বরষার ধূসর মেঘ - ঢেকে যায়, কদম পাতার ঘন সবুজ আদরে। বড় নিবিড় সে বন্ধন আবার বড় চঞ্চলও। একটু বাতাসেই খিলখিলিয়ে ওঠে তার দুষ্টুমি ভরা শরীরী নাচন। কাছে আসে, জড়িয়ে ধরে আবার দূরে চলে যায় কপট বিচ্ছেদের ভান করে।
ওদিকে বরষার ডালা সাজিয়ে
পারদবর্ণা মেঘবালা তখন আপন হৃদয়ের কাছে থাকা কোনো সই যেন, দুই করপুট ভরে শুভ্র
বৃষ্টি কুসুম ঝরিয়ে দিতে উদগ্রীব সবুজ কদম্ব বাসরে। অবশেষে - আসে সে মাহেন্দ্র ক্ষণ;
খসে পড়ে কুসুমবারি, মেঘমালা ছিন্ন করে। চুম্বনের আকুলতা পেরিয়ে, আলিঙ্গনের আলস্যে যেন
সম্ভোগের শিহরন হয়ে ঝরে পড়ে তহ্নি কদম্বের সবুজ, আলুলায়িত পত্র শয্যা পরে। টুপ টাপ,
টুপ টাপ শব্দে পত্রাগ্রের হীরক খণ্ড সম বারি বিন্দু যেন স্খলিত কামনা, ঠাস বুননে
গড়া ঝিলমিলে সবুজ চাঁদোয়ার নীচে গলে পড়ে, অবলীলায়। ধীর ধারায়, কদম্বের দেহ বল্লরী
বেয়ে গড়াতে-গড়াতে সেঁধিয়ে যায় মাটির সুদূর গোপনে।
ক্রমশ - জোরে, আরো জোরে নেমে আসে সে বৃষ্টি প্লাবন ধারা। কদম তলার ছায়া ধূসর,
ভেজা মাটির প্রাঙ্গন - মুখরিত হতে থাকে বৃষ্টি ঝাঁপান গানে। পথে, উত্তাল ঝরনার মত উছলে পড়ে বৃষ্টিবতীর উদ্দাম আঁচল আর তার আঁচল জুড়ে ছেয়ে আসা লক্ষ বৃষ্টি-ধারা। ধুয়ে দিয়ে যায়, উতল বুকের কৃষ্ণবর্ণ পিচ রাস্তার ভরাট দেহ সৌষ্ঠব। জল
ভারে অবনত, বৃত্তপুষ্প গুলো ঝুপ ঝুপ করে রাস্তার বুকে ছিতরে পড়ে নিদারুন সমাপতনে। ছাতা মাথায় হেঁটে যায় মানুষজন। জল কাদায়
মাখামাখি হলদেটে-সাদা ছিন্ন ফুল রেণু মাড়িয়ে সাইকেল ছুটে যায় সাঁই সাঁই করে।
উলটোদিকে, নয়নজুলির জলে ভেসে থাকা কদম গাছের ছায়াটি - দমকে দমকে হয়ে পড়ে আলুথালু, বিস্রস্ত! বর্ষায় সপসপে কদম্ব শাখা, খানিক বাদে বাদেই মাতালের
মত নেতিয়ে পড়ে জলের বুকে। আবার স্নানরত শালিখের মত ডানার জল ঝরিয়ে হাওয়ার দোলায়
খানিক নেচে নেয় অবিলম্বিত লয়ে।
প্রকৃতিতে এমন কত কালজয়ী দৃশ্যপট রচিত হয়ে যায় সবার অলক্ষে, থেকে যায় অব্যক্ত, তার হিসেব রাখে কয়জনে।
আজকের দিনে এই অবিশ্রান্ত, কদম্ব বৃক্ষের উপর বর্ষা প্রক্ষেপণও কি জলের বুকে আঁকা আল্পনার মতই চিরতরে হারিয়ে যাবে প্রকৃতির স্মৃতি থেকে নাকি কালের আধারে কোনো স্মরনীয় গল্পের পটভূমি হয়ে ওঠার সাক্ষর-শিলা রেখে যাবে ভবিষ্যতের জন্যে! কেউ জানে না। ইতিমধ্যে, দূর থেকে ভেসে আসে ঘুঙুরের আওয়াজ। পৌষের মেঠো পথে যেমন চাষির কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া পাকা শস্যের বোঝা থেকে শোনা যায় ঝমা-ঝম শব্দ, দুলকি চালে গমকে গমকে, সেইরকম।
আসলে, শ্রাবণ মাস। তাই বাঁক কাঁধে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে শিবভক্ত মানুষ চলেছে বাবার মাথায় জল ঢালতে। ছেলেদের পরনে হাফ প্যান্ট, হাত কাটা গেঞ্জি আর কোমরে কষে পরা গেরুয়া গামছা। মেয়েদের পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। একটু একটু করে, পায়ে পায়ে সে মিছিল যত এগিয়ে আসে কদমতলার কাছাকাছি, প্রবল বৃষ্টির সোঁ সোঁ শব্দের মধ্যেও প্রকট হয়ে ওঠে জরি কাগজের ওপর প্লাস্টিকের ফুল, সাপ দিয়ে সাজানো সুদৃশ্য বাঁকে বাঁধা ঘুঙুরের ঘং ঘং শব্দ।
বৃষ্টি ভেজা কদম ফুলের গন্ধে হঠাৎই যেন উস্কে ওঠে গোপন স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা। কি এক অপূরণীয় সাধ ছিল - জীবনের অন্ধ কুঠুরিতে বন্দি, হয়তো হারিয়েও গেছে স্মৃতির কানা গলিতে, তারই যেন পুনরুদ্ধার হয়, কদম ফুলের এই সুধীর, সুললিত সুবাসে। "মোবাইল আছে, তোমার কাছে?" মিতা জিজ্ঞাসা করে। "বড্ড বাঁশির ধুন শুনতে ইচ্ছা করছে!" ঝন্টু প্যান্টের পকেট থেকে সযত্নে মোবাইলটা বের করে ইউ টিউবে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাজানো বাঁশী বাজাতে থাকে। মেঘ মল্লার রাগে।
একদিকে হরিপ্রসাদের বাঁশী, সাথে বর্ষার টাপুর টুপুর যেন শিবকুমার শর্মার সন্তুর; রেশমী সুতোর মত বাতাসে উড়তে থাকে অদ্ভুত সে সিম্ফনি ধারা, ছড়িয়ে পড়ে - কদমতলা ছাড়িয়ে ক্রমশ দূরে আরো দূরে। আর, ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মত কদমতলায় দাঁড়িয়ে থাকে, পাশাপাশি যেন কলির শ্যাম আর রাই। যখন, নীপ পুষ্পের সৌরভে ভরা কদম্ব ছত্রের চারিদিকে বৃষ্টি ঝরে, ঠিক যেন অজস্র ফুল ঝারি ঘেরা রাস-বাসর একখানা।
হঠাৎ টুপ করে একটা তরতাজা কদম ফুল, খসে পড়ে মিতার বুকে - আটকে যায়, ভেজা কাপড়ের ভাঁজে। খানিক চুপ থেকে, অধরতলে কিসের যেন প্লাবন চেপে রাখতে চেয়েও ব্যর্থ মিতা অস্ফুটে, কম্পিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্র গান, "বাদল দিনে, প্রথম কদম ফুল করেছো দান"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন