প্রদীপ
জ্বালানোর পূর্বে যেমন সলতে পাকাতে হয়, তেমনি প্রত্যেক সফল প্রতিমা নির্মাণের পেছনে থাকে অনেকগুলি পর্ব পেরোনোর ইতিবৃত্ত। প্রথমে, দড়ির বাঁধনে বেঁধে, নির্মাণ করতে হয় একটি খড় কাঠের আদল। তারপরে ক্রমে ক্রমে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়, এরপরে থাকে রোদে শুকানোর পালা, তারপরে আবার মাটি লেপা... এবং সবশেষে রং ও তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা হয় মূর্তির চুড়ান্ত মৃন্ময় রূপ। একজন সফল শিল্পীর জীবনেও থাকে অনেকগুলি পর্যায় অতিক্রম করার ইতিহাস।
বর্তমানে ৬৫ বছর বয়সী, শোলা শিল্পী সমীর সাহার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই কিশোর বেলায়, যখন তার ১৫ বছর বয়স। মুর্শিদাবাদে জন্ম ও বড় হওয়া, সমীর তখন কোথাও শোলার কাজ হচ্ছে দেখলেই, এক দৃষ্টিতে, শিল্পীর হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকতেন। কেমন করে সেই শিল্পী শোলার ওপর খুদে খুদে,
সুন্দর সুন্দর নকশা তুলছেন, তা
নিবিড় ভাবে নিরীক্ষণ করতেন। সে অর্থে, কেউ হাতে ধরে শেখায়নি তাকে। তারপরে নিজেই একদিন, ছেনি হাতে, শোলার ওপরে শুরু করে দিলেন খোদাই করার কাজ। সেই
শুরু। কিন্তু নিজের এলাকার সেই ক্ষুদ্র পরিসর থেকে প্রথমে জেলা এবং তারপরে রাজ্য স্তর থেকে
ক্রমে জাতীয় এবং সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর শিল্প কৃতির কদর পাওয়া পর্যন্ত একটা
লম্বা যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয়েছে শিল্পী সমীর সাহাকে। সম্প্রতি তাঁর তৈরি করা একটি শোলার নির্মাণকে, ঘানার
স্পিকারের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিতে দেখা গেল স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র
মোদীকে। শিল্পী হিসেবে নিশ্চিতভাবে এটি তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি। প্রায় সাফল্যের এভারেস্টে আরোহণ করার মতন ব্যাপার। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের এই সফর কিভাবে সম্ভব হল, সেই
দিকেই এবার ফিরে দেখবো।
প্রথমে হাত পাকিয়েছিলেন, দুর্গা প্রতিমার বিভিন্ন শোলার গহনা তৈরীর কাজে; স্বভাবজাত শিল্প -নৈপুণ্যে, গড়ে তুলেছিলেন প্রতিমার চূড়া, কন্ঠ হার, বাজু বন্ধ ইত্যাদি। স্থানীয় ভাবে, প্রশংসিত হয়েছিলেন বিস্তর। প্রাথমিক ভাবে, রাজ্য সরকার তাঁর বিভিন্ন হস্ত শিল্পের নমুনা কিনে নিতেন। কিন্তু প্রথম ব্রেক থ্রু পেলেন, পশ্চিমবঙ্গের
প্রাক্তন রাজ্যপাল এ কে কিদোয়াই এর হাত ধরে।
যদিও জাতীয় পুরস্কার এলো আরোও কয়েকবছর বাদে; ২০০৬ সালে। শোলার ওপর গড়ে তোলা একটি দুর্গা প্রতিমার ভাস্কর্যের জন্য সেবার জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। তখন রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী প্রতিভা সিং পাতিলের হাত থেকে তিনি গ্রহণ করেন এই সম্মান। তবে শুধুমাত্র শোলা নয়, শাঁখের এবং পেতলের ভাস্কর্য নির্মাণেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী।
বর্তমানে, বহরমপুরে তাঁর একটি ছোট ওয়ার্কশপ রয়েছে, নাম - উত্তরায়ণ শোলা শিল্পালয়। সেখানে তাঁর সাথে যুক্ত রয়েছেন আরোও কয়েকজন সতীর্থ ভাস্কর। কিন্তু অতি সম্প্রতি, তাঁর কাছে খবর এসে পৌঁছায় যে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং, তাঁর তৈরী একটি ত্রিমাত্রিক শোলার ভাস্কর্যকে উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন, ঘানা'র স্পিকারের হাতে। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ঘানা
সফরকালে (জুলাই ২, ২০২৫) এই উপহারটি সেখানকার স্পিকারের হাতে প্রদান করেন। এটি একটি ১১ ইঞ্চি লম্বা রাজকীয় সাজে সজ্জিত হাতীর ভাস্কর্য। ভারতবর্ষের ইতিহাসে, রাজরাজড়াদের যুদ্ধে অথবা মৃগয়া যাত্রা কালে হাতীর পিঠে সওয়ার হওয়ার ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। সমীর সাহা এই ভাস্কর্যটির মধ্যে সেই ঐতিহ্য কে তুলে ধরেছেন, হাতীর পিঠে রাজ উপবেশন কল্পে শোভা পাওয়া একটি সুদর্শন, এবং ফুলেল অলংকারে খচিত হাওধা নির্মাণ ক'রে।
তবে তিনি খুশী, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই শিল্প কৃতিটিকে ঘানা'র সংসদীয় অধ্যক্ষ আলবান সুমনা কিংসফোর্ড বাগবিনের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেওয়ার জন্যে উপযুক্ত মনে করেছেন।
কৃতি হস্ত শিল্পী সমীর সাহা মনে করেন, সাফল্য পাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তবে একই সাথে খেদ প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান দিনে এই লাইনে আসা নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বড়ই পরিশ্রম বিমুখ, তারা সাফল্যের শটকাট রুট খোঁজেন সবসময়, যেটা তাঁকে পীড়া দেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন