সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইয়া দেবী সর্বভূতেষূ শিউলি রূপেণ সংস্থিতা!

ইয়া দেবী সর্বভূতেষূ শিউলি রূপেণ সংস্থিতা! নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।। কিন্তু কেন শিউলি রূপেণ সংস্থিতা? উত্তর দেওয়ার আগে, একটা গল্প বলি। গল্পের মূল চরিত্র একটি মেয়ে তার নাম পারিজাতিকা। পারিজাতিকা চেয়েছিল, সূর্যকে ভালোবাসোতে। চেয়েছিল, সূর্যের উজ্জ্বল বুকে তার নরম আদরের স্পর্শ এঁকে দিতে। কিন্ত পারে নি। সূর্য যে তার প্রেমের প্রতি ভীষণ উদাস। সূর্যের এই প্রত্যাখ্যানকে পারিজাতিকা হয়তো উপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু  না, পারিজাতিকা তাও পারে নিসূর্যের আকাশ সমান উন্নাসিকতার সামনে, তার নিখাদ প্রেমের এ হেন হেনস্থা সে কি করে সহ্য করবে! বিষাদের ধূসর মেঘ যে সহস্র ভুজঙ্গের ফনা মেলে তেড়ে আসছিল তার দিকে। গ্রাস করে নিতে চেয়েছিল তার সমগ্র সত্তাকে  নিরুপায় পারিজাতিকার তাই সূর্যকে হৃদয়সখা হিসেবে বরন করে নেওয়ার স্বপ্ন থেকে যায় অপূর্ণ। পরিবর্তে তাকে বরন করে নিতে হয় সেই অন্ধকারের ঠিকাদার, মৃত্যুকেইহ্যাঁ, পারিজাতিকা আত্মহনন করে
এই পর্যন্ত এসে আপনাদের মনে হতে পারে এটা কোনো মামুলি টলিউডি সিনেমার গড়পড়তা প্রেমের গল্প ছাড়া কিছু নয় কারণ এমনিতে এই কাহিনীতে কোনো নতুনত্ব তো নেই। নেই কোনো অভাবনীয় মোচড়ও কিন্তু প্রায় ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই গল্পের শেষে যে টুইস্টটি আসে, তাতে এটি আর কোনো সাধারন গল্প হয়ে থাকে না। হয়ে যায় মিথ। যার আকর্ষণ কখনো মলিন হয় না। কারণ কথিত আছে, ব্যর্থতার বেদনা ভুলতে চাওয়া ওই আত্মঘাতী রাজকন্যা পারিজাতিকার দেহভস্ম থেকে জন্ম হয় এক বিষণ্ণ গাছেরল্যাটিন শব্দে যাকে বলা হয়, arbor-tristis     হিন্দিতে পারিজাত। আর বাংলায় তার নাম, শিউলি বা শেফালী।

পুরান কথিত এই ‘দুখী গাছে’র ফুলই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ফুল। শুধু তাই নয়, তামাম বঙ্গবাসীর কাছে, সম্প্রতি ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব সংস্কৃতিতে হেরিটেজের মর্যাদা পাওয়া বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব, শারদীয় ‘দুর্গা পুজা’র অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও এই শিউলি ফুল
সেই কারনেই বুঝি কোনো এক আশ্বিনের ভোরে, পথে শিশিরসিক্ত শিউলি ফুল পড়ে থাকতে দেখে মনে পড়ে যায় দুর্গা পূজার আর বেশি দিন বাকি নেই পৌঁছে যায় - পুজোর আগাম বার্তা, ঝরা শিউলি ফুল আঁকা খামে বরষা-উত্তর শরতের পথঘাট, প্রান্তর, বাড়ির উঠোন, ঠাকুর দালানের ঘাসে ঢাকা খোলা প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে সম্বৎসরের পার্বণী রোদে শুরু হয়ে যায় দিন গোনা, আর কত দিন বাকি পুজো আসতে!  শারদীয়ার ফিরোজা রং লাগে  বরষা ধোয়া আকাশের গায়ে। কাশ ফুলের দোলায়, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে পুজো পুজো ভাবপালক লাগানো ঢাকের তালে, বোধনের হৈ চৈ ভেসে আসে কানে।
আসলে শিউলি ছাড়া যেন পুজোর আবাহন অসম্পূর্ণ। সে পূজা সংখ্যার প্রচ্ছদই হোক কিংবা, প্রাক-পুজোর বিজ্ঞাপনী ফেস্টুন বা হোর্ডিং, সবেতেই অনুভব করা যায় খসে পড়া শিউলির শুদ্ধতা। ইউ টিউবে মুক্তি পাওয়া পুজোর গানেও বাজে, ঝরতে থাকা শিউলির টুপ টাপ
সন্ধ্যার জীবনানন্দীয় আঁধারে ফুটে ওঠা এই শিউলি যেন অসংখ্য সাঁঝের তারা; নিশিপুষ্পিকার শাখায় প্রশাখায় প্রস্ফুটিত শত সহস্র অসূর্যস্পর্শা শ্বেত পারিজাত। তার সুললিত, সুভদ্র সুবাসে যেমন বিষাদের হাহাকার দুর্লভ, তেমনি সুলভ নয় আকর্ষণের উগ্র প্রয়াসযা আছে তা শুধু সকরুন প্রেম অভিলাষের বিনম্র অভিমান মাত্র। তাই তো প্রভাতে সূর্যের দৃষ্টিপাত মাত্র শাখা বিবিক্ত হয়ে তলায় ছড়িয়ে পড়ে কমলা বৃন্তের শুভ্র প্রেমপুষ্প সম্ভার। মাটিতে লুটিয়ে পড়া এই ফুলের পরতে পরতে সমাকীর্ণ শিশির বিন্দু যেন নির্বাক কান্নার বেদনাশ্রু হয়ে অপেক্ষা করে সূর্যের দারুন দাহে শুকিয়ে যেতে
নজরুল ইসলামের গানে যে পল্লীবালা, ভোরবেলায় আঁজলা ভরে শিউলি ফুল কুড়োয় – তাকে আমরা চিনি। শিশির ভেজা মাটির গন্ধ লেগে থাকে সে ফুলে। তবু অষ্টমীর অঞ্জলিতে দেবীর চরনে অর্পিত হয় সেই মাটিতে পড়ে থাকা শুভ্র শেফালীইশুধু দুর্গার নয়, শিউলি তার মনোলোভা শোভায় মুগ্ধ করেছিল দেবরাজ ইন্দ্রকেও। স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সত্যভামা এবং রুক্মিনীর মনরক্ষায় স্বর্গের অমরাবতী থেকে লুকিয়ে ভেঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন শিউলির ডালা এবং রোপণ করেছিলেন তাঁর বাগানে। জানতে পেরে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন দেবেন্দ্র এবং অভিশাপ দিয়েছিলেন কৃষ্ণকে।
ছোটবেলায়, শিউলিতলার সেই পরিচিত দৃশ্য - তরতাজা সব ফুল মাটিতে পড়ে আছে, নির্জন রাস্তার নিভৃতে, যেন ছিন্ন বরমাল্য দিয়ে পাতা ঘেসো জমির বুকে পরিত্যক্ত ফুল শয্যা।  ঘুম থেকে উঠে, বেতের সাজি হাতে, এক ছুটে পৌঁছাতাম সেই ফুলের খাজানার কাছে। চোখ কচলে দেখতাম, খসে পড়া ফুলের শরীর গুলো তখনো অনাঘ্রাত, তখনো অপাপবিদ্ধ। শিউলি ফুলের এমন অক্ষত কৌমার্যের সন্ধান পাওয়া, আমার বিশ্বাস কিশোর বেলার সেরা আবিষ্কারএকটা একটা করে শিউলি ফুল কুড়িয়ে বেতের সাজিতে রাখতাম আর সাজি ভরাতে কখনো কখনো শিউলি গাছ ধরে ঝাঁকিয়ে ডালা পালায় লেগে থাকা বৃন্ত চ্যুত ফুলগুলিকে ফেলতাম মাটিতে
মামার বাড়িতে বহু পুরনো পুজো। তাদের ঠাকুর দালানের পূর্ব দিকে ছিল একটা ঝাঁকড়া শিউলি গাছ। মূর্তিকার কিছুটা দূরে, অস্থায়ী ত্রিপলের ছাউনির তলায় বসে প্রতিমার মুখের  উপরে পরম যতনে কমলা রঙ ঘষতেন তুলি দিয়ে। দেখতাম, মাটিতে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের বৃন্তের রঙের সঙ্গে হুবহু মিলে যেত মায়ের মুখের রং। পুজোর মধ্যে প্রতিদিন যেন প্রান উজাড় করে ফুল ফোটাত ওই শিউলি গাছ। বড় ফুলসাজি ভর্তি শিউলি ফুল যেত মায়ের পুজোয়। সেই শিউলি গাছ অনেকদিন নেই।  তবে তার স্মৃতি এখনো জাগরুক।
পুজোর কবিতাতেও অনিবার্য ভাবে চলে আসে শিউলির সুবাস। ২০১৬ সালে কাঁথি থেকে প্রকাশিত সংবাদ সম্প্রতির পূজা বার্ষিকীতে আমার লেখা কবিতাতেও এসেছিল শিউলির কথা। শ্রদ্ধেয় পরিতোষ মণ্ডল সম্পাদিত পূজা সংখ্যার পাতা থেকে এখানে তুলে দিলাম এই কবিতা।
                                    


 এই শরতে, কুহেলীর সাথে!
 দেবাশিস জানা

অনেক দিন পরে
কুহেলীর সাথে দ্যাখা।
টলটলে নদীর মতো -
বর্ষা উত্তর স্নিগ্ধতা মাখা।                                

সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল সে।
যেন পুজো সংখ্যার খোলা
পাতায়, মুগ্ধ চোখ রাখা।

পরনে নীল রোদ্দুর
রঙা জিনস,
ছায়া ছায়া আবেশ মাখা।
শিউলি ঝরা ঠাকুর
দালানের কার্নিশ
বিকেলের রোদে একা।

বুক জুড়ে তার
কাশের আমোদ
নদীর বুকে নৌকা।

কিছু বলার আগেই
সে গেয়ে ওঠে গান-
হৃদয়ের তীরে একা।

লাগল কি তবে
বিসর্জনের সুর।
ঢাকের তালে বাঁশরিকা!
ভেসেই যাবে, নদীর জলে
আমার প্রিয়া কুহেলিকা!  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...