সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভেনিসের পথে পর্দায় বঙ্গজ হিরো অভিষেক!

 ভেনিস আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, বরাবরই বাঙালী তার দাপট দেখিয়ে এসেছে। ইটালির ভেনিস শহরে অনুষ্ঠিত হওয়া এই চলচ্চিত্র উৎসব, কৌলীন্যের দিক থেকে পৃথিবীর প্রাচীনতম। সেই ১৯৩২ সাল থেকে প্রতি বছর আয়োজিত হয়ে আসা এই ফিল্ম ফেস্ট (মাঝখানে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে বন্ধ থাকা কয়েক বছর বাদ দিলে), এবার তার ৮০ তম বর্ষে পদার্পণ করছে। চলচ্চিত্র ইতিহাসের শুরু থেকেই, বাঙালী তার প্রতিভার উৎকর্ষ দেখিয়ে এসেছে চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।  সে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে কোনো পরিসরেই হোক না কেন, বাঙালীর মেধার বিচ্ছুরন থেকে বঞ্চিত হয় নি কেউই। বিশেষ করে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টে দেখানো বিভিন্ন সময়ের বাংলা ছবিগুলি যে বারে বারে ইটালির এই ভাসমান নগরীর হৃদয়কে জয় করে নিয়েছে অবলীলায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 
যেমন ১৯৩৪ সালে দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ছবি ‘সীতা’। ছবিটি, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো প্রথম ভারতীয় ছবি ছিল। আর প্রথম বারেই জিতে নিয়েছিল Honorary Diploma Award.   তারপরে এল সেই ১৯৫৭ সাল, বাংলা ছবির ইতিহাসে যে সালের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চির কাল।  কারণ ওই বছর, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্ব শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার Golden Lion Award পায় সত্যজিত রায় পরিচালিত অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’। এর পর, ২০০০ সাল। পরিচালক হিসেবে তাঁর অসামান্য দক্ষতার পুরষ্কার স্বরূপ, ‘উত্তরা’ ছবির পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে Special Director Award এ ভূষিত করে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল । এরপর ২০১৪ এবং ২০২১ এ পর পর সাত বছরের মধ্যে তরুন পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের দুটি ছবি যথাক্রমে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ (Labour of Love) এবং শ্রীলেখা মিত্র, ব্রাত্য বসু অভিনীত ‘Once upon a time in Kolkata’ - ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ বিভাগে মনোনীত হয়েছিল প্রদর্শিত হওয়ার জন্য। আর এই ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে, এবার বাঙালী অভিনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যাবে ভেনিস ফিল্ম ফেস্ট এর Extra Horizon  বিভাগে মনোনীত হওয়া একমাত্র ভারতীয় ছবি ‘Stolen’ এর মূল চরিত্রে অভিনয় করতে।

 ছবিটি অবশ্য বলিউডে নির্মিত একটি হিন্দি ছবি। এবং চিত্রনাট্যকার হিসেবে পরিচিত করণ তেজপালের পরিচালনা করা প্রথম ছবি। পাশাপাশি করণ এই ছবিটির কাহিনীও লিখেছেন সহযোগী গৌরব ধিংরার সঙ্গে যৌথ ভাবে, যা এই ছবিটির মূল আকর্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে।  কিন্তু কি এই কাহিনী? 
চুম্বকে, এক প্রান্তিক আদিবাসী মহিলার পাঁচ মাস বয়স্ক শিশু সন্তানের চুরি যাওয়ার ঘটনা এবং তার ফলে উদ্ভুত অভূতপূর্ব নাটকীয় পরিস্থিতি।  রোমহর্ষক এই শিশু অপহরনের ঘটনাটি ঘটে এক প্রত্যন্ত রেলওয়ে স্টেশনে।  প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দুই ভাই গৌতম এবং রামন মহিলাটিকে সাহায্য করতে গিয়ে কি ভাবে তদন্তের জটিলতায় নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের কি পরিনতি হয় তাই নিয়ে গল্পটি এগোতে থাকে নানা নাটকীয় মুহূর্তকে সাথে করে, যা নিয়ে উৎসাহী দর্শকদের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বোপরি, এই ছবির মূল চরিত্র - গৌতম, যার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যাবে বঙ্গজ হিরো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যাকে নিয়ে সিনে-ভক্ত বাঙালীদের মধ্য ইতিমধ্যে বেশ কৌতূহল দেখা দিয়েছে। খড়গপুরে জন্ম, অধুনা মুম্বাই নিবাসী অভিষেক এই ছবির কাহিনী নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, “গল্পটির শেকড় ভারতে প্রোথিত হলেও এর আবেদন বিশ্বজনীন”। বিশেষ করে গল্পের মধ্যে যে মানবিকতার টানাপড়েন রয়েছে এবং সেটা যে তাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছে, সেটা বলতে ভোলেন না বলিউডের এই অভিনেতা তথা কাস্টিং পরিচালক। এটা ঠিক, অভিষেককে এখনো টলিউডের কোনো ছবিতে দেখা যায় নি। বাঙালীর কাছে এখনো অব্দি অভিষেকের পরিচয় ভায়া বলিউড হয়ে। তাই হয়তো, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মনোনীত হওয়া কোনো ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করা অভিষেকের জন্য সে তিনি বঙ্গজ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালীর তেমন আবেগ বিহ্বল হয়ে ওঠা হচ্ছে না।  এই জিনিস দেব কিংবা অঙ্কুশদের বেলায় ঘটলে বাঙালী যে উৎসাহের আতিশয্য দেখাতে পারতো, অভিষেকের বেলায় সেটা পারছেনা। যদিও অভিষেক তার বঙ্গ- যোগ নিয়ে যে বেশ শ্লাঘা বোধ করেন সেটা তাঁর কথাতেই পরিষ্কার।  ১৯৮৫’ র ৫ই মে তারিখে জন্ম গ্রহন করা অভিষেক, বাবা অলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা সুমিরা দেবীর এক মাত্র সন্তান। বাবা চেয়েছিলেন পড়াশুনা করে ছেলে একটা ভালো চাকরি করবে, যেটা প্রায় আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালীর এক এবং একমাত্র আকাঙ্খা। কিন্তু অভিষেক যে বাঁধাধরা জীবনের নিরাপদ গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখতে চান না। তাই তিনি দিল্লির নামী কলেজ থেকে কম্পিউটার সাইন্স এর মত কোর্স মাঝপথে ছেড়ে দেন এবং নেমে পড়েন নিজের স্বপ্ন সফল করার লক্ষে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের লড়াইয়ে। প্রথম সুযোগ পান 'রং দে বাসন্তী' ছবিতে। তারপর একে একে ‘স্ত্রী’, ‘টাইপরাইটার’, ‘পাতাল লোক’ প্রভৃতি বলিউডি ছবিতে তিনি প্রমান করেন তার অভিনয় দক্ষতা। কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবেও তিনি পেয়েছেন স্বীকৃতি এবং সুনাম। মুম্বাইয়ে খুলেছেন ‘Casting Bay’  নামক - রূপালী পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনের পরামর্শদাতা সংস্থা। এবং অবশেষে এসেছে - করণ তেজপালের এই ছবি, ‘Stolen’, যেটি আগামী ৩০শে আগস্ট থেকে ৯ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভেনিসের Lido  দ্বীপের ভেনিস লাগুনে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে বিশেষ প্রিমিয়ার শোয়ে। দৃশ্যতই খুশি অভিষেকের বাবা মা, যারা এখনো খড়গপুরেই থাকেন, এই গৌরবের কৃতিত্ব ছেলেকেই দিয়ে বলেছেন, “ওর কঠিন লড়াই এবং পরিশ্রম বিফলে যায় নি"।

অভিষেক এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে সংবাদ মাধ্যমের কাছে বলেছেন, “বাঙালী হিসেবে আমার দারুণ ভালো লাগছে যে আমার ছবি এমন একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছে, যেখানে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ দেখানো হয়েছিল”।
অভিষেক ছাড়াও এই ছবির অন্যান্য চরিত্রে দেখা যাবে হরিশ খান্না, সহিদুর রহমান, শুভম এর মত অভিনেতাদের।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...