সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আহত উড়ান!

টানা দুই মাসের নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, যে কোনো মূল্যে চ্যলেঞ্জ পূরণ করার অদম্য ইচ্ছা এবং বিজ্ঞানের আধুনিকতম উপকরণ ও প্রযুক্তির প্রয়োগে কোনোরকম কার্পণ্য না করার অনড় মানসিকতা নিয়ে, একদল মানুষ শেষ পর্যন্ত দেখিয়ে দিলেন যে মানুষ চাইলে পা কেটে বাদ দেওয়া মরালও আকাশ বেয়ে পুনরায় তার উড়ান ভরতে পারে।

ঘটনার সূত্রপাত, এই বছরের ১৫ই মে; নবি মুম্বাই অঞ্চলে অবস্থিত নেরুল এন আর আই জলাভূমিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বন্যপ্রাণ ফটোগ্রাফার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। সেদিন হঠাৎ, অভিজিৎ বাবু, একটি ফ্লেমিংগোকে নায়লনের জালে, অসহায় ভাবে আটকা পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন। জাল থেকে পা ছাড়াতে গিয়ে, পাখিটির বাম দিকের পা'টি একেবারে রক্তারক্তি অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বন দপ্তরে খবর দেন। বন দপ্তর থেকে, অনতিবিলম্বে বিকাশ বৈরাগী নামের এক আধিকারিকের নেতৃত্বে অন্য আরোও কয়েকজন বন কর্মী ছুটে আসেন এবং পাখিটিকে উদ্ধার করেন। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে পুনরায় তাকে জলাভূমিতে ছেড়েও দেওয়া হয়। কিন্তু পাখিটি ওইখানে ওইখানেই চক্কর মারতে থাকে, বেশিদূর উড়ে যেতে পারে না। বিকাশ বৈরাগী এবং অভিজিৎ বাবুরা হয়তো তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব টুকু পালন করতে পেরেছেন ভেবে খুশী হতে পারতেন। নিশ্চিন্ত হতে পারতেন, ভাগ্যের হাতে বাকিটা ছেড়ে দিয়ে। না, সেরকম কিছু তাঁরা করেননি। উল্টে, আহত ফ্লেমিংগোটির উড়ান অসফলতা, তাঁদের একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আর এই চ্যালেঞ্জের শরিক হিসেবে, অনেককেই তাঁরা পেয়ে যান তাঁদের সাথে। মুম্বাই স্থিত অল ইন্ডিয়া ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন ইনস্টিটিউট এর অন্যতম লেকচারার মাকারন্দ সরাফ থেকে শুরু করে ওই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা ডক্টর অনিল গৌর পর্যন্ত অংশীদার হন, এই উড়ান যজ্ঞের! কিন্তু শেষমেশ কিভাবে সম্ভব হলো এই সবকিছু; অবিশ্বাস্য সেই উড়ান সাফল্যের কথা রূপকথার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। সে কথাই বলবো আজ খবরের রূপকথায়ফ্লেমিংগো তো এমনিতেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু উড়তে গেলে লাগে দুটো পা'কেই। তাই যে করে হোক জখম পা'টির পরিবর্তে একটি ভালো পা প্রতিস্থাপিত করতেই হবে, সে পা কৃত্রিম হলেও কোনো অসুবিধা নেই। নিশ্চিত ভাবে প্রত্যেকের মনে, অতীত দিনের নৃত্য কুশলী সুধা চন্দ্রনের কৃত্রিম পা'য়ের কথা মনে এসেছিল। যথারীতি, এই লক্ষ্যে শুরু হল কাজ। লেকচারার সরাফে'র নেতৃত্বে পুরো টিম এই ব্যাপারে, নিখুঁত সমন্বয় বজায় রেখে কাজ করে চললেন। প্লাস্টার অফ প্যারিসের ওপর ফেলে, প্রথমে পাখিটির কাটা পড়া পা টি'র মাপ নেওয়া হল। তারপরে সেই মাপের অনুপাতে শুরু হল কৃত্রিম পা তৈরির প্রক্রিয়া। এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন ওট্টো বোক হেল্থ কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড এর কর্ণধার অমিত মুখার্জি এবং পোডিয়াপ্রো ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এর মুখ্য অধিকর্তা রূষভ শাহ। ভূমিকা পাথারা জোগালেন প্রযুক্তিগত বুদ্ধি। এরোপ্লেন বা রেসিং কার বানানোর যে বিশেষ কার্বন ও অ্যাক্রিলিক রেজিন সমৃদ্ধ উপাদান, তাই দিয়ে তৈরি হলো আহত ফ্লেমিংগোর কৃত্রিম পা। যাতে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে পাখিটি উড়ে বেড়াতে পারে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার, বিশেষ রিপোর্টার জানিয়েছেন এই কৃত্রিম পা টি কিন্ত স্বাভাবিক পা'য়ের থেকে একটু আলাদা। সাধারণত, রাজহংস প্রজাতির ফ্লেমিংগো'র পা'য়ে তিনটি আঙুল থাকে যেটি পায়ের পাতা দিয়ে জোড়া থাকে। গঠনগত ভাবে, কৃত্রিম পা'য়ে রয়েছে একটি আঙুল এবং তা সম্পূর্ণ ভাবে উন্মুক্ত। গত ১৯শে জুলাই ছিল সফল ভাবে কৃত্রিম পা প্রতিস্থাপনের পরে তার উড়ান পরীক্ষার দিন। বলাই বাহুল্য, ফ্লেমিংগো'টির আর কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য নেই। সে এখন যেখানে খুশি, যত দূর খুশী উড়ে যেতে পারে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...