শাস্ত্রে আছে, কুপুত্র যদিও বা কুমাতা কখনো নয়। তারপরে আবার সেই মা যদি কোনো এক ব্যক্তির
শুধু না হয়ে পুরো জগতের মা জগজ্জননী দুর্গা হন, তখন তো সন্তানদের আব্দার মেটানো ছাড়া তাঁর আর কোনো
উপায় থাকে না।
এক্ষেত্রেও তাই হল। এই কদিন
আগে তিনি ফিরে গেছেন কৈলাসে। কিন্তু তাতে কি! সন্তানদের মনোবাঞ্ছা পূরণে, মা যে
সদা প্রযত্নবান। আর তাই তো মা দুর্গাকে ফের বাপের বাড়ি আসার জন্যে, ইচ্ছে না
থাকলেও সেই বাবার কাছে ছুটির আব্দার জানাতেই হল। যদিও আধবেলার জন্যে। কিন্তু
তাহলেও বাবা মহাদেবের ঘরনীকে তো তাঁর সংসার ফেলে আসতে হবে সুদূর সেই কৈলাস থেকে এতটা
পথ ডিঙ্গিয়ে। ভাবা যায়।
বাবা এমনিতে মাকে খুব একটা কাছ ছাড়া করতে রাজি হন না। আর
এবার তো মাকে কোলকাতা শহরের রাজপথের উপর একেবারে র্যাম্পে হাঁটার মত করে হেঁটে যেতে
হবে দেশী বিদেশী অতিথি অভ্যাগতদের সামনে! বাবা যদি জানতেন তো, আর একটা দক্ষ যজ্ঞ
বাধিয়ে বসতেন নির্ঘাত।
আসলে মা, আমাদের মার্কেটিং টা ভালোই বোঝেন। কারন বিশ্বায়নের যুগে আমরা সকলেই জানি,
সেই নিউইয়র্ক থেকে নরওয়ে সর্বত্রই মা
আমাদের পূজিতা হন ভীষণ সমাদরে। কৈলাস থেকে যেমন এ বছর ঘোড়ায় আসলেও, কুমোরটুলি থেকে
তাঁকে সেই প্লেনে করেই পাড়ি দিতে হয় সুদূর সেই কালাপাণির দেশে। কিন্তু হিমালয়
কন্যা মা পার্বতী ভালোই জানেন যে তাঁর পূজা-অর্চনার এপিক সেন্টার বলে যদি কিছু
থাকে, তা হল এই পোড়া বাংলা।
তাই সে যত কষ্টই হোক না কেন, বাংলার ডাকে
তাঁকে সাড়া দিতেই হবে। আর সে ডাক যদি আসে বঙ্গের অধীশ্বরী থুড়ি বাংলার মাননীয়া
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়র কাছ থেকে, তাহলে তো আর ‘না’ বলার জো নেই।
সেই
২০১৬ সাল থেকে, মাঝখানে কোভিডের কারনে ২০২০ এবং ২০২১ বাদ দিলে, প্রায় প্রতি বছর
মাননীয়ার ইচ্ছানুসারে আমাদের চিন্তাময়ী মাকে অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও সারা জগতের চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে চলে আসতে হয় রেড রোডে। এ বড় কম কথা নয়।
সূত্র অনুসারে, এবছর ১৪টা
দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকবেন রেড রোডের দুর্গা কার্নিভ্যালে। থাকবেন
মুখ্যমন্ত্রীও, যিনি সম্প্রতি তাঁর স্পেন সফর কালে পায়ে চোট পেয়ে নিজ গৃহে
চিকিৎসাধীন ছিলেন দীর্ঘ দিন।
কার্নিভ্যাল শুরু হবে বিকেল ৪ টা থেকে; চলবে রাত্রি
১০ টা পর্যন্ত। অংশ নেবে ১০০ টির মত নামী দামী পুজোর দুর্গা প্রতিমা, এবং বলাই
বাহুল্য এই হণ্টন জৌলুসে দুর্গার সঙ্গে কার্ত্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সহ
মহিষাসুর, সব্বাই থাকবেন।
এর পাশাপাশি, প্রতি দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে থাকবে সংশ্লিষ্ট পুজো
ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে আনা সুদৃশ্য ট্যাবলয়েড। থাকবে নৃত্য- সঙ্গীত পরিবেশনের
ব্যবস্থাও। মায়ের হয় তো অপমানিত বোধ হতে পারে, কিন্তু কিছু করার নেই। এত গুলো পুজো,
সবাইকে তো স্থান দিতে হবে।
তাই মাননীয়া এবং তাঁর পারিষদ বর্গ যেখানে অধিষ্ঠান
করবেন, সেই মূল মঞ্চের সামনে মাত্র তিন মিনিট দেবী দুর্গা থামতে পারবেন এবং
মুখ্যমন্ত্রীর অভিবাদন গ্রহন করতে পারবেন। ফ্রান্স, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, তাদের প্রতিনিধি, আমলা,
শিল্পপতি সহ অন্যান্য আমন্ত্রিত মিলিয়ে প্রায় ১৮০০০ আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে
পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তর দ্বারা আয়োজিত আজকের (২৭ শে অক্টোবর) এই দুর্গা
কার্নিভ্যালে।
আর একটা ব্যপারে মা দুর্গার হয়তো খানিকটা গোসা হলেও হতে পারে, কারন এত বড় জৌলুসের
ওপেনিং পারফর্মার তিনি নন। তাঁর জায়গায় কার্নিভ্যাল শুরু করবেন ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলির
নৃত্যপটীয়সী পত্নী ডোনা দেবী। কিন্তু কি আর করবেন, মা। শুধু মূক বদনে মেনে নেওয়া
ছাড়া?
কার্নিভ্যাল কথাটি আসলে এসেছে রোমান ক্যাথোলিক দেশগুলি থেকে। দেশগুলিতে, ভগবান যিশুর
পুনরুত্থানের স্মরনে দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে চলে কঠিন উপবাস পর্ব, যাকে Lenten Season বলে। আর তথাকথিত সেই মঙ্গল ঋতুর শুরুতে যে জৌলুস বেরোয় রাজপথে - তাকেই
কার্নিভ্যাল নামে অভিহিত করা হয়।
সে যাই হোক, এই কার্নিভ্যালে অংশগ্রহণকারী
অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে ঐতিহ্যশালী গড়িয়ার নব দুর্গাও সামিল হবেন
আপন মহিমায় দশদিক উদ্ভাসিত করতে।
থাকবে শ্রীভুমি স্পোর্টিং ক্লাব থেকে শুরু করে কলেজ
স্কয়ারের দুর্গা প্রতিমা। তবে উপস্থিত থাকবেনা বিজেপি নেতা সজল ঘোষের পুজো, সন্তোষ
মিত্র পার্কের দুর্গা মূর্তি।
আর উপস্থিত থাকবে না দীর্ঘ দিন ধরে চাকরির দাবীতে ধর্নায় বসা ‘যোগ্য’ চাকরী
প্রার্থীরা। প্রসঙ্গত এদের ধর্না স্থল দুটির একটি মাতঙগীনী হাজরা এবং অন্যটি গান্ধী
মূর্তির পাদদেশে রয়েছে আজ অনেক দিন ধরে। ভৌগলিক ভাবে যা রেড রোড সংলগ্ন। খবরে প্রকাশ, নিরাপত্তার কারনে ময়দান থানা ধর্নাকারীদের ২৭ শে অক্টোবর, শুক্রবার তাদের ধর্ণা বন্ধ
রেখে জায়গা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। ধর্নাকারীরা সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে একদিনের
জন্যে তাদের ধর্না বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তারা বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বরং
তাদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে একটা নিয়োগ কার্নিভালের আয়োজন করুক। এখন দেখা যাক, সরকার
এই আবেদনে সাড়া দেয় কি না।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই যে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা
নেবেন, তাতে অন্তত আর কেউ খুশি হোক বা না হোক, মা দুর্গা ঠিক খুশি হবেন। বাবাকে
গিয়ে অন্তত বলতে পারবেন, একটা ভালো কাজের জন্যে তিনি কতটা পথ হাঁটতে পারেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন