সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পাকিস্তানে রামের এ আই বনবাস!

দন্ডকারেণ্য বনের পঞ্চবটি তলে, জনকনন্দিনী সীতা সহসা এক স্বর্ণ মৃগ কে তাদের পর্ণ কুটির সমক্ষে নিরীক্ষণ 'রে যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ স্বামী রামের কাছে সেই সুদর্শন হরিণটিকে ধরে আনার জন্যে কাতর আবদার জানালেন।

আচ্ছা আমি কি রামের কথিত বনবাস পর্বের পুনরুল্লেখ করতে বসেছি
? না । আসলে দস্যু রত্নাকর থেকে ঋষি হওয়া বাল্মিকী মুনি, এখনকার মতো ইউ টিউব বা ওটিটি প্লাটফর্ম পাননি যে তার এই মেগাহিট কাহিনীটি খুব সহজেই শুনিয়ে দেবেন। একান্তই লিখিত শব্দের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল তাঁকে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদীর তীরে বনবাস রত সীতা সহ রাম ও লক্ষণের সেই দিব্য যাপন কথা; তাদের চোখের ভাষা, মুখের কথা এবং সর্বোপরি অরণ্যের রম্যরূপ বর্ণনায়, কেবল মাত্র শ্লোক-ছন্দে লেখনী লেপনই তাঁর কাছে এক এবং একমাত্র উপায় ছিল।

যুগ পাল্টেছে। এখন চলচ্চিত্র শুধু নয় থিয়েটার মঞ্চে পর্যন্ত প্রেক্ষাপট তৈরি করতে এ আই বা কৃত্রিম মেধা ব্যাবহার বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে। আগের দিনের মতো মঞ্চের পশ্চাতে শুধুমাত্র পর্দা বদল ও কুশলী আলোক প্রক্ষেপণের সাহায্যে পরিবেশ রচনার কথা এখন প্রায় বিস্মৃত
ভাবনায় পরিনত হয়েছে। তবু সামাজিক কাহিনীর নাট্যরূপায়ণের ক্ষেত্রে পূর্বের প্রথা চলতে পারে; পৌরাণিক কাহিনীর মঞ্চায়নে কিন্তু এ আই এর প্রয়োগ প্রায় অবশ্যম্ভাবী উপকরণ হিসেবেই পরিগণিত হয় বর্তমানে।

এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো দেশই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে সম্প্রতি, আর্টস কাউন্সিল অফ পাকিস্তানের করাচি স্থিত থিয়েটার মঞ্চে, অভিনীত হয়েছে রামায়ণের নাট্যরূপ। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, গেল জুলাই মাসের ১৩ তারিখে (২০২৫), রামায়ণ মঞ্চস্থ হয়ে গেছে পাকিস্তানে। এবং এর মঞ্চ সজ্জায় ও পটভূমি নির্মাণে পুরোদস্তুর ব্যবহৃত হয়েছে এ আই প্রযুক্তি।

বলাই বাহুল্য
, পাকিস্তানের মাটিতে এই প্রথম মঞ্চস্থ হলো রামায়ণ। সময়টা দেখুন, মাত্র দু মাস আগে পহেলগাও জঙ্গী হানা (২২শে এপ্রিল, ২০২৫), অপারেশন সিঁদুর (৭ – ১০ই মে, ২০২৫) ইত্যাদি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সে দেশের প্রশাসন বা সেখানকার কোনো মৌলবাদী সংগঠন কেউই রামায়ণ মঞ্চায়নের বিরোধিতা করেনি। এমনকি এর স্পন্সর বা হল কর্তৃপক্ষেরও কোনোরকম আপত্তি ছিল না। উল্টে রামায়ণ দেখার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন জোয়ান, বাচ্চা, বুড়ো নির্বিশেষে আপামর পাকিস্তানি মানুষ।  ১০০০ আসন বিশিষ্ট করাচির ওই থিয়েটার হল ছিল পুরো হাউসফুল । টাইমস অব ইন্ডিয়া'য় সাংবাদিক স্নেহা ভুরাকে, নাটকের পরিচালক যোগেশ্বর কারেরা জানিয়েছেন, এই নাটকের রাম সহ সমস্ত চরিত্রেই অভিনয় করেছেন সে দেশের মুসলিম অভিনতা ও অভিনেত্রীরা।

উল্লেখযোগ্য ভাবে
, রামের চরিত্র যিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সেই আজমল লালওয়ানী বলেছেন, আমি মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও রামায়ণের গল্প শুনতে শুনতেই আমাদের বড় হওয়া। রামায়ণের কাহিনী আসলে পুরো এই উপমহাদেশের। এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ কোনভাবেই দেশকালের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়"।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছু শব্দের পরিবর্তন করতে হয়েছে। দর্শকদের সুবিধার জন্য যেমন সংস্কৃত
'প্রকৃতি' শব্দটিকে কুদরত করা হয়েছে তেমনি 'মুন্দ্রিকা' শব্দটিকে আঙ্গুঠি বা আংটি করা হয়েছে।

নাট্যাভিনয়ে ডিপ্লোমা করা যোগেশ্বর কারেরা
, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দূরদর্শনের পর্দায় রামায়ণ দেখেন। রামায়ণের মূল ভাষ্য - দুষ্টের পতন ও শিষ্টের উত্থান তাকে প্রথম থেকেই আকৃষ্ট করতো। এখন তাঁর ৩০ বছর বয়স, কিশোর বয়সে সিন্ধ প্রদেশ থেকে করাচিতে চলে আসেন বাবা মায়ের সঙ্গে। মাঝপথে অ্যাকাউন্টেন্সির স্নাতক কোর্স ছেড়ে ভর্তি হন পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস এর শিক্ষাক্রমে।

উল্লেখ্য
, রামানন্দ সাগরের রামায়ণে, বানর রাজ অঙ্গদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা বসির খাঁন। সেটা ১৯৮৭ সাল। পরের বছর বি আর চোপড়ার মহাভারতেও ছিলেন দুজন মুসলিম অভিনেতা। একজন ফিরোজ খাঁন, অর্জুনের ভূমিকায়, দ্বিতীয় জন কোলকাতায় জন্ম অভিনেত্রী নাজনীন, কুন্তীর ভূমিকায়। মহাভারতের এমনকি চিত্রনাট্য ও সংলাপ ও লিখেছিলেন একজন উর্দু লেখক, রাহি মাসুম রাজা।

তাই প্রেরণা ছিলই
; একবছর আগে তাই সুযোগ পেতেই, যোগেশ্বর তৈরি করে ফেলেছিলেন নাট্য দল, দুই সতীর্থ বান্ধবী রানা কাজমি ও সানা তোহাকে নিয়ে। নাম দিয়েছিলেন 'মৌজ ক্যালেক্টিভ'। এদের মধ্যে রানা কাজমি আবার সীতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শামহান গাজী ফুটিয়ে তুলেছেন রাবনকে।

সদা যুযুধান দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে তুলতে রামায়নের এই নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হওয়া নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে সীমান্তের দুই পারে। কিন্তু করাচির ওই থিয়েটার হলে সবথেকে চিত্তাকর্ষক বিষয় -
যেটি সীতা রূপী রানা কাজমি তুলে ধরেছেন সাংবাদিক স্নেহা ভুরার কাছে তা বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবী রাখে।

হলে উপস্থিত এক দর্শক দম্পতিকে যখন দেখা যায় তারা তাদের ছোট বাচ্চাটাকে শুধু রামায়ন দেখাতে নিয়ে এসেছেন তাই নয় প্রত্যেকটি দৃশ্যের নৈতিক মাহাত্ম্যও বুঝিয়ে দিচ্ছেন
, তখন আশা জাগে বৈকি!



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...