চলতি বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে হঠাৎই বাঙালীর
রান্নাঘরের ডার্লিং সব্জী, টমেটোর দাম ঊর্ধ্বগামী হওয়া শুরু করে। এবং অল্প কিছু
দিনের মধ্যে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। প্রতি কেজি ৪০ টাকা থেকে সটান হাউইয়ের পেছনে
আগুন দিলে যেমন দ্রুততার সঙ্গে উপরে উঠে যায় তেমনি এক কেজি টমেটোর দাম পৌঁছে যায় একেবারে ২৫০ টাকায়, যা এককথায় সর্বকালের রেকর্ড।
বাজারে যে কোনো জিনিসেরই দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ চাহিদা আর জোগানের মধ্যে ফারাক। বিশেষ
করে যদি জোগান কমে যায়, তাহলে চাহিদা না বাড়লেও দাম বৃদ্ধির একটা সম্ভাবনা থেকে
যায়। বাজারে কোনো পণ্যের আমদানিতে যদি হঠাৎ করে টান পড়ে তাহলে তার পেছনে থাকা অন্য
অনেক কারণের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট পণ্যের উপরে মুনাফা খোর কালোবাজারিদের কুনজর পড়েছে
বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কৃষিজ পণ্যের ক্ষেত্রে, রহস্যজনক ভাবে কালোবাজারিরা পার
পেয়ে যায়। কারণ জোগান কমে যাওয়ার জন্যে হাতের কাছে প্রকৃতির বিরূপতা তো রয়েছে যত
দোষের, নন্দ ঘোষ, যাকে খুব সহজেই ভিলেন বানানো যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
কৃষি বিপণন টাস্ক ফোর্স এর সভাপতি কমল দে Times of India কে বলেছেন, এবছর প্রচণ্ড
গরমের কারণে হিমাচল এবং কর্ণাটকে টমেটোর চাষ দারুণ ভাবে মার খেয়েছে। যে কারণে গত বছরের তুলনায় টমেটো উৎপাদন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে
গেছে। বিশেষজ্ঞদের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, উষ্ণ আবহের মধ্যে টমেটো গাছের পাতায় একধরনের ভাইরাস সংক্রমণের ফলেই টমেটো উৎপাদনের এই বিপর্যয়। কিন্তু আমরা যারা রোজ বাজারকে দেখি, তাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া বোধহয় অত সহজ নয়।
কারণ যবে থেকে টমেটোর দাম বাড়া শুরু হয়েছে, বাজার সূত্র মানলে টমেটোর বাজার থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা বা খুঁজে-পেতে কোথাও যদি পাওয়া গেল তাও যথেষ্ট নয়, এইরকমের একটা বাজারি রবে সরগরম থাকার কথা চারিদিক।
কিন্তু বাজারে টমেটো তো পাওয়া যাচ্ছিল, শুধু বিক্রেতারা দাম হাঁকাচ্ছিল কখনো ২০০ আবার কখনো ২৫০।
বাঙালী, টমেটো কে প্রায় আলুর মতই সবরকমের পদে একেবারে অপরিহার্য করে ফেলেছিল। এমনকি খাওয়ার শেষে শসা, পেঁয়াজের সঙ্গে টমেটোর স্লাইস ছাড়া স্যালাড যেন বাঙালীর পাতে বড়ই বেমানান ঠেকত। কিন্তু সেই বাঙালীর কি হল? শুধু দাম জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছেন, কেনার কথা ভাবছেনইনা।
আসলে টমেটোর হঠাৎ দেমাক (দাম) বেড়ে যাওয়াকে, বাঙালী ভালো ভাবে নেয়নি। কেমন একটা চাপ চাপ অভিমান, ভাবখানা এইরকম তোমাকে ছাড়াও আমি বাঁচতে পারি। নজর ঘুরিয়ে বরং সস্তার বেগুন বরবটি কেনার জন্য লাইন দেব। দেখব, কতদিন আর পাতানো প্লাস্টিকের উপর ডাঁই হয়ে পড়ে থাকবে অবিক্রিত হয়ে। রান্নাঘরের সঙ্গে টমেটোর এই বিচ্ছেদ পর্বে, প্রায় একটা স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল বলা চলে টমেটো আর মানুষের মধ্যে। কে যে আগে আড় ভেঙ্গে কার কাছে পৌঁছবে, সেটাই ছিল লাখ টাকার প্রশ্ন।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সাধারন আম ক্রেতাদেরই জয় হল।
কারণ টমেটোকেই দেখা গেল, প্রথম তার অহং ছেড়ে, দামের যে মিনার তৈরি করেছিল সে গত তিন মাস ধরে তার চূড়া থেকে একেবারে তর তর করে নেমে সাধারনের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে চলে আসতে; আজকের দিনে (১৯ শে আগস্ট, ২০২৩) তাই দেখা যাচ্ছে টমেটো তার নিজের রেটটাকে অনেকটা নমনীয় করে ফেলেছে। এবং যে দরটা হাঁকছে সেটা আর -২০০ নয়, ১৫০ নয় এমনকি ১০০ ও নয় একেবারে ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা প্রতি কিলো।
ব্যাপারটা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, Times of India - একেবারে প্রথম পাতায় টমেটোর এই ১০০ এর নীচে নেমে যাওয়ার খবরটাকে ছেপেছে বেশ বড় শিরোনামে।
প্রায় ১২ সপ্তাহ ধরে চলা এই উচ্চমূল্যের রেশ যে শেষমেশ কাটতে চলেছে, তার একটা আভাস দিয়ে সংবাদটিতে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলায় চাষ হওয়া টমেটো বাজারে আসতে শুরু করলে দাম আরো কমবে।
চলতি বছরের এই অভূতপূর্ব টমেটো যুদ্ধে কিন্তু সাধারন মানুষের সামনে বাজারকেই নতজানু হতে দেখা গেল। যে সকল অসাধু ব্যবসায়ী ভাবেন যে বাজার তারা নিয়ন্ত্রন করবেন তাদের স্বার্থ অনুসারে, তাদের সে ভুল ভাঙতে বাধ্য। এবারের এই টমেটো পর্ব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বাজারের মন ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রন করে না, বাজারের মন তৈরি হয় সাধারন ক্রেতাদের ইচ্ছায়।
সবশেষে একটা আশঙ্কার কথা বলতেই হবে, সেটা হল রান্নাঘরের এই টমেটো রহিত থাকার অভ্যাসটা যদি স্থিতিস্থাপকতার রীতি মেনে আগের সম্পর্কে ফিরে যেতে না চায়? টমেটোর বিরহ যাতনা তো তাহলে বস্তা পচা সেন্টিমেন্ট হয়ে যাবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন