সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভেঁপু বাবার পুজো প্ল্যান!

মহাতারকা, তারকা থেকে শুরু করে মিনি তারকাদেরও পুজো প্ল্যান আমজনতার কাছে পরিবেশিত হয় বেশ ফলাও করেই। কিন্তু সাধারন আম পাবলিকেরও তো থাকতে পারে পুজোর দিনগুলির জন্যে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা। ইতিহাস যেমন শুধু রাজা-মহারাজাদেরই কাহিনী হয়ে থেকে যায়, তেমনি পুজো-অনুষ্ঠানের বর্ণনায় ব্রাত্য থেকে যায় সাধারন মানুষের কথা। বছরকার কোনো বিশেষ পার্বণ ঘিরে সেই সব অখ্যাত সাধারনের আমোদআহ্লাদ অথবা দুঃখ –বেদনার কথাও কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক নয় যা থেকে যায় সবার অগোচরে। তাই এবার আলোর ফোকাসটাকে তথাকথিত খ্যাতিমানদের থেকে সরিয়ে অখ্যাতদের উপরেই ফেলে দেখার একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা, এই পরিসরে
একটা কথা আছে, পাদপ্রদীপের আলোয় যারাই আসে তারাই সেলিব্রিটি হয়ে যায়। এ যেন জাদু কাঠির স্পর্শ। যার ছোঁয়ায় বাজারের সাধারন সব্জী বিক্রেতা থেকে মাধুকরী করে বেড়ানো আম গোঁসাই বাবা –এক লহমায় হয়ে যান দূরের নক্ষত্র
 
প্রখ্যাত মানুষেরা কখনো তাদের নির্দিষ্ট কক্ষ পথ ছেড়ে বেরুতে পারেন না। কিন্তু সাধারনেরা সে ক্ষেত্রে মুক্ত বিহঙ্গ। তাদের নেই কোনো প্রোটোকল রক্ষা করে চলার দায়। তারা মুক্ত ধূমকেতুর মত আছড়ে পড়তে পারে এ মহা ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র। তাদের যেমন পুজো সাহিত্যের একাল-সেকাল নিয়ে নেই কোনো মাথাব্যাথা, নেই পুজোর গানের মান পড়ে যাওয়া নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করার নামে নিজেকে গানের বড় সমঝদার প্রমান করার আকুলতা, তেমনি নেই পুজোর ছুটিতে পাহাড়, সমুদ্র কিংবা অরন্যে বেড়াতে যাওয়ার ধক অথবা ছোটবেলাকার স্মৃতি মন্থনের নামে নিজের পারিবারিক তথা সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের রোশনাই দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা; নেই পুজোর চার দিনে চারটে ভিন্ন ভিন্ন ড্রেস পরার পরিকল্পনা ও প্রত্যেকটি পোশাকের অ্যাকাডেমিক বর্ণনা দেওয়ার কোনো প্রগলভ বাসনা। তেমনি নেই পুজোর কোন্ দিন কোন্ রেস্তোরাঁয় হানা দিতে হবে তার সুলুক সন্ধান দেওয়ার কোনোরকম অভিপ্রায়ও। যা আছে তা বাস্তবের কঠিন মাটির উপর দাঁড়িয়ে আত্মপ্রবঞ্চনাহীন ‘মন কি বাত’ শুনিয়ে দেওয়ার অকপট রংবাজী। যা শোনার বা পড়ার অভিজ্ঞতা কোনো গোয়েন্দা গল্প পড়ার থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। কে বলতে পারে, এর থেকেই হয়তো উঠে আসবে বর্তমান সময়ের আর্থ-সামাজিক তথা আর্থ-সাংস্কৃতিক অবস্থার বাস্তব চিত্রটা। দেখা যাক। কথা বলেছিলাম আমি, তিন সাধারনের সাধারন মানুষের সঙ্গে। তাদের পুজো প্ল্যান নিয়ে।  এখানে তিনিটি শিরোনামে পরিবেশিত হবে সেই তিনটি সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে লেখা তিনটি সত্য অনুগল্প।

ভেঁপু বাবার পুজো প্ল্যান!
ভেঁপু বাবার সঙ্গে দেখা বারুইপুর লোকালে। পরনে লাল ধুতি, হাঁটুর উপরে তুলে পরা। গায়ে লাল ফতুয়া। মাথায় লাল ফেট্টি। ফেট্টিতে কলমের মাথা ক্লিপের মত লাগানো। ক্লিপের খোলে ঢোকানো টাটকা একটা রক্ত জবা আর একটা ক্লিপের খোল দেখি, খোলাই। মানে অন্য আর একটি ফুল ঢোকার অবকাশ এখনো আছে। হাতে ত্রিশূল, ত্রিশূলের মাথায় ঝুলছে স্টিলের কমণ্ডলু, প্লাস্টিকের প্যাকেটে কুচো ফুলঅন্য হাতে বিশাল একটা শিঙা। লোভ সামলাতে পারি না। কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলে, বলেন “আমি তো - বাবা, শঙ্কর বাবা!” বাড়ি? মথুরাপুর, কৃষ্ণ মন্দিরের আশ্রম। এখন কি আশ্রমে ফিরছেন? ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন শীর্ণ চেহারার শঙ্কর বাবা। কপালে চন্দনের তিলক কাটা, তার উপরে সিন্দুরের টিপ থাকলেও বাবার মুখের ছোট ছোট কাঁচা পাকা চুলের ভিড়ে বাবার বাবাগিরি যেন প্রকাশিত হতে পারে না, ঠিক ঠাক। বিরক্তির ঢঙ্গে বলেন, “আশ্রমে যত চোর- চিটিংবাজরা থাকে। আমি যেখানে পারি সেখানে থাকি।"  তাহলে যাদবপুরে এসেছিলেন কি করতে? “পুজো করতে।" কি পুজো করেন? “সব। শিব, কালী, দুর্গা, গণেশ, কার্ত্তিক, সব।" দেখে শুনে লোভ সামলাতে না পেরে, বললাম, বাবা আপনার একটা ফটো নেবো।  বাবা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিঙ্গাটাকে মুখের কাছে বাজানোর মত করে ধরে, আমাকে বললেন “নাও, ফটো নাও”। “গঙ্গাসাগর মেলায়, কত জনকে যে ছবি দিতে হয় এইভাবে, তার ইয়ত্তা নেই।“ এবারেও যাবেন? “না গেলে, সারা বছর খাবো কি?” গড়িয়া স্টেশনে ট্রেন আসতে, আমার সঙ্গে ভেঁপু বাবাও নেমে পড়েন। হাওয়াই চপ্পল পরা বাবাকে আমার আসল প্রশ্নটা করার তখনো বাকি আছে। স্টেশনের একটি চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পুজোয় কি করবেন? ঘোলাটে চোখে, বাবা কেমন একটা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন। তারপর বললেন, “কি আর করবো! সারাবছর যা করি তাই।" আমি উত্তর পাওয়ার জন্য তখনও অপলক তাকিয়ে আছি। “ওই দোকানে দোকানে ফুল, চন্দন দিয়ে বেড়াবো।“  
কিন্তু সে তো অনেক ব্রাহ্মনই শহর-বাজারে ঘুরে ঘুরে পুজো করেন। তার জন্যে এমন বেশভূষা, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল, শিঙ্গা এসবেরই বা দরকার কি? এ প্রশ্ন অবশ্য আমি করতে পারি নি, বাবাকে।


অন্ধের প্রতিমা দর্শন!
“মায়ার সংসারে, কে যাবি আগে......” খালি গলায় গান করতে করতে, এক মধ্য বয়সী মানুষ স্টেশনের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন, সাবধানে - অন্ধকারে পা ফেলার মত করে। বাঁ হাতে ধরা একটি স্টিলের লাঠি দিয়ে বার বার পায়ের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুঝে নিচ্ছিলেন তাঁর এগোনোর পথ। কোথাও যেন একটা ভারী বুকের আঁচ পাচ্ছিলাম, তাঁর গানে। লোকটির পরনে, একটি ফ্যাকাশে নীল রঙের প্যান্ট, তার উপরে ছেড়ে পরা, ঘিয়ে রঙের হাফ শার্টমাথা ভর্তি কালো চুল, ব্যাক ব্রাশ করা। বেশ ভদ্রস্থ গোছের। বাঁ কাঁধে ঝুলছিল কালো রঙের অফিস ব্যাগ। ডান হাতে ধরা ভিক্ষার বাটি, তাও স্টিলের। এক টাকা, দু টাকার কয়েন পড়ার ধাতব শব্দে, ভদ্রলোক সচকিত হয়ে ওঠেন ঠিক কিন্তু তা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য তাঁর হয় না। এদিকে, বিকেল সাড়ে তিনটার ডাউন ডায়মন্ডহারবার লোকাল, গড়িয়া স্টেশন ছেড়ে নরেন্দ্রপুরের দিকে চলে যায়। কিছু লোক চাপাচাপি করে ট্রেনে উঠে যায়। নেমে যায় কিছু লোক ভদ্রলোকের গলায়, পায়রার খোপের মতন একটা স্পিকার লাগানো কাঠের বাক্স ঝুলতে দেখে, আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার সাউণ্ড সিস্টেম চলছে না? “ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়েছে, কিছু ক্ষণ বাজার পরেই ঘড় ঘড় করছে।"  “নাহলে, এতে করেই গান চালিয়ে দিই আমি।"  না, না আপনি কিন্তু ভালোই গান করেন। আমি বললাম তাঁকে। আমার কথায় লোকটি হাসলেন, দাঁত বার করে। আপনি কি কোথাও গান শিখেছেন? “না!”  “শুনে শুনে!”  এতক্ষণ, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। এবার ভদ্রলোক একটা বন্ধ গুমটির নিচে বসলেন।  “কি করবো বলুন, কাজ তো করতে হবে। বসে থাকলে তো হবে না।"  সে ঠিক আছে। গানের মিউজিক চালিয়ে তার সঙ্গে গান করলে তো ভালো হয়। “কারাওকের কথা বলছেন?”  হ্যাঁ। “বাউল গানের ওইভাবে পাওয়া যায় না। গুগলেও খুঁজেছি।" আমি দেখবো ক্ষণ।  বললাম তাঁকে। ইতিমধ্যে আপ বারাসত লোকাল, স্টেশনে ঢুকতেই কয়েকজন যাত্রী ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনে উঠে চলে গেল। ক দিন ধরে নিম্নচাপের দরুন আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। যে কোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। পুজোকেও আর বেশি দিন নেই। ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কটা বাজে। “চারটের ক্যানিং লোকাল ধরবো।" এখনো দশ মিনিট দেরি আছে। কোথায় থাকেন? “বেদবেরিয়ায়। ভাড়া ঘরে।" দেশের বাড়ি কোথায়? “জীবনতলায়” “আমি আর আমার পরিবার থাকিমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে রাজস্থানে। ছেলে মহারাষ্ট্রে, রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।"  কত টাকা ভাড়া দিতে হয়? “৬০০ টাকা। এক কামরার বাড়ি।" আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ভাড়ার পরিমান শুনে। ছেলে, মেয়েরা কেউ আসবে পুজোয়? “না!” "বার বার আসার যা খরচ, সম্ভব নয়।" "চড়কের সময়, জীবনতলায় বড় মেলা বসে। তখন আসবে।"  উনার গলার স্বরে তিতির পাখির অসহায়তার ডাক শুনতে পাই। আসলে উনার ছেলে বা মেয়ে পুজোয় বাড়ি না এলে, কার কি এসে যাবে।
পুজোর কদিন কি তাহলে স্টেশনে স্টেশনেই কাটবে? দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক উত্তর দেন,  “না! বাড়িতে চলে যাব।"  অনেকদিন, পরে যাচ্ছেন না? এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলেন ভদ্রলোক, এবার আমার অবস্থান ঠাউরে তাঁর কোটরাগত নিথর চোখ দুটিকে সাধ্যমত উপরে তুলে, ফিক করে হাসলেন। "হ্যাঁ, সেটাই তো।তারপরে আবার পুজোর সময়। ভাইপোর ছেলে মেয়েদের জন্য জামা কাপড় নিয়ে যাবো ভেবেছি। বৌমাকে কিনে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, কি হবে জানি না।” নিজেদের?  “না, না। লাগবে না।"  এবার যেন উনার কণ্ঠায় একটু রূঢ়তার শাসন শোনা গেল। একটু কি বেশি অনধিকার চর্চা করে ফেলছিলাম, আমি? বিষয়ান্তরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, পুজোয় বাড়ি গিয়ে কি করবেন ঠিক করেছেন? “জীবনতলায় কয়েকটা পুজো হয়। একটু ঠাকুর দেখতে বেরুব।" একা? “পরিবার নিয়ে যাবে।"  তাই। কিন্তু আপনি ঠাকুর দেখবেন......!  “চোখে না দেখতে পেলেও, মনের অনুভবে তো বুঝতে পারবো।"  সত্যিই, মা করুনাময়ী। তাঁর মহাজাগতিক আদরের স্পর্শ,  শুধু চোখ দিয়ে বোধহয় অনুভব করা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে ট্রেন ঢুকে গেলে, ভদ্রলোক লাঠি ঠোকাতে ঠোকাতে এগিয়ে গেলেন ট্রেনে উঠার জন্যে। যেতে যেতে বলে গেলেন, "বাউল গানের মিউজিক পেলে জানাবেন।"  আমি কোনো উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম স্টেশনে। আমার হাতে ধরা পাঁচ টাকার একটা কয়েন। কথায় কথায় ভদ্রলোকের বাটিতে আর দেওয়া হয়ে ওঠে নি।


"আমার লাগবে না। তোর মেয়ের জন্যে বালা বানিয়ে দিস!"
আটপৌরে শাড়ি পরা এক বয়স্ক মহিলা ঢাকুরিয়া স্টেশনের ২ নং প্লাটফর্মে ওঠার ঠিক মুখটায়, রেল লাইনের ধারে বসে কচু শাক বানিয়ে ছোট ছোট পলিথিনের চিকের মধ্যে ভরে ভরে রাখছিলেন। দাম জিজ্ঞাসা করলে বললেন, "১৫ টাকা, বাবা।" "নিয়ে যা, নারকেল কুরা, ছোলা দিয়ে রাঁধলে আর কিছু লাগবে না। তাই দিয়েই ভাত চলে যাবে।" মহিলা আমার মায়ের বয়সী। তাই মাসী বলে সম্বোধন করে, একটা দেওয়ার কথা বললাম। পয়সা দিয়ে চলে আসছি, পেছনে থেকে বলে উঠলেন, "সাবধানে যাবি, বাবা।" প্রায়ই ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে মাসীর কাছ থেকে এটা ওটা নিয়ে আসি। কবে পাঁচ টাকার থানকুনি শাক, কবে আবার দু আঁটি কুলেখাড়া বা এক গোছা হলুদ কুমড়ো ফুল। একটা ছোট প্লাস্টিক পাতিয়ে মাসী তার সমস্ত জিনিস রাখেন তার উপরে। কবে তাতে হয়তো দুটি চালতা থাকে, নস্করদের বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা। কবে হয়তো একটা চাল কুমড়ো, ঘরের টালির চালে বাওয়া গাছ থেকে ভেঙে নিয়ে আসেন। বাকি সব শাক-পাতা আগের দিন বিকেলবেলায় আশে পাশের খাল বিল থেকে সংগ্রহ করে রাখেন। পরের দিন ভোরবেলায় নিয়ে আসবেন বলে। তালদী স্টেশনে, ক্যানিং লোকাল ধরেন ভোর পাঁচ টার সময়ে। সঙ্গে থাকে প্লাস্টিকের মধ্যে নেওয়া মুঠো কয়েক শুকনো মুড়ি।
কোনোদিন ট্রেনের আসতে দেরী থাকলে, মাসীর সঙ্গে সুখ দুখের কথাও হয় অনেক সময়। জানতে পারি, শাক সব্জী বিক্রি করেই মাসীর ডিউটি শেষ হয় না। এর পরে আবার 
ঢাকুরিয়ারই কালী বাড়ি লেনের এক বাবু-বাড়িতে যান রান্না করতে। "মাসে তিন হাজার টাকা করে দেয় ওরা।"  মাসী একদিন বলেও দেন আমাকে অকপটে।
দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরে তবে দুটো ভাত পড়ে পেটে। ছোট বউ রান্না করে রাখে।
গ্রীষ্ম কাল যায়, বর্ষা আসে। মাসী তখন তার দোকান পাতেন, প্লাটফর্মের উপরে কোথাও এক চিলতে পলকা, ছেঁড়া ছাউনির নীচে। এমনি করে একদিন পুজোর খুঁটি পুজো সম্পন্ন
 হয়ে যায়। মহালয়ার আগে প্যান্ডেলের বাঁশ পোতা হতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। মাসীর কিন্তু রোজনামচার কোনো বদল হয় না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, "মাসী, পুজোর মধ্যেও আসবেন এখানে?" "হ্যাঁ, বাবা। আমাকে ছাড়া যে বাবুর ঘরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।" "বোনাস দিয়েছে?" "না, এখনো দেয়নি। প্রতিবছরই এইরকম দেরী করে।"  বলেই দেখি, আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছেন মাসী। মনে হয় নাতি, নাতনির জন্যে কিছু কিনতে পারছেন না বলে কষ্ট হচ্ছে। "মাসী, ছেলেরা আপনাকে পুজোর কাপড় দিয়েছে তো?"  প্রশ্নটা করেই মনে হল, ভুল করে উনার কাটা ঘায়ে বোধহয় নুন ছড়িয়ে দিলাম। উত্তর দিতে গিয়ে, মাসীর গলাটা যেন কেমন কেঁপে উঠল। "বড় ছেলে বানতলায়, চামড়া কারখানায় লেবারের কাজ করে। কিন্তু যতদিন থেকে বড় বউ, গড়িয়ায় বাবুর বাড়িতে কাজে ঢুকেছে, হাতে দুটো পয়সা এসেছে, মাকে আর পাত্তা দেয় না।"  সে কি? ছোট ছেলে? "তার কাছেই তো থাকি। সে বলেছিল।" তাহলে আর কি। "না, বাবা। সে বললে কি হবে। আমি না বলে দিয়েছি।" "তাকে বলেছি, আমাকে দিতে হবে না। তুই বরং তোর মেয়ের হাতে দুটো বালা বানিয়ে দিস।" "মেয়েটা বাবা, খালি হাতে ঘুরে বেড়ায়, দেখতে ভালো লাগে না।" আমি আর জিজ্ঞাসা করতে পারি না, মাসী কেন তার ছেলেকে মেয়ের জন্যে পুজোয় নতুন জামা কিনে দেওয়ার পরিবর্তে বালা গড়িয়ে দিতে বললেন। ঢাকুরিয়া থেকে ফেরার পথে কাপড়ের দোকান গুলিতে যে কত সুন্দর সুন্দর ফ্রক, চুড়িদার ঝোলে, চড়া আলোয় কত ঝলমল করে। তার নাতনির গায়ে কেমন লাগতো, এগুলো? 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...