয় এবং সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর শিল্প কৃতির কদর পাওয়া পর্যন্ত একটা লম্বা যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয়েছে শিল্পী সমীর সাহাকে।  সম্প্রতি তাঁর তৈরি করা একটি শোলার নির্মাণকে, ঘানার স্পিকারের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিতে দেখা গেল স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদীকে। শিল্পী হিসেবে নিশ্চিতভাবে এটি তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি। প্রায় সাফল্যের এভারেস্টে আরোহণ করার মতন ব্যাপার। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের এই সফর কিভাবে সম্ভব হল, সেই দিকেই এবার ফিরে দেখবো।

প্রথমে হাত পাকিয়েছিলেন, দুর্গা প্রতিমার বিভিন্ন শোলার গহনা তৈরীর কাজে; স্বভাবজাত শিল্প -নৈপুণ্যে, গড়ে তুলেছিলেন প্রতিমার চূড়া, কন্ঠ হার, বাজু বন্ধ ইত্যাদি স্থানীয় ভাবে, প্রশংসিত হয়েছিলেন বিস্তর প্রাথমিক ভাবে, রাজ্য সরকার তাঁর বিভিন্ন হস্ত শিল্পের নমুনা কিনে নিতেন কিন্তু প্রথম ব্রেক থ্রু পেলেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল কে কিদোয়াই এর হাত ধরে। সেই প্রথম, রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি।  সেবার রাজ্যপাল হিসেবে কিদোয়াই যখন মুর্শিদাবাদে পৌঁছলেন, সমীর সাহা তাঁর হাতে শোলার তৈরী একটি মিনিয়েচার মডেল তুলে দিয়েছিলেন উপহার হিসেবেমডেলটি ছিল মুর্শিদাবাদের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থাপত্য নির্মাণ, হাজার দুয়ারী'র। 
যদিও জাতীয় পুরস্কার এলো আরোও কয়েকবছর বাদে; ২০০৬ সালে শোলার ওপর গড়ে তোলা একটি দুর্গা প্রতিমার ভাস্কর্যের জন্য সেবার জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি তখন রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী প্রতিভা সিং পাতিলের হাত থেকে তিনি গ্রহণ করেন এই সম্মান তবে শুধুমাত্র শোলা নয়, শাঁখের এবং পেতলের ভাস্কর্য নির্মাণেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী

বর্তমানে, বহরমপুরে তাঁর একটি ছোট ওয়ার্কশপ রয়েছে, নাম - উত্তরায়ণ শোলা শিল্পালয় সেখানে তাঁর সাথে যুক্ত রয়েছেন আরোও কয়েকজন সতীর্থ ভাস্কর কিন্তু অতি সম্প্রতি, তাঁর কাছে খবর এসে পৌঁছায় যে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং, তাঁর তৈরী একটি ত্রিমাত্রিক শোলার ভাস্কর্যকে উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন, ঘানা' স্পিকারের হাতে প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ঘানা সফরকালে (জুলাই ২, ২০২৫) এই উপহারটি সেখানকার স্পিকারের হাতে প্রদান করেন।  এটি একটি ১১ ইঞ্চি লম্বা রাজকীয় সাজে সজ্জিত হাতীর ভাস্কর্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে, রাজরাজড়াদের যুদ্ধে অথবা মৃগয়া যাত্রা কালে হাতীর পিঠে সওয়ার হওয়ার ঐতিহ্য বহু প্রাচীন সমীর সাহা এই ভাস্কর্যটির মধ্যে সেই ঐতিহ্য কে তুলে ধরেছেন, হাতীর পিঠে রাজ উপবেশন কল্পে শোভা পাওয়া একটি সুদর্শন, এবং ফুলেল অলংকারে খচিত হাওধা নির্মাণ 'রে

শোলা শিল্পী সমীর সাহা
শিল্পী সমীর সাহা, টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি রোহিত খান্না কে জানিয়েছেন, তিনি এই ব্যাপারে কিছুই জানতেন না তাঁর ধারনা, সরকারের কোনো উচ্চ পদাধিকারী হয়তো কোনসময় তাঁর কাছ থেকে এই হাতীর প্রতিমূর্তিটি সংগ্রহ করে থাকবেন
তবে তিনি খুশী, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই শিল্প কৃতিটিকে ঘানা' সংসদীয়  অধ্যক্ষ আলবান সুমনা কিংসফোর্ড বাগবিনের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেওয়ার জন্যে উপযুক্ত মনে করেছেন
কৃতি হস্ত শিল্পী সমীর সাহা মনে করেন, সাফল্য পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তবে একই সাথে খেদ প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান দিনে এই লাইনে আসা নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বড়ই পরিশ্রম বিমুখ, তারা সাফল্যের শটকাট রুট খোঁজেন সবসময়, যেটা তাঁকে পীড়া দেয়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...