সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বরষার পথে কদম ফুলের গন্ধ!

 বরষার ধূসর মেঘ - ঢেকে যায়, কদম পাতার ঘন সবুজ আদরে। বড় নিবিড় সে বন্ধন আবার বড় চঞ্চলওএকটু বাতাসেই খিলখিলিয়ে ওঠে তার দুষ্টুমি ভরা শরীরী নাচন কাছে আসে, জড়িয়ে ধরে আবার দূরে চলে যায় কপট বিচ্ছেদের ভান করে।

 ওদিকে বরষার ডালা সাজিয়ে পারদবর্ণা মেঘবালা তখন আপন হৃদয়ের কাছে থাকা কোনো সই যেন, দুই করপুট ভরে শুভ্র বৃষ্টি কুসুম ঝরিয়ে দিতে উদগ্রীব সবুজ কদম্ব বাসরে। অবশেষে - আসে সে মাহেন্দ্র ক্ষণ; খসে পড়ে কুসুমবারি, মেঘমালা ছিন্ন করে। চুম্বনের আকুলতা পেরিয়ে, আলিঙ্গনের আলস্যে যেন সম্ভোগের শিহরন হয়ে ঝরে পড়ে তহ্নি কদম্বের সবুজ, আলুলায়িত পত্র শয্যা পরে। টুপ টাপ, টুপ টাপ শব্দে পত্রাগ্রের হীরক খণ্ড সম বারি বিন্দু যেন স্খলিত কামনা, ঠাস বুননে গড়া ঝিলমিলে সবুজ চাঁদোয়ার নীচে গলে পড়ে, অবলীলায়। ধীর ধারায়, কদম্বের দেহ বল্লরী বেয়ে গড়াতে-গড়াতে সেঁধিয়ে যায় মাটির সুদূর গোপনে।
ক্রমশ - জোরে, আরো জোরে নেমে আসে সে বৃষ্টি প্লাবন ধারা। কদম তলার ছায়া ধূসর, ভেজা মাটির প্রাঙ্গন - মুখরিত হতে থাকে বৃষ্টি ঝাঁপান গানে। পথে, উত্তাল ঝরনার মত উছলে পড়ে বৃষ্টিবতীর উদ্দাম আঁচল আর তার আঁচল জুড়ে ছেয়ে আসা লক্ষ বৃষ্টি-ধারা। ধুয়ে দিয়ে যায়, উতল বুকের কৃষ্ণবর্ণ পিচ রাস্তার ভরাট দেহ সৌষ্ঠব। জল ভারে অবনত, বৃত্তপুষ্প গুলো ঝুপ ঝুপ করে রাস্তার বুকে ছিতরে পড়ে নিদারুন সমাপতনে। ছাতা মাথায় হেঁটে যায় মানুষজন। জল কাদায় মাখামাখি হলদেটে-সাদা ছিন্ন ফুল রেণু মাড়িয়ে সাইকেল ছুটে যায় সাঁই সাঁই করে।
উলটোদিকে, নয়নজুলির জলে ভেসে থাকা কদম গাছের ছায়াটি - দমকে দমকে হয়ে পড়ে আলুথালু, বিস্রস্ত! বর্ষায় সপসপে কদম্ব শাখা, খানিক বাদে বাদেই মাতালের মত নেতিয়ে পড়ে জলের বুকে। আবার স্নানরত শালিখের মত ডানার জল ঝরিয়ে হাওয়ার দোলায় খানিক নেচে নেয় অবিলম্বিত লয়ে।
প্রকৃতিতে এমন কত কালজয়ী দৃশ্যপট রচিত হয়ে যায় সবার অলক্ষে, থেকে যায় অব্যক্ত, তার হিসেব রাখে কয়জনে।
আজকের দিনে এই অবিশ্রান্ত, কদম্ব বৃক্ষের উপর বর্ষা প্রক্ষেপণও কি জলের বুকে আঁকা আল্পনার মতই চিরতরে হারিয়ে যাবে প্রকৃতির স্মৃতি থেকে নাকি কালের আধারে কোনো স্মরনীয় গল্পের পটভূমি হয়ে ওঠার সাক্ষর-শিলা রেখে যাবে ভবিষ্যতের জন্যে! কেউ জানে না। ইতিমধ্যে, দূর থেকে ভেসে আসে ঘুঙুরের আওয়াজ। পৌষের মেঠো পথে যেমন চাষির কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া পাকা শস্যের বোঝা থেকে শোনা যায় ঝমা-ঝম শব্দ, দুলকি চালে গমকে গমকে, সেইরকম।
আসলে, শ্রাবণ মাস। তাই বাঁক কাঁধে  স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে শিবভক্ত মানুষ চলেছে বাবার মাথায় জল ঢালতে। ছেলেদের পরনে হাফ প্যান্ট, হাত কাটা গেঞ্জি আর কোমরে কষে পরা গেরুয়া গামছা। মেয়েদের পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। একটু একটু করে, পায়ে পায়ে সে মিছিল যত এগিয়ে আসে কদমতলার কাছাকাছি, প্রবল বৃষ্টির সোঁ সোঁ শব্দের মধ্যেও প্রকট হয়ে ওঠে জরি কাগজের ওপর প্লাস্টিকের ফুল, সাপ দিয়ে সাজানো সুদৃশ্য বাঁকে বাঁধা ঘুঙুরের ঘং ঘং শব্দ। 

কদমতলার মুখোমুখি হতেই - দল ভেঙে, ঝন্টু ছুট্টে চলে আসে গাছটির গোড়ায়। বাঁকটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, "ওঃ! বাঁচা গেল, যা বৃষ্টি!" পেছন পেছন দৌড়ে এসে ঢোকে মিতাও। বাকিরা চলে যায় যে যার মতন। মিতা ঝন্টুর পাড়ারই মেয়ে। ছোটবেলায় বর-বউ খেলার সময় ঝন্টু টোপরের মত করে কানের দু পাশে দুটি কদম ফুল ঝুলিয়ে বেশ বর বর ভাব করতো। "আয়, আয় এদিকে সরে আয়। এদিকে পাতার ছাউনি একটু ঘন," ঝন্টু মিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে ওর দিকে। মিতা বলে, "কদম ফুলের গন্ধটা কি দারুণ না?" 
বৃষ্টি ভেজা কদম ফুলের গন্ধে হঠাৎই যেন উস্কে ওঠে গোপন স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা। কি এক অপূরণীয় সাধ ছিল - জীবনের অন্ধ কুঠুরিতে বন্দি, হয়তো হারিয়েও গেছে স্মৃতির কানা গলিতে, তারই যেন পুনরুদ্ধার হয়, কদম ফুলের এই সুধীর, সুললিত সুবাসে। "মোবাইল আছে, তোমার কাছে?" মিতা জিজ্ঞাসা করে। "বড্ড বাঁশির ধুন শুনতে ইচ্ছা করছে!" ঝন্টু
 প্যান্টের পকেট থেকে সযত্নে মোবাইলটা বের করে ইউ টিউবে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাজানো বাঁশী বাজাতে থাকে। মেঘ মল্লার রাগে।
একদিকে হরিপ্রসাদের বাঁশী, সাথে বর্ষার টাপুর টুপুর যেন শিবকুমার শর্মার সন্তুর; রেশমী সুতোর মত বাতাসে উড়তে থাকে অদ্ভুত সে সিম্ফনি ধারা, ছড়িয়ে পড়ে - কদমতলা ছাড়িয়ে ক্রমশ দূরে আরো দূরে। আর, ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মত কদমতলায় দাঁড়িয়ে থাকে, পাশাপাশি যেন কলির শ্যাম আর রাই। যখন, নীপ পুষ্পের সৌরভে ভরা কদম্ব ছত্রের চারিদিকে বৃষ্টি ঝরে, ঠিক যেন অজস্র ফুল ঝারি ঘেরা রাস-বাসর একখানা।  
হঠাৎ টুপ করে একটা তরতাজা কদম ফুল, খসে পড়ে মিতার বুকে - আটকে যায়, ভেজা কাপড়ের ভাঁজে। খানিক চুপ থেকে, অধরতলে কিসের যেন প্লাবন চেপে রাখতে চেয়েও ব্যর্থ মিতা অস্ফুটে, কম্পিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্র গান, "বাদল দিনে, প্রথম কদম ফুল করেছো দান"
     

   


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...