সেই 'শোলে' যার বিখ্যাত দুই নায়ক - নায়িকা জুড়ি, এমনকি রিয়েল লাইফেও একে অপরকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, সেই অমিতাভ বচ্চন - জয়া ভাদুড়ী কিংবা ধর্মেন্দ্র -হেমা মালিনীরা আজ তাঁদের সর্ব কনিষ্ঠ উত্তরসূরিদের কাছে, হয় ঠাকুরদা নয ঠাকুমা হিসেবে বিবেচিত। কারণ, বেলায় বেলায় 'শোলে 'ও তার মুক্তির ৫০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে, আর মাত্র কয়েক দিন অতিবাহিত হলেই। অর্থাৎ 'শোলে' এবার প্রকৃত অর্থেই তিন পুরুষের ছবি হতে যাচ্ছে। অমিতাভ বচ্চনদের সমসাময়িক মানুষ জন থেকে শুরু করে তাদের পরের প্রজন্মের কাছে 'শোলে' র চার্ম নতুন কিছু নয়। এবার বর্তমান প্রজন্মের কাছেও আর অবরুদ্ধ থাকছে না 'শোলে'র জাদু। তবে পুনরুদ্ধার কৃত। তারই গল্প আজ। এছাড়াও থাকছে আরোও অনেক কথা, বিদেশের সংবাদ মাধ্যমেও, এই নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা। এই সব নিয়েই আজকের নিবন্ধ, পুনরুদ্ধার ‘শোলে’।

ভারতীয় সে অধিবাসী, প্রবাসী কিংবা অভিবাসী যেই হোন না কেন, একটা বিষয়ে
সকলেই এক। প্রত্যেকেই কিন্তু এক বা একের বেশী বার ‘শোলে’দেখেছেন। বলা
হয়, ভারতের মাটিতে যেমন তেমন, বিদেশে গেলে
নাকি ভারতীয় মানেই ধরে নেওয়া হয় তিনি একবার হলেও ‘শোলে’ দেখেছেন। ভারতে নির্মিত
মূল ধারার হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্লকবাস্টার ‘শোলে’ দেখা অথবা না
দেখার মধ্যেই নাকি ভারতীয় হওয়া না হওয়া নির্ভর করে। ‘শোলে’ মুক্তি
পেয়েছিল ১৯৭৫ সালের, ১৫ই আগস্টের দিন; তখন দেশে, পুরোদমে
এমারজেন্সি চলছে। আসলে, ‘শোলে’ মুক্তি পাওয়ার
ঠিক ৫১ দিন আগেই (২৫ শে জুন) ইমারজেন্সি জারি হয়েছিল দেশে। মজার ব্যাপার হল, দু বছর পরে, ১৯৭৭ সালে
ইমারজেন্সি তুলে নেওয়া হলেও, ‘শোলে’ কিন্তু
ভারতবর্ষের কোনো কোনো হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত চলেছে। ‘শোলে’ হল সেই বলিউডি
ছবি যা আমার বাবা দেখেছেন; এই প্রসঙ্গে বলি বিয়ের দু বছরের মধ্যে মুক্তি
পাওয়া ‘শোলে’, আমার বাবা এবং
মা দুজনে সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছিলেন - সে গল্প মায়ের মুখে অনেক শুনেছি। আমি নিজে
দেখেছি দু বারের বেশী, কিশোর বয়সে একবার তারপরের গুলো অবশ্য
দেখেছিলাম টেলিভিশনের পর্দায় । আর এবছর যখন, ‘শোলে’ তার ৫০ বছর
পূর্ণ করতে যাচ্ছে, সেই সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের বছরে, খবরে প্রকাশ
আরোও একবার মুক্তি পেল, বলিউডের সেই অন্যতম সর্বকালের সেরা সুপারহিট
ছবি। পুনরুদ্ধার কৃত; আমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, আমজাদ খান
অভিনীত ছবিটিকেই ফিরে দেখার নবতম আয়োজন। বলা যেতে পারে, পুনর্জন্ম, পুরনো ছবির
পুনরুজ্জীবিত সংস্করণ, যেটি এযাবৎ কাল দেখা ‘শোলে’র থেকে আবার
বেশ আলাদা। সেটা নিয়ে একটু পরে বলছি। ‘শোলে’র এই
পুনর্জন্ম যদিও ভারতের মাটিতে নয়, হল সুদূর ইতালিতে। যদিও এর সলতে পাকানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আজ থেকে তিন
বছর আগে, ২০২২ সালে। লক্ষ ছিল ৭৫ এ রিলিজ পাওয়া ‘শোলে’র মূল সংস্করণ
উদ্ধার করা এবং তাকে পুনরায় মানুষের সামনে ফিরিয়ে আনা। এই লক্ষে, ‘শোলে’ র পরিচালক
রমেশ সিপ্পির ভাইপো, সুরেশ সিপ্পির ছেলে শাহজাদ সিপ্পি মূলত উদ্যোগটি নেন। শাহজাদ প্রথমে কথা বলেন ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে।
তারা সম্মত হলে, সিপ্পি ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড ও FHF যৌথ সহযোগিতায়
‘শোলে’র পুনরুদ্ধারে
নামে। প্রথমে শুরু হয় ‘শোলে’ র মূল ভার্সন
খোঁজার পালা। মূল ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরা সহ শব্দের কপি (নেগেটিভ) উদ্ধার হয়, মুম্বাই স্থিত
ফিল্মি রিলস গচ্ছিত রাখার ওয়্যারহাউস বা রক্ষণশালা থেকে। দীর্ঘদিন থাকার ফলে, রিলসের কয়েল
গুলো জড়িয়ে গিয়েছিল যাকে পরিভাষায়, হেভি ভিনিগার
সিন্ড্রোম বলা হয়। বাকি আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র, ব্রিটিশ ফিল্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (BFI) এর সহযোগিতায়
ইংল্যান্ডের আইরন মাউন্টেন থেকে সংগ্রহ করা হয়, যেখানে ১৯৭৮
সালে সিপ্পি ফিল্মস ছবির একটা ইন্টারপজিটিভ ও দুটো মধ্যবর্তী কালার রিভার্সাল সহ
জমা রাখে, ভবিষ্যৎ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। সব নিয়ে
একসাথে - জমা দেওয়া হয় ইতালির বোলোগনায় অবস্থিত L’immagine Ritrovata Laboratory তে। এবং শেষপর্যন্ত ওই ল্যাবরেটরির ঐকান্তিক
প্রচেষ্টায় সম্ভব হয় ‘শোলে’র পুনরুদ্ধার।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, এই পুনরুদ্ধার কৃত ‘শোলে’ র মধ্যে থাকছে
তিন তিনটে অতিরিক্ত সিন, যার মধ্যে দেখা যাবে সিনেমার অরিজিনেল শেষ
দৃশ্যটি ও, যেখানে আমজাদ খান অভিনীত গব্বর সিং কে হত্যা করতে দেখা যাবে পুলিশ অফিসারের
ভূমিকায় অভিনয় করা সঞ্জীব কুমারকে। সেন্সর হওয়া থেকে বাঁচতে, এই দৃশ্যটিকে
বাদ দিয়ে, শেষ দৃশ্যে গব্বর কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে
যাওয়ার ছবি দেখানো হয়েছিল। ‘শোলে’ র এই আন-কাট সংস্করণটি
সম্প্রতি, ইতালির II Cinema
Ritrovata Festival এ দেখানো হল। জুন মাসের ২৭ তারিখে, বোলোগনার Piazza Maggiore এ, খোলা আকাশের নীচে প্রদর্শিত হল - এই
পুনর্নবীকৃত এবং আন কাট ‘শোলে’; বিশ্বে
সর্বপ্রথম, ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শোয়ের মাধ্যমে।
এর মধ্যে আবার, আমেরিকার টরেন্টো আন্তর্জাতিক ফিল্ম
ফেস্টিভ্যালেও, ‘শোলে’ র পুনরুদ্ধার
করা সংস্করণটিকে দেখানো হবে বলে খবর। প্রসঙ্গত, ‘শোলে’ মুক্তির বছরে
শুরু হওয়া টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালও এই বছর, এক সঙ্গে ৫০ এ
পা দিচ্ছে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালটি চলবে সেপ্তেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত।এই বছর মার্চ মাসে, আন্তর্জাতিক ভারতীয় ফিল্ম অ্যাকাডেমি সম্মান - IIFA এর ২৫ তম ফিল্ম উৎসব আয়োজিত হয় রাজস্থানের
জয়পুরে।

রাজমন্দির প্রেক্ষাগৃহ
এই উপলক্ষে, জয়পুরের ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহ, রাজমন্দিরে একটি বিশেষ শোয়ে দেখানো হয় ‘শোলে’। যদিও এটি ‘শোলে’র পুরনো
সংস্করণ ছিল। আশা করা যায়, আসছে আগস্ট মাসে ভারতীয় সিনেমা হল গুলিতেও ‘শোলে’র এই নতুন
আন-কাট সংস্করণটি মুক্তি পাবে । তখন, ‘শোলে’ সত্যি সত্যিই তিন পুরুষের ছবিতে রূপান্তরিত হবে। কারণ এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যারা এতদিন দেখেনি, তারাও নতুন
করে ‘শোলে’ কে দেখার
সুযোগ পাবে।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ‘শোলে’তে বিরুর
চরিত্রে অভিনয় করা ধর্মেন্দ্রের মুখে সেই বিখ্যাত ডায়ালগটির কথা – বাসন্তী ভি রাজি, মাওসি ভি রাজি; নিশ্চিত ভাবে
আজ ৫০ বছর পরে, বাসন্তীর নাতি পুতিরাও ‘শোলে’ দেখার
ব্যাপারে নিমরাজি হবে না।
পুরো পাঁচ দশক পেরিয়েও ‘শোলে’ যে পুরো
দস্তুর আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসতে পারে, সে কথা শুধু
আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বিদেশের
মিডিয়াতেও এই নিয়ে তুমুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি, ভারতে নিযুক্ত
ইরানের রাষ্ট্রদূত তার এক্স হ্যান্ডেলে একটি নিউজ স্টোরি শেয়ার করেছেন, ‘Sholay’ turns 50 and Iran still remembers’ এই শিরোনামে। ‘শোলে’ কে নিয়ে লেখা
এই নিউজ স্টোরিটি, সম্প্রতি ইরানের একটি নেতৃস্থানীয় সংবাদ
পত্রে, বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে, পুরো একটা পেজ
জুড়ে। এই নিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পাতায় প্রকাশিত খবরে, সাংবাদিক শেখর
ঝা একটা দারুণ তথ্য শেয়ার করেছেন। সেটা অবশ্যই ‘শোলে’র গব্বর সিং
কে নিয়ে। ইরানে কিন্তু গব্বর সিং, জব্বর সিং
নামে পরিচিত। এবং এই গব্বর সিং চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয়, ইরানীয়
জনসাধারণের কাছে যে ওখানকার এক অভিনেতা, যার নাম -
নভিদ মামজা, তিনি গব্বর সিং এর লুক এবং তার অননুকরণীয়
বাচন শৈলীকে পর্যন্ত হুবহু নিজের অভিনয় শৈলীর মধ্যে ফুটিয়ে তুলে বিখ্যাত হয়েছেন।
'শোলে'র ৫০ বছরে আবারো একবার
বিরু আর জয়ের বন্ধুত্বের কেমিস্ট্রি তথা গব্বর সিং এর কাঁপন ধরানো স্ক্রিন
উপস্থিতি আলোড়ন ফেলতে চলেছে নতুন প্রজন্মের ভারতীয়দের মনে। 'শোলে'তে কেবল মাত্র
একটি সংলাপ বলা অভিনেতাও, ছবির অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে, বিখ্যাত হয়ে
উঠেছেন, এমন নজির ও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে, ছবির সংলাপ
তথা চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাভেদ আখতার ও সেলিম খানের জুড়ির কথা অবিস্মরণীয়
।
অবশ্যই এর আবহ সঙ্গীত, বিশেষ করে আমজাদ খান অভিনীত গব্বর সিং এর
পর্দায় আবির্ভাব কালে যে বিশেষ টানের বাঁশির সুর তার ভয়ঙ্করতাকে বাড়িয়ে তুলতে
সাহায্য করে তার কথা না বললেই নয়। আবহ সঙ্গীত তথা ছবির সবকটি সুপারহিট গানের
সুরকার হিসেবে আবারো একবার আর ডি বর্মন এর নাম সকলের মুখে মুখে ফিরবে।"এ দোস্তি- হাম নেহি
তোড়েঙ্গে"
মুক্তির সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে, সিনেমা মোদী
অগণিত মানুষজনের কাছে'শোলে'র আকর্ষণ কমে যাওয়ার
তো কোনো প্রশ্নই নেই, বরং তা আরোও ঘনীভূত হবে বলেই আশা করা যায়।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন