হৈ হৈ করে চলে এলো দুর্গা পূজা। আর প্রতি বছরের মতন এ বছরেও, গড়িয়া স্টেশন রোড সংলগ্ন বরদাপ্রসাদ হাই স্কুলের মাঠে আয়োজিত হচ্ছে সেই আদি ও অকৃত্রিম, সবার প্রিয় নব দুর্গার পুজো। কোলকাতা সহ
সারা বাংলায় শারদীয় দুর্গা পূজার উৎসবে নবদুর্গা বলতে এক ডাকে লোকে গড়িয়ার নবদুর্গাকেই
বোঝে।

শতাব্দী প্রাচীন মিতালী সংঘের পরিচালনায় এবারে এই পুজো, ৮৩ বছরে পদার্পণ করল।
যদিও শুরুতে, অর্থাৎ ১৯৪০ সালে যখন প্রথম দুর্গা পূজা শুরু করে মিতালী সংঘ, তখন
মায়ের মূর্তি এক চালারই ছিল। সাত বছর পরে দেশ স্বাধীন হল। আর স্বাধীনতার বছর থেকেই অর্থাৎ
১৯৪৭ থেকে এখানে শুরু হল মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার সাথে সাথে দেবী পার্বতীর নয়
ভিন্ন রূপের নটি মাটির মূর্তি তৈরি করে তাকে পুজো করার চল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত
দীর্ঘ সময় ধরে, বহু বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও গড়িয়া মিতালী সংঘ তাদের নবদুর্গার
আরাধনায় কোনোরকম আপোষ করে নি। থিম পুজোর লহর এসেছে। যখন পুজো প্যান্ডেলের সঙ্গে
সঙ্গে মায়ের মূর্তিরও অনেকরকম রূপান্তর লক্ষ করা গেছে। কিন্তু গড়িয়ার নবদুর্গার কোনো
পরিবর্তন হয় নি। তাই এখনো পুজো পরিক্রমায় এক অনিবার্য গন্তব্য মিতালী সংঘের নবদুর্গা
দর্শন। নব দুর্গার আকর্ষণ, আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবার কাছেই মহার্ঘ এবং অপ্রতিরোধ্য।

প্রসঙ্গত, নব দুর্গার আরাধনা প্রথম শুরু হয় রামায়নের সময়ে অর্থাৎ ত্রেতা যুগে। যখন
নাকি কুম্ভ কর্ণ তাঁর দীর্ঘ নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠেছেন। যা, সীতা উদ্ধারে আসা রামের
কাছে ছিল প্রায় অশনি সংকেতের মতন। এমনকি দেবতারা পর্যন্ত কুম্ভ কর্ণকে নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
এইরকম এক সংকটময় অবস্থায় স্বয়ং ব্রহ্মা রামকে বিপন্মুক্ত রাখতে এগিয়ে আসেন এবং অসময়ে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তোলেন দেবী পার্বতীকে। যাকে পরিভাষায় অকাল বোধন বলা হয়। শরত
কালীন শুক্ল পক্ষের প্রতিপদের দিন অর্থাৎ বোধনের দিন থেকে নবমী পর্যন্ত নয় দিন
ব্রহ্মা, দেবী পার্বতীর নয়টি ভিন্ন রূপের আবাহন এবং আরাধনা করেন। কথিত আছে সেই
থেকে পৃথিবীতে নব দুর্গার পূজা অর্চনা শুরু হয়, যা নব রাত্রি পালনের উৎসব হিসেবে
সারা ভারতে বিশেষ করে উত্তর ভারতের রাজ্য গুলিতে সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়।
যদিও এই শারদীয় অকাল বোধনকে নিয়ে অন্য একটা প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে বিভিন্ন মহলে।
সেটা হল ব্রহ্মা নয়, সীতা উদ্ধার কল্পে স্বয়ং রামই নাকি এই অকাল বোধন করেছিলেন। কিন্তু বাংলায় যে শারদীয় দুর্গা পূজার প্রচলন আছে তা কিন্তু নয় দিনের নয়, তা চার দিনের।
এবং এখানে দেবী, মহিষাসুরমর্দিনী হিসেবে পূজিতা হন। পার্বতীর নয় রূপের মধ্যে, ষষ্ঠ
রূপ কাত্যায়নীই মহিষাসুরকে বধ করেন। অনেক শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত মনে করেন দুর্গা এখানে
শুধু মহিষাসুর মর্দিনী হিসেবে পূজিতা হলেও কলাগাছ রূপী নবপত্রিকার মধ্যে পার্বতীর
নয় রূপকে পূজা করা হয়।আর এখানেই গড়িয়া মিতালী সংঘ সবার থেকে আলাদা। এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, যখন সদ্য স্বাধীনতা
প্রাপ্ত একটা দেশ যুঝছিল নানা প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে, লড়াই করতে হচ্ছিল দেশের
স্বার্থ বিরোধী নানা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, তখন এই নব দুর্গার স্বমূর্তি আরাধনা,
এবং তাকে সার্বজনীন স্তরে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার ভার নিয়েছিল কোলকাতা শহরের দক্ষিণ
প্রান্তের এক সংঘ শক্তি। সেই ১৯৪৭ থেকে এই ধারা নিষ্ঠার সঙ্গে বহন করে চলেছেন মিতালী সংঘের কর্ম কর্তা
বৃন্দ। এবছরও সেই রীতি বজায় রেখে, পূজা
প্যান্ডেলের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে নব দুর্গার নয় মূর্তি। প্রথম মূর্তি, দেবীর নয়
রূপের প্রথম রূপ শৈল পুত্রীর মূর্তি। শৈল পুত্রীর ডান হাতে থাকে ত্রিশূল এবং বাঁ
হাতে পদ্ম ফুল।
দ্বিতীয়ায়, দেবীর যে রূপের
পূজা করা হয়, প্যান্ডেলে রয়েছে সেই রূপের মূর্তি, ব্রহ্মচারিণী নামে। তার ডান হাতে
রয়েছে জপের মালা আর বাঁ হাতে কমণ্ডলু। তৃতীয় মূর্তি, দেবী চন্দ্রঘণ্টার। এই মূর্তি
দশভুজা। দশ আয়ুধ ভূষিতা।
চতুর্থ, কুশ্মাণ্ডা। ইনি অষ্টভুজা। এবং সিংহ বাহিনী।
পঞ্চম মূর্তি, স্কন্দমাতার। ষষ্ঠ, কাত্যায়নীর মূর্তি। যিনি মহিষাসুর মর্দিনী
হিসেবে পূজিতা হন বাংলায়। সপ্তম মূর্তি, ঘোর কৃষ্ণ বর্ণা কাল রাত্রির। এই দেবীর
বাহন গাধা। অষ্টম মূর্তি মহা গৌরীর। ইনি চতুর্ভুজা। বাহন ষাঁড়। এবং শেষ তথা নবম
মূর্তিটি দেবী সিদ্ধিদাত্রীর। এই দেবী
পুরান ভেদে কোথাও অষ্টভুজা আবার কোথাও অষ্টাদশভুজা। আমি বিশেষ ভাবে গর্বিত, এবছরের অর্থাৎ ২০২৩ এর
পূজা প্যান্ডেল – যা এক দক্ষিণী মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে, তার একটা ছবি এই পরিসরে
দিতে পারছি বলে। এছাড়াও নব দুর্গার নয় মূর্তির ছবি - যা এই পরিসরে শেয়ার করতে পেরে
আমি ভীষণ ভাবে ভাগ্যবান মনে করছি।
এবছর মিতালী সংঘের প্যান্ডেল উদ্বোধন হয়েছে দ্বিতীয়ার দিন, ১৬ ই অক্টোবরের সন্ধ্যায়। উদ্বোধন
করেছেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার শ্রী বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড়ে উপচে পড়ছে পূজা
প্রাঙ্গন। প্রতি বছরের ন্যায়, ক্লাব কর্তৃপক্ষ জানালেন সরকার আয়োজিত রেড রোডে
অনুষ্ঠিত দুর্গা কার্নিভ্যালে, স্বমহিমায় অংশগ্রহণ করবেন গড়িয়ার নব দুর্গা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন