"সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর”! রবীন্দ্রনাথের
জীবনে প্রথম মৃত্যুর আঘাত এসেছিল ১৪ বছর বয়সে। ১৮৭৫ সালে, দীর্ঘ রোগভোগের পরে, মা
সারদাসুন্দরী দেবী যখন ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন তখন গভীর রাত্রি। পরের দিন সকালে, বাইরের
বারান্দায় এসে দেখলেন, সামনের প্রাঙ্গনে - সুসজ্জিত খাটের ওপর শোয়ানো রয়েছে তাঁর
মায়ের মৃতদেহ। কিশোর রবীন্দ্রনাথের চোখে, তা শুধুই সুখ নিদ্রা যাপনের নিশ্চিন্ত
শয়ান মুদ্রা ছাড়া কিছু ছিল না। “জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ” তখনো স্পষ্ট করে
প্রতিভাত হয় নি তাঁর চোখে। না বুঝেই সেদিন যেভাবে দৃশ্যমান মৃত্যুর সামনে নিরুদ্বিগ্ন
ও অবোধ দর্শকের মত অবিচল এবং অশোকবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,
পরবর্তীকালে বৌঠান কাদম্বরী দেবী থেকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী এবং আরও প্রিয়জনদের
হারিয়েও কি এমনই নির্বিকার থাকতে পেরেছিলেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তরে সকলেই হয়তো একবাক্যে স্বীকার করবেন,
হ্যাঁ পেরেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর মত চির বিচ্ছেদের শোক বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যে
অত সহজ ছিল না, তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবন- স্মৃতি’র পাতায়,
অকপটে স্বীকার করেছেন, “শিশুবয়সের লঘু জীবন, বড় বড় মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া
ছুটিয়া যায়। কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ
নেই”।
সম্প্রতি ঢাকুরিয়ার রামকৃষ্ণ আশ্রমে, "বর্তমান সময়ে ‘গীতা’র প্রাসঙ্গিকতা" - নিয়ে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট ‘গীতা’ বিশারদ
এবং সাহিত্যিক ডঃ সিরাজুল ইসলাম, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জীবনে ‘গীতা’র ১৮ খানা
অধ্যায় কিভাবে এক একটা সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে তাঁকে মৃত্যুর ওপরে উঠে - প্রকৃতি ও
সময়ের চির প্রবাহমানতাকে অনুভব করতে সাহায্য করেছিল তার প্রাঞ্জল বর্ণনা দেন। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, সিরাজুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য রকমের মৃত্যু উদাসীনতার সাক্ষ্য স্বরূপ, দুটো অত্যন্ত কম-শোনা ঘটনার কথা তুলে ধরেন। প্রথমটা তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকার মৃত্যুর (১৯০৩) পরে, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের চোখে, সদ্য প্রয়াত কন্যার পিতা হিসেবে
রবীন্দ্রনাথের যে নজিরবিহীন ছবি সেদিন ফুটে উঠেছিল, তাই নিয়ে। দীর্ঘ দিন ধরে অসুখে ভুগছিল, রেণুকা; যাকে
রবীন্দ্রনাথ আদর করে রানী বলে ডাকতেন। প্রায়ই রাণীকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, দেখতে আসতেন
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলনাবিশেরা। একদিন
বিকেলে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এসে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথ বারান্দায় বসে আছেন
চেয়ারে, গুন গুন করে গান গাইছেন। অন্যান্য দিনগুলোর মত, প্রভাত বাবু রবীন্দ্রনাথকে,
মেয়ে কেমন আছে বলে জিজ্ঞাসা করতেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জানালেন, “ও তো সকালে মারা গেছে। খানিক আগে, নিমতলা
শ্মশানে দাহ করে ফিরে এলাম।" মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন; শুনে প্রভাত কুমার হতভম্ব না
হয়ে থাকতে পারেন নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি, রবীন্দ্রনাথের ১১ বছরের পুত্র সন্তান শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর (১৯০৭) পরে। মুঙ্গের থেকে ছেলের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সেরে, রবীন্দ্রনাথ পরের দিনই, কয়লার ট্রেনে ফিরে এসেছেন
শান্তিনিকেতনে। তার পরের দিন, দোল। সন্ধ্যায়, আশ্রমিকেরা সবাই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে
বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে তাদের বিনম্র জিজ্ঞাসা – গুরুদেব এবার
তাহলে দোল উৎসব কি স্থগিত থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ ঘুরিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
মিনমিন করে সকলে বলে উঠলো - আপনার ছেলে মারা গেলো, গতকাল...!
রবীন্দ্রনাথ স্মিত হাস্যে, সকলের উদ্দেশ্যে তার নির্বিকার চাহনি হেনে বললেন, দেখো
তো আমার ছেলে মরেছে বলে আজকের জ্যোৎস্নাটায়, চাঁদের আলো কি কিছু কম আসছে, না একই
রকম?
সবাই বলল, না একই রকম।
সেখানেই থামলেন না, রবীন্দ্রনাথ; বরং প্রকৃতির এক সত্য থেকে আর এক সত্যের কাছে তাঁর অলৌকিক
অনুসন্ধিৎসা নিয়ে হাজির হতে চাইলেন, প্রবল পরাক্রমে। পারতপক্ষে কোনো ব্রহ্ম জ্ঞানী ঋষির মতোই ছুঁড়ে দিতে থাকলেন একের পর এক প্রশ্ন বাণ - দেখো
তো আমার ছেলে মরেছে বলে, মাধবীলতায় জোনাকিরা আজকের কি কিছু কম এসেছে?
সবাই বলল, না।
কালকে যা এসেছিল, আজকে সেইরকমই, একটা দুটো হয়তো
কম কি বেশী।
বললেন, দেখো তো, আমার
ছেলে মরেছে বলে, হাসনুহানা ফুলের গন্ধটা কালকের চেয়ে আজকে কি একটু কম আসছে?
উত্তরে
কেউ কেউ বললেন- না, কেউ কেউ স্তম্ভিত চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন রবীন্দ্রনাথের
দিকে।
উদয়নের প্রাঙ্গনে তখন একটি পাতা খসে পড়লেও যেন অনেক; কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। অবশেষে, নীরবতা ভাঙলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে; অকপটে
জানিয়ে দিলেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা - আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য প্রকৃতির কোথাও যদি
কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে দোল উৎসব কেন
বন্ধ থাকবে!
যে রবীন্দ্রনাথ একদা মৃত্যুর “দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল” বলে বিলাপ করেছিলেন, তিনি কি
করে পাথর কঠিন মৃত্যু শোককেও এত সহজে অতিক্রম করতে পারলেন!
ডক্টর সিরাজুল ইসলামের মতে, রবীন্দ্রনাথের এ
হেন মানসিক স্থিতি ‘গীতা’র মোক্ষ তীর্থে পৌছনোর তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যাকে রবীন্দ্রনাথ সত্য তীর্থ বলে অভিহিত করেছিলেন। যেখানে পৌঁছলে - রুপম অমৃতম যৎ
বিভাতি। অর্থাৎ সেখানে শুধুই আনন্দ, অন্ধকার নেই; শুধুই সুখ কোনো শোক নেই। এটাও
হতে পারে, ক্রমাগত মৃত্যুর আঘাত পেতে পেতে লৌহবৎ কঠিন হয়ে উঠেছিল তাঁর হৃদয়ের সকল কোমলতা, হারিয়ে গিয়েছিল শোক অনুভবের সূক্ষ্ম সংবেদ।
এই অভূতপূর্ব দোলাচলের অবশ্য মীমাংসা ঘটিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই। একথা ঠিক, মৃত্যু
থেকে মৃত্যু উত্তরণের পথ যে তিনি খুব সহজে খুঁজে পেয়েছেন এমনটা নয়। বরং তাঁর উন্মুখ অন্বেষণের পদে পদে জড়িয়ে ছিল শত
সহস্র বিহ্বলতা, কাঁটার মত ছড়িয়ে ছিল বিস্ময় দীর্ণ অটল অযুত বিমুঢ় ভাবনার দোলাচল। কখনো কখনো
ভেবেছেন, “দেহ, প্রান, হৃদয়” এমনকি “মনের সহস্রবিধ স্পর্শের দ্বারা” যাকে সবথেকে
বেশী সত্য ও নিকটের বলে মনে হয়েছিল সেই প্রিয়জন যখন এক নিমেষে স্বপ্নের মত মিলিয়ে
গেল, তখন চারিদিকে নিশ্চিত সত্যের মত বিরাজ করা
“গাছপালা, মাটি, জল, চন্দ্র সূর্য ...” এর দিকে তাকিয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছে,
“এ কি অদ্ভুত আত্মখণ্ডন নয়!”
প্রশ্ন জেগেছে, “যাহা নেই, তাহা মিথ্যা”
যদি হয়, তবে “যাহা গেল তাহার পরিবর্তে কি আছে?” আর সেই “শূন্যতাকে অন্তরের সঙ্গে
বিশ্বাস” করবেনই বা কি করে? যা আছে এবং যা থাকলো না - এই দুইয়ের মধ্যে মিল করবেন কেমন
করে! দিনের পর দিন, মৃত্যুর দূরতিলঙ্ঘ্য অন্ধকারকে অতিক্রম করতে না পেরে শুধুই জর্জরিত
হয়েছেন মনে মনে। “মৃত্যু যখন মনের চারিদিকে হঠাৎ একটা ‘নাই’ অন্ধকারের বেড়া গাড়িয়া দেয়,
তখন সমস্ত মনপ্রান অহোরাত্র দুঃসাধ্য চেষ্টায় তাহারই ভিতর দিয়া কেবলই 'আছে’ আলোকের
মধ্যে বাহির হইতে চায়!” রবীন্দ্রনাথ এই প্রচেষ্টাকে, অন্ধকারে বড় হওয়া চারাগাছের
সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে চারাগাছ নিরন্তর সেই অন্ধকারকে ছাড়িয়ে, শুধু একটুকু আলোকের পরশ
পেতে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যায়।
কিন্তু, এর থেকে মুক্তির রাস্তা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন, কিভাবে! সেই প্রাপ্তির সঙ্গে অবশ্য জুড়ে রয়েছে হঠাৎ বোধি লাভের মত আকস্মিকতার আনন্দ। মেঘ
পূর্ণ আকাশে সহসা বিজলী চমকের মত তাঁর মনে ভেসে উঠেছে, জগতের সেই অমোঘ সারসত্য – জীবন
অবিচল এবং নিশ্চিত নয়। উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন হঠাৎ প্রজ্জলিত জ্ঞানশিখার দীপ্ত আলোকাঘাতে। “আমরা যে
নিশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা দেওয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদী নহি এই চিন্তায় আমি
ভিতরে ভিতরে উল্লাস বোধ করিতে লাগিলাম।" কিন্তু
তখনও পুরোপুরি বেদনা মুক্ত হতে পারেননি তিনি। একদিকে প্রিয়জনকে হারিয়ে কষ্ট যেমন
পেয়েছেন তেমনি তাকে কয়েদ মুক্ত করার প্রশ্নে ‘উদার শান্তি’ও অনুভব করেছেন। রবীন্দ্রনাথ
‘জীবন স্মৃতি’ তে লিখছেন, “কিছুদিনের জন্য জীবনের প্রতি আমার অন্ধ আসক্তি একেবারেই
চলিয়া গিয়াছিল।" যার ফলশ্রুতি, তিনি জগতকে নির্লিপ্তির দূরত্ব থেকে দেখতে সমর্থ হয়েছিলেন। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুকেই তিনি সেই দূরত্ব রচনার মূল নেপথ্য কারিগর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। মৃত্যু দিয়েই মৃত্যু-শোক ভোলার আয়োজন।
“আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং
জানিলাম তাহা বড় মনোহর।" এ যেন সেই ১৪ বছরের সদ্য মাতৃ হারা রবীন্দ্রনাথের নিষ্পাপ
মৃত্যু দর্শনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
মৃত্যুর চার মাস পূর্বে, ১৩ই মে - রাত তখন তিনটে বেজে ১৫ মিনিট; অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে
জেগে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। পাশ থেকে ডায়েরি টেনে তাতে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলেন
কয়েকটি লাইন, রূপ-নারানের কূলে/ জেগে উঠিলাম,/জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়। পরের দিন সকালে, রানী চন্দ যিনি রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের লেখাগুলির, বেশিরভাগের
শ্রুতি লেখিকা ছিলেন, এসে জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব আপনি কি কিছু লিখছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ ভুলে গিয়েছিলেন। বললেন, পড় তো। শুনি।
শুনলেন এবং তারপরেই আউড়ে গেলেন
পরের লাইন গুলি।
“চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়;”
আর সবশেষে লিখলেন সেই লাইন, যেখানে তিনি মৃত্যুতেই মুক্তির খোঁজ দিলেন; জীবনের সকল ঋণ শোধের পথ যে মৃত্যুই, নিঃসঙ্কোচে বললেন সে কথা!
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন/ সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,/ মৃত্যুতে সকল
দেনা শোধ ক’রে দিতে।
রবীন্দ্রনাথ প্রণীত 'জীবন স্মৃতি' ও কাব্য গ্রন্থ 'শেষ লেখা'
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন