সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

এবারের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, জন ফস চেয়েছিলেন রক গিটারিস্ট হতে!

নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে তখন দুপুর ১ টা। দেশের পশ্চিম উপকূলের একটি শান্ত পথ, সমুদ্র খাঁড়ির (Fjord) ধার ধরে চলে গেছে হাউজসুণ্ডের দিকে। সূর্য মধ্যগগনে, তাই পথ ঘাট তেমন জনাকীর্ণ ছিল না, ফোর্ডের। গাড়ি, ঘোড়াও দেখা যাচ্ছিলো না সেভাবে। নিশ্চিন্তে ফোর্ডের পথ ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, প্রায় বার্ধক্যের দ্বারে উপনীত ৬৪ বছর বয়সি এক প্রৌঢ়। কিছুটা দূরেই ওনার বাসস্থান। গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভালোই উপভোগ করছিলেন নির্জনতার শান্তি। এমন সময়ে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল, খানিক বেরসিকের মতন। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বার, প্রৌঢ়ের কাছে অপরিচিত। ফোনটা ধরে, বিরক্তি সহকারে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল এক রাশভারী কণ্ঠস্বর, “আমি কি জন ফসের সঙ্গে কথা বলছি?” “হ্যাঁ, বলুন।“ “আমি সুইডিশ নোবেল কমিটির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি Mats Malm বলছি।“ প্রৌঢ় এবার একটু নড়ে চড়ে বসলেন। কণ্ঠ স্বরে বিরক্তির জায়গায়, আনন্দঘন বিস্ময়। কিন্তু তখনই আনন্দে ফেটে পড়তে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত তিনি। কারণ গত দশ বছর ধরে তার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও শেষ মুহূর্তে এসে তার নাম বাদ গেছে লিস্ট থেকে। এবার যাতে তেমন না হয়, ফস ফের একবার শুনতে চেয়ে Mats Malm কে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঠিক শুনছি তো?” ওপার থেকে মিস্টার Mats দৃপ্ত কণ্ঠে জানালেন, “ঠিকই শুনেছেন, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ এর সাহিত্যে নোবেল প্রাপক আপনিই।"

“যদি না বিশ্বাস হয়, টেলিভিশন দেখুন বা আপনার message box চেক করে নিন।
৫ই অক্টোবর, ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটে, সুইডেনের স্টকহোমে আয়োজিত এক বিশেষ প্রেস মিটে, সুইডিশ নোবেল কমিটি এবছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ফসের নাম ঘোষণা করার পরে এভাবেই খবরটি পৌঁছোয় তাঁর কাছে। 
জন ফস, সাহিত্য চর্চা করেন নরওয়ের সংখ্যালঘু, প্রান্তিক মানুষের ভাষা নাইন্রস্ক –এ। তার লেখা উপন্যাস, নাটক, কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ সব কিছুতেই থাকে প্রান্তিক মানুষের কথা। ৫ই অক্টোবরের প্রেস মিটে, সাহিত্য সংক্রান্ত নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান
Anders Olsson বলেন, “ফস, তার রচিত যাবতীয় নাটক ও গদ্যের মধ্যে অত্যন্ত নিপুনতার সঙ্গে অকথ্যদের কথা তুলে ধরেছেন।“ (Voice to unsayable)
কৈশোরে, ফস হতে চেয়েছিলেন রক গিটারিস্ট। বাজাতেন বাঁশিও। তখন যতটুকু লেখালেখি করেছেন সবই ছিল গিটার বা বাঁশির সুরে গাওয়া গানের কথা। যৌবনে প্রভাবিত হয়েছেন কমিউনিজমে। তথাকথিত নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাসী জন ফস, নিজেকে হিপি বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ তাকে সাহিত্যিক হিসেবেই মনে রাখবে। শৈশবে মাত্র সাত বছর বয়সে পড়েছিলেন এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায়। যে দুর্ঘটনার স্মৃতিকে ফস তাঁর জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে মনে করেন। তাঁর আজকের এই জায়গায় পৌঁছানোর পেছনে এই দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা মস্ত বড় অনুঘটকের কাজ করেছে বলে ফসের ধারনা। Strandebarm এর মফস্বলী জল হাওয়ায় বড় হওয়া জন ফসের প্রথম লেখা বের হয় ১৯৮৩ তে, যখন তাঁর বয়স ২৪। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনাটি ছিল একটি উপন্যাস Raudt, Svart (Red, Black).  প্রথম লেখাতেই পাঠক বুঝতে পেরেছিলেন এক ব্যতিক্রমী ঘরানার লেখক এই ফস। ক্রমশ, তাঁর পরের লেখাগুলিতেও সেই একই শৈলীর পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়। পাঠকের ধারনা, ফসের মত লেখা না আগে কেউ লিখেছে না আগামীতে কেউ লিখবে। কিন্তু ফস, জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছান নাটক লিখেই। প্রথম নাটক লেখেন, ‘Someone is Going to Come’  তারপরে লেখেন  ‘And never shall we part’.  ১৯৯৪ সালে এটি মঞ্চস্থ হয় Bergen এর ন্যাশনাল থিয়েটারে। নাটক লিখিয়ে হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রথম ছড়িয়ে পড়ে যখন ফরাসি নাট্য পরিচালক Claude Rigy  তাঁর লেখা নাটক ‘Someone is Going to Come’ কে Nanterre থিয়েটারে মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন ১৯৯৯ সালে। এখনো পর্যন্ত ৩০ এর উপরে নাটক লিখেছেন ফস। সফল নাট্যকার হিসেবে নরওয়েতে তাঁর সামনে কেবল Henrik Ibsen কেই ধরা হয়। কিন্তু ফসের দীর্ঘ সময় ধরে লেখা উপন্যাস ত্রয়ী – ‘Aliss at the Fire’, ‘Melancholy’ এবং  ‘A shining’ যা  Septology হিসেবে বিখ্যাত এবং যে উপন্যাস ত্রয়ী ফসকে দিয়েছে অকথ্যের লেখক হিসেবে বিশ্ব জোড়া পরিচিতি এবং সর্বোপরি যে উপন্যাস ২০২২ সালে ফসকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সম্মান, তার কথা না উল্লেখ করলেই নয়। 
নাটক, উপন্যাস ছাড়াও ফস লেখেছেন শিশুদের জন্য বই। করেছেন অনুবাদ। কিন্তু নিভৃতচারী জন ফস, মানুষের ভিড়ে তেমন স্বস্তি বোধ করেন না। পছন্দ করেন ই-মেল এর মাধ্যমে যাবতীয় যোগাযোগ সম্পন্ন করতে। নোবেল প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার পরে জন ফস, মনীষা লালুর সঙ্গে এক দূরভাষ বার্তালাপে জানিয়েছেন নোবেল প্রাপ্তির খবরে তাঁর অনুভূতির কথা।  “I was honestly surprised!”, অকপটে তাঁর বিস্ময়ের কথা জানিয়েছেন ফস, মনীষাকে। অন্যদিকে, সারা পৃথিবী থেকে আসা শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে তাঁর ইন-বক্স। সব গুলোই গতানুগতিক অভিনন্দন বার্তা। কিন্তু এর মধ্যে এক গ্রীক রমনীর পাঠানো ই-মেল ফসকে নাড়িয়ে দিয়েছে ভিতর থেকে। যিনি ফসের নাটক, ‘Death Variation’ এর উল্লেখ করে বলেছেন তিনি এখনো বেঁচে আছেন এই নাটকটির জন্যে। উল্লেখ্য এই নাটকটির বিষয় ছিল আত্মহত্যা।
এক প্রশ্নের উত্তরে, নতুন লেখকদের জন্য ফসের উপদেশ – অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে কোনো কিছু না লিখতে। যে যাই বলুক, নিজের মন যা বলছে বা ভাবছে তাই প্রকাশ করতে হবে লিখিত শব্দে। তিনি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলে বলেছেন, তাঁর প্রথম দিকের লেখা নাটক, উপন্যাসের প্রশংসা কোনো সমালোচকই করেননি। তাঁর মতে, “
To what I know is good writing”
ফস আসলে এক স্বপ্নের লেখক, যিনি বাস্তবের মাটিতে বুনে চলেন স্বপ্নের বীজ। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি যখন লেখেন তখন তিনি তাঁর নিজের মধ্যে থাকেন না। চলে যান অন্য জগতে। 
প্রসঙ্গত, নোবেল পুরস্কার যার অর্থমূল্য ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনো, যা গত বারের তুলনায় ১ মিলিয়ন বেশি, পূর্ব নির্ধারিত ডিসেম্বরের ১০ তারিখে তুলে দেওয়া হবে জন ফস সহ অন্য বিজয়ীদের হাতে।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...