সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্পঃ নয়া রূপান্তরের পথে শিয়ালদহ স্টেশন?

 একসময়ের জলা জঙ্গলে ভর্তি নীচু জমি, শোনা যেত শেয়ালের ডাক। তাই নাম ছিল শেয়াল-দিহি (জলে ঘেরা ভূ- খণ্ড) ক্রমে ক্রমে তা সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে শিয়ালদহ বা শিয়ালদা নামে। 

১৮৬২ সালে Eastern Bengal Railway Company কোলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়া পর্যন্ত রেল পথের সূচনা করে। আর কোলকাতার টার্মিনাল স্টেশন তৈরি করতে বেছে নেওয়া হয় এই শিয়ালদহকেই। শুরুতে একটা ছোট টিনের চালা দেওয়া ঘরেই চালানো হত স্টেশনের কাজকর্ম। সেই শুরু, সেদিনকার সেই অখ্যাত শিয়ালদহের আজকের দিনে পৌঁছে ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ এবং ব্যস্ত রেলওয়ে টার্মিনাল হয়ে ওঠার সুদীর্ঘ যাত্রাপথের। আসলে অবস্থান গত কারণে, বিশেষ করে শহরতলীর বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে, শিয়ালদহ ক্রমশই অপরিহার্য হয়ে ওঠে তদানীন্তন রেল কোম্পানির কাছে। যার ফলে ১৮৬৯ সালে প্ল্যাটফর্ম বিশিষ্ট নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করতে হয় ওখানে। যার নকশা তৈরি করেন Mr. Walter Glanville. 

তারপরে এক এক করে কেটে গেছে ১৬১ টি বছর, নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ওঠা পড়া, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন আজ তার বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে উত্তর বা মেইন ও দক্ষিণ এই দুটি টার্মিনাল বিশিষ্ট শিয়ালদহ স্টেশনে রয়েছে ২৮ টি ট্র্যাক ২১ টি প্ল্যাটফর্ম। সংলগ্ন মেট্রো স্টেশন মিলিয়ে প্রত্যহ মিলিয়ন অর্থাৎ ২০ লক্ষ মানুষ ব্যবহার করেন এই স্টেশন। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের যাত্রীদেরও ভারতে ঢোকার প্রধান গেটওয়ে এই স্টেশন। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। আর সেই গুরুত্বকে যথাযথ মর্যাদা দিতে ভারত সরকার শিয়ালদহ স্টেশনকে অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে এই প্রকল্পের অধীনে প্রায় ২৭ কোটি তাকা খরচ করে শিয়ালদহ স্টেশন এবং স্টেশন চত্বরকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত সরকারের রেল মন্ত্রক।

যার শুভ শিলান্যাস করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী আগস্ট সকাল ১১ টায় ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে। দেশ জুড়ে এই প্রকল্পের অধীনে মোট ১২৭৫ টি রেল স্টেশনের পুনর্নবীকরনের যে কর্মসুচী স্থির করেছে সরকার, প্রথম পর্যায়ে আপাতত ৫০৮ টি স্টেশনকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। যার জন্যে প্রাথমিক ভাবে ২৪,৪৭০ কোটি টাকা ব্যায় বরাদ্দ ধার্য করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। বাংলার সামগ্রিক ভাবে ৯৪ টি স্টেশনের মধ্যে প্রথম পর্বে ৩৭ টি স্টেশনে প্রকল্প রুপায়নের কাজ শুরু হয়ে যাবে আগস্ট থেকে, প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরেই। এই উপলক্ষে ঠা আগস্ট, অর্থাৎ অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্পের শুভ উদ্বোধনের এক দিন আগে, শিয়ালদহ স্টেশনে এসেছিলেন পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার অলক প্রসাদ দ্বিবেদী। খবরে প্রকাশ দ্বিবেদী স্টেশন আধুনিকীকরনের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, “পূর্ব রেলের ২৮ টি স্টেশনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হবে। আধুনিক ব্যবস্থাও রাখা হবে স্টেশন গুলিতে"। এক প্রশ্নের উত্তরে দ্বিবেদী আরো জানান, “শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড়ের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যার পাকাপাকি সমাধান চায় রেল"। সূত্রে প্রকাশ, যাত্রী স্বাচ্ছ্যন্দ বাড়াতে বদ্ধপরিকর রেল কর্তৃপক্ষ আশা ব্যক্ত করেছেন, এই প্রকল্প কার্যকরী হলে শিয়ালদহ স্টেশনের প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম, শৌচাগার, বিশ্রামকক্ষ সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে। সুত্রের খবর, রেল অমৃত ভারত স্টেশনের মর্যাদা পাওয়া স্টেশন গুলিকে সিটি সেন্টারের আদলে গড়ে তুলতে চায়।
তাহলে
শিয়ালদহ স্টেশন কি ভবিষ্যতে কোনো সিটি সেন্টারের মত দেখতে লাগবেসম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রেল, আগামী দিনে শিয়ালদহ স্টেশনকে কেমন দেখতে লাগবে তার একটা সম্ভাব্য ছবি প্রকাশ্যে এনেছে যা দেখে সকলেই বেশ উচ্ছ্বসিত। কারণ অনেকের চোখে প্রকল্প রুপায়িত হওয়ার পর শিয়ালদহ স্টেশনকে অনেকটা বিমান বন্দরের মত দেখতে লাগবে বলে মনে হয়েছে। আগামী দিনে শিয়ালদহ স্টেশনের এই নব রুপান্তর নিশ্চিত ভাবে তার রত্নখচিত মুকুটে যোগ হওয়া নতুন রত্ন হিসেবেই পরিগণিত হবে। 
দশকের পর দশক সময় পেরিয়ে গেছে, শিয়ালদহ স্টেশন সাক্ষী থেকেছে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বহু স্মরনীয় ঘটনার। শিকাগোতে বিশ্ববিজয় করে ফেরা স্বামীজীর কোলকাতার মাটিতে শুভ পদার্পণের সঙ্গে যেমন তার নাম জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে, তেমনি ১৯৪৭ দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া কাতারে কাতারে উদভ্রান্ত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠার কথাও ইতিহাসে লেখা আছে বড় বড় করে
আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালদহ স্টেশন নিজেকে পাল্টে নিয়েছে বারবার; বিবর্তিত হয়েছে যাত্রীদের নতুন নতুন চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
আগে যেখানে গুটি কয় বই এর স্টল এবং চাস্ন্যাক্সের দোকান ছাড়া কিছুই ছিল না, এখন সেখানে রীতিমত শপিং মল, ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ, সর্বোপরি সারি সারি স্বর্ণ বিপনী স্টেশনের অন্দরমহলকে যে অনেকটাই বিপণনযোগ্য করে তুলেছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর এত সব সামলে, শিয়ালদহ স্টেশন আবার এক ঐতিহাসিক বিবর্তনের সামনে এবং যথারীতি সময়ের দাবী মেনে নতুন রূপান্তরের পথে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...