রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর থেকে দু বছরের বড়
কাদম্বরী দেবী, সম্পর্কে দুজন দেওর ও বৌদি। দেওর ও বৌদির সম্পর্ক অম্লমধুর হবে,
সেটাই স্বাভাবিক; বিশেষ করে দুজনে যদি
কাছাকাছি বয়সের হয়। কিন্তু এইভাবে বললে, সম্পর্কের বাকি রঙ গুলো যেন অনাবৃত হতে
পারে না। বিশেষ করে সেই সম্পর্কের রচয়িতাদের মধ্যে একজন যদি হন রবীন্দ্রনাথের মত
কবি, এবং অন্য জন সেই কবি মানসকে দিনের পর দিন ধরে মায়ের শাসন, প্রেমিকার আদর দিয়ে
আগলে রাখার নেপথ্য কারিগর, তাহলে ব্যাপারটা আর একরঙা থাকে না।
রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর ষোল বছরের এই সম্পর্ক নিয়ে কথা হয়েছে অনেক, লেখা হয়েছে
তার থেকেও বেশি। তবু এই সম্পর্কের ষোড়শীকে নিয়ে আগ্রহের যেন শেষ নেই। এর পেছনে
অবশ্য সঙ্গত কারণও রয়েছে যথেষ্ট। একটু
ফিরে দেখা যাক।
শুরুতেই কাদম্বরীর জীবনে এক অদ্ভুত সমাপতন ঘটতে দেখা যায়। সেটা হল তাঁর জন্মদিনের
তারিখ আর বিয়ের তারিখ দুটো এক হয়ে যাওয়া। এটা কি কিছু অলক্ষণের ইঙ্গিতবাহী ছিল?
ঠাকুর বাড়ির বাজার সরকার শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায় থাকতেন ঠাকুরদেরই দেওয়া ছোট মত
একটা কোঠা বাড়িতে, যেটা ছিল বার বণিতাদের পাড়া বলে কুখ্যাত হাড় কাটা গলির মধ্যে। বাবা জগন্মোহনের আমল থেকে তাঁরা এই বাড়িতে বসবাস
করে আসছিলেন। এই শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়েরই
তৃতীয়া কন্যা হলেন কাদম্বরী। ১৮৫৯ সালের
৫ই জুলাই, এই হাড় কাটা গলির বাড়িতেই জন্ম হয় কাদম্বরীর। তখন অবশ্য তাঁর নাম ছিল
মাতঙ্গিনী। ঠিক নয় বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৮
সালের ৫ই জুলাই যখন মাতঙ্গিনীর বিয়ে হচ্ছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯ বছর
বয়সী পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে, তখন মাতঙ্গিনীর জীবনে ঘটে যাচ্ছে তিনটি বড়
পরিবর্তন। এক, মাতঙ্গিনী পাচ্ছেন নতুন নাম
কাদম্বরী। দুই, তাঁর বয়স নয় বছর পূর্ণ হয়ে ওইদিন তিনি পা দিচ্ছেন দশ বছরের গণ্ডীতে; একই
সাথে তিনি বালিকা থেকে বালিকা বধূ হয়ে প্রবেশ করছেন বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির গর্ভ
গৃহ ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে। আর সবশেষে তিন, যেটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল
তাঁর থেকে দু বছরের ছোট অর্থাৎ সাত বছর বয়সের বালক রবিকে পাচ্ছেন তাঁর দেওর হিসেবে
যে কিনা তাঁর প্রাক কৈশোর কালীন খেলার সাথী হয়ে কাটাবে অনেক রোদেল সকাল, অনেক আমসত্ত্ব
খাওয়া দুপুর; লুকোচুরি খেলবে অসংখ্য পড়ন্ত
বিকেলের আবছায়ায়।
আসলে, কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের রসায়ন বুঝতে গেলে,
জ্যোতিরিন্দ্রের সঙ্গে কাদম্বরীর যে দূরত্ব, সেটাকে চিনতে হবে আগে। কারণ এই
দূরত্বের ফাঁক দিয়েই কিন্তু নতুন একটা সম্পর্কের রাস্তা গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল
সেদিন। শেষ পর্যন্ত যদিও তা বেশি দূর স্থায়ী হয় নি, হারিয়ে গিয়েছিল বিয়োগান্তিক পরিনতির চোরাবালিতে, কিন্তু তার গোড়াপত্তন হয়েছিল রবি আর কাদম্বরীর বালখিল্যতার
রসেই। আর যাই হোক, নয় বছর বয়সী শিশু বালিকার খেলার সাথী হয়ে ওঠা উনিশ বছরের সাহিত্য-কলায়
রুচি রাখা যুবক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
কাদম্বরীর যত সখ্যতা তাই বালক রবির সঙ্গেই। কাদম্বরীর কাছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেন
দূর আকাশের তারা, আর রবীন্দ্রনাথ যেন হাতের কাছে পাওয়া আচারের বয়াম, যখন ইচ্ছা মুখটি
খুলে চেটে পুটে নেওয়া যায় তার অম্লমধুর স্বাদ।
কিন্তু সময় বড় বালাই। কারণ সে কখনো থেমে থাকে না। তাই বেড়ে চলা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
একটু একটু করে বেড়ে ওঠে কাদম্বরীও, ক্রমশ শৈশব থেকে কৈশোরে, অনেকটা গ্রীষ্মের
শুষ্কতা পেরিয়ে বর্ষার জল পাওয়া শ্যামলা গাছের মতন। শ্যাম বর্না কাদম্বরীর দেহ
বল্লরী যে কৈশোরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে পত্রে পুষ্পে পল্লবিত হয়ে উঠছিল সে
বার্তা তার দীর্ঘাঙ্গী দেহ পালে লাগা যৌবনের হাওয়াই বুঝিয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ। কিন্তু তার
পতিদেবতা যেন এই পরিবর্তনের দিকে খানিক উদাসীনই ছিলেন।
অন্যদিকে খেলার সাথী রবিও যে আস্তে আস্তে যৌবনের উপবনে ভ্রমর হয়ে ওঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে।
কাদম্বরীর আগমনের তিন বছর আগে থেকে যদিও রবির শিক্ষাঙ্গন যাওয়ার পালা শুরু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে রবির মন যে কিছুতেই বসছিল না। প্রথমে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে (১৮৬৫, ৭ই এপ্রিল), কয়েক মাস পরে, সেখান থেকে উঠে সরকারী পাঠশালা নর্মাল স্কুলে। সেখানে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন ছয় বছর, ১৮৭১ অব্দি। এর মধ্যে ১৮৬৮ তে বৌঠান কাদম্বরীর পদার্পণ পর্ব ঘটে গেছে ঠাকুর বাড়িতে। ১৮৭২ এ রবীন্দ্রনাথের যখন ১১ বছর বয়স তখন তিনি বউবাজারের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। এক বছরের মাথায় বেঙ্গল অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়ে আসেন, দুবছর বিরতির পর ১৮৭৫ সালে পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে, সেখানেও সেই মন কেমন করা। স্কুলের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে কখন তিনতলার ছাদে একা বৌঠানকে পেয়ে তাঁর লেখা কবিতা পড়ে শোনাবেন সেই অপেক্ষায় কিছুতেই যেন ধরা বাঁধা পড়াশুনায় মন বসাতে পারেন না। তাই এক বছর যেতে না যেতে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দিলেন স্কুলে যাওয়া। ১৫ বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন স্কুল ছুট।
এর মধ্যে ১৮৭৩ এ উপনয়ন পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেছে, কাদম্বরীর উপস্থিতিতেই। তার দু বছর পরে ১৮৭৫ এর ১০ই মার্চ তারিখে রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী গত হওয়ার পর থেকে যেন কাদম্বরী, বাল্য বন্ধু রবির স্ব-আরোপিত মাতৃত্বের ভারও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
একদিকে নিভৃতচারিণী কাদম্বরী, আর অন্যদিকে মাতৃহারা স্কুল ছুট কিশোর রবীন্দ্রনাথ; একদিকে স্বামীর উদাসীনতায় একাকী জীবন কাটানো কাদম্বরী, অন্যদিকে কোথাও পাত্তা না পাওয়া রবি যে তার কবি সত্তার স্বীকৃতি পাওয়ার লোভে আতুর হয়ে ছুটে আসে তার আদরের বৌঠানের কাছে, তিন তলার নিভৃত চিলেকোঠায়। এ যেন নিজেদের প্রয়োজনেই পরস্পরের কাছে আসা। সম্পৃক্ততার আস্বাদ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যাওয়া সব ভুলে। যত দিন যাচ্ছিল তত যেন পারস্পরিক নির্ভরতা বেড়েই যাচ্ছিল। কাদম্বরীর সঙ্গীতানুরাগ, তার কাব্য প্রীতি, মিতভাষী স্বভাব যেন রবীন্দ্রনাথকে চুম্বকের মত আকর্ষিত করছিল কাদম্বরীর দিকে। কাদম্বরীর দেহ গত সৌন্দর্যও এ ক্ষেত্রে কম দায়ী ছিল না। তাঁর স্ফুরিত নাসা, দীর্ঘ আঁখি পল্লব, ঘন কৃষ্ণবর্ণ ভ্রূ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল রবির শরীরে। এককথায় কাদম্বরী যেন রবীন্দ্রনাথের প্রাণের স্পন্দন হয়ে উঠেছিলেন। আদর করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকতেন গ্রীক দেবী হেঁকেটি নামে। কাদম্বরীও রবিকে ভানু বলে আদর করে তাঁর গাল টিপে দিতেন, কবিতার দুর্বল জায়গা গুলোকে ধরিয়ে দিতে দিতে।
এর মধ্যে ১৮৭৮ এ রবীন্দ্রনাথ কে বিলেত চলে যেতে হল ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে। পাশ না করেই ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও ১৮৭৮ ই তাঁর প্রথম বই ‘কাব্য কাহিনী’ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ইতি মধ্যে ঠাকুরবাড়ি থেকেই বেরতে থাকে ‘ভারতী’ পত্রিকা। যার মুল প্রাণকেন্দ্রই ছিলেন কাদম্বরী। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির কানাঘুষোয় যে শোনা যাচ্ছিল রবি, কাদম্বরীকে নিয়ে নানা কথা। দেবেন্দ্রনাথ তাই আর দেরী করেন না। ১০ বছর বয়সী ভবতারিনীর সঙ্গে পুত্র রবীন্দ্রনাথের বিয়ে স্থির করে ফেলেন তিনি। পরে যার নাম রাখা হয় মৃণালিনী।১৮৮৩ সালের ৯ ই ডিসেম্বর তারিখে মৃণালিনী, রবীন্দ্রনাথের ঘরনী হয়ে আসতেই যেন ‘বৌঠান’ কাদম্বরী দেবীর জীবনে নেমে এল শস্য শূন্য হৈমন্তিক অপরাহ্নের নির্জনতা। তাও যদি ঊর্মিলা বেঁচে থাকতো তখন; ঊর্মিলা ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি, দিদি স্বর্ণকুমারীর কনিষ্ঠা কন্যা। কাদম্বরীর কাছেই বড় হয়ে উঠছিল সে। কিন্তু বিধাতার লিখন ঊর্মিলার জীবনকে বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয় নি। এই নিয়ে কম কথা শুনতে হয় নি কাদম্বরীকে। কেউ কেউ বলেছে, বাঁজা -আঁটকুড়ীর কাছে কি বাচ্চা টেঁকে।
শুধু মাত্র রবির উপস্থিতি দিয়ে এতদিন কাদম্বরী তাঁর সব দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করে এসেছে। তাঁর সুদীর্ঘ ‘আদরের উপবাস’ কেও রবির সুমিষ্টি ওমের পরশে ঢেকে রাখতে চেয়েছে দিনের পর দিন।
কিন্তু আজ, সে একা, সম্পূর্ণ রূপে একা, এক নির্জন যাপিনী। বিবাহের পরে, রবি যেন অনেক দূরে চলে গেছে তাঁর থেকে। এখন আর তাঁর ভোরে ওঠা হয় না। কাদম্বরীর গালে আদরের চুম্বন এঁকে, ভোরে জাগানোর দায়িত্বও যেন সে ভুলে গেছে অধুনা।
কাদম্বরী যেন ক্রমশই তাঁর একাকীত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর সংবেদনশীল মনের জমিনে তা নির্মম কশাঘাতের চেয়ে কম কিছু ছিল না। যা তুঙ্গে পৌঁছেছিল, ১৮৮৪ র ১৯ শে এপ্রিল, রবীন্দ্রনাথের বিবাহের মাত্র চার মাস পরে। সেদিন ছিল স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নতুন জাহাজ উদ্বোধনের দিন। কাদম্বরী সেজে গুজে বসেছিলেন, তাঁর স্বামীর তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যার পরে বাড়তে থাকে রাত, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দেখা নেই। আসেন না আদরের রবিও, তাঁকে নিয়ে যেতে। আর নয়, কাদম্বরী এবারে তাঁর দীর্ঘ একাকীত্বের বন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছায় যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে কিছু একটা করার উপায় খুঁজতে লাগলেন পাগলের মত। এখানে দেখেন, ওখানে দেখেন। শেষে ড্রয়ারের মধ্যে পেয়ে যান আফিমের শিশি। মৃত্যুর নেশায়, শিশির পুরোটাই ঢেলে নেন মুখে।
কাদম্বরীর নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা, অবশেষে পূরণ করেন বিধাতা পুরুষ।
যদিও সবরকম চেষ্টা করা হয়, সাহেব ডাক্তার এনে চিকিৎসা করানোর কাজও করা হয় মহা সমারোহে। কিন্তু লাভ কিছু হয় নি। কোমায় চলে গেছিলেন, কাদম্বরী। দু দিন বাদে, ২১ শে এপ্রিল, মাত্র ২৫ বছর বয়সে কাদম্বরীর জীবনের ইতি ঘটে যায়। কিন্তু থেকে যায় অনেক গুলো অস্বস্তিকর প্রশ্ন।
কাদম্বরীর মৃত্যু কি আদৌ আত্মহত্যা ছিল নাকি তিল তিল করে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, এ প্রশ্ন উঠেছিল সেদিনও। আজও তা সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।
না হলে কেন অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও, মৃত দেহ ময়না তদন্ত করা হোল না। ঠাকুর বাড়ির সম্মানহানি ঘটতে পারে এই অজুহাতে ঘরেই বসানো হোল করোনারস কোর্ট। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংবাদ মাধ্যমকে ঘুষ খাইয়ে সেদিনকার খবরকে বেমালুম চেপে দিয়েছিলেন। তাই কোথাও সে খবর ছাপা হয় না।
কিন্তু কেন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল কাদম্বরীর সুইসাইড নোট, রবীন্দ্রনাথকে লেখা শেষ চিঠি অথবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে লেখা জাহাজের এক মহিলা কর্মীর প্রেম পত্র? এই প্রশ্ন গুলো আজীবন থেকে যাবে।রবীন্দ্রনাথের দায়ও তো কিছু কম ছিল না। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিলেন দুর্দান্ত। পরবর্তীতে অনেক লেখায় নাকি সেই শোকের প্রভাব দেখা যায়। ‘নষ্ট নীড়’ এর গল্পেও নাকি ছিল কাদম্বরী ও তাঁর মধ্যেকার সম্পর্কের ছায়া। কিন্তু দেখা যায় তাঁর আত্মকথা ‘জীবন স্মৃতি’ তে শুধু বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতন করে উল্লেখ করেছিলেন কাদম্বরীর মৃত্যুর কথা, “‘ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনও দিন প্রত্যক্ষ করি নাই। কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়…। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া চলিয়াছে।’
এ সব সত্ত্বেও, যে প্রশ্ন বারবার ফিরে ফিরে আসে মনে সেটা হল, দিনের পর দিন কাদম্বরীর সম্পর্কে নানা মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। কখনো সেটা শুধু তাঁর নিসন্তান হওয়ার কারণে তিনি ঊর্মিলার মৃত্যুর জন্য দায়ী – এরকম মধ্যযুগীয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন গঞ্জনারও শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু দিনের পর দিন এ সব শুনেও ররবীন্দ্রনাথের মত উদার মনস্ক, আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ কেন ফুঁসে ওঠেননি এর বিরুদ্ধে?
কেন বিবাহের আগে যে রবীন্দ্রনাথ চোখে হারাতেন কাদম্বরীকে, সে কি শুধু ‘বৌঠানের’ একাকীত্ব ঘোচাতে? যদি তাই হয়, তাহলে বিবাহের পরে কেন কাদম্বরীর প্রতি তাঁর উদাসীনতা দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেও ছাপিয়ে গেছিল?
কেন, তিনি অন্যায় হচ্ছে জেনেও তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথের সমস্ত নথি লোপাটের চেষ্টার বিরুদ্ধে একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারন করেননি?
কেন তিনি ১৯ শে এপ্রিল, তাঁর বৌঠানকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি তাঁর নব বিবাহিত স্ত্রীর কাছে তাঁর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে ভুলে যাওয়ার ভাণ করেছিলেন শুধু?
সব শেষে যে প্রশ্ন অচেনা ঠেকলেও সবথেকে বেশি বিড়ম্বিত করে সেটা হোল কাদম্বরী যে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করলেন, সেই আফিম ঠাকুর বাড়ির মত সম্ভ্রান্ত ঘরের অন্তপুরবাসিনী গৃহ বধূ কাদম্বরীর কাছে পৌঁছল কি করে?
তথ্য সুত্রঃ রবীন্দ্রনাথ প্রনীত 'জীবন স্মৃতি'
'কাদম্বরীর সুইসাইড নোট', রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে আরো লেখা -
চলচ্চিত্র পরিচালক, রবীন্দ্রনাথের মন্দ ভাগ্য!
রবীন্দ্রনাথের টিনেজ লাভ!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন