সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পথে শালিকের এক্কা দোক্কা!

 শালিকের গায়ের ধূসরতায়, জানিনা কেন - ভুলে যাওয়া কোনো স্বপ্নের ঘোর যেন লেগে থাকে সর্বদা।  পথে একা একটি শালিক, থমকে যাওয়া সময়েরর দ্যোতনা নিয়ে আসে আমার কাছে। তার সর্বগ্রাসী নিঃসঙ্গতায় দ্রবীভূত হয়ে যেতে চায়  আমার পুরো অস্তিত্ব। শালিকের হলুদ দুটো পা, সেখানে সবসময়ের জন্যে লেগে থাকে দূর অতীতের কোনো বিকেলবেলার স্মৃতিমেদুর রোদ, আমার মন যেখানে যেতে চায় বারবার। ঠোঁট দুটিতে লেপা থাকে, পাকা হিমসাগরের রঙ। চোখের চারিদিকে ঘিরে থাকে, বিষণ্ণতার হলুদ বৃত্ত।


পথে কখনো দেখা যায়, ইলেকট্রিকের খুঁটি থেকে ঝুপ করে নেমে আসে, এক জোড়া শালিক। পথের ধার ঘেঁষে, ঘাসের মধ্যে থেকে কিছু খুঁটে খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা করে যে যার মতন। তবু জোড়াতেই থাকে- দুটি হৃদয়, চারটি পা। মায়ের হাত ধরে যে ভালো ছেলেটি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল স্কুলে, সে ডান হাত বুক অব্দি তুলে হাওয়ায় সেলাম ঠুকে অস্ফুটে বলে ওঠে, “দুটো শালিক নমস্কার”।
শালিকের ডানায় লুকোনো শুভ্রতা, তাড়িত উড়ানে বিকশিত হয়ে পড়ে পালকের বাদামী ধূসরতা সরে গিয়ে। আর, গলা থেকে অবধারিত ভাবে বেরিয়ে আসে টেক অফের  হুইশল। উড়ে, আর যাবে কতদুর? হয় শ্যাওলা ধরা কোনো বাড়ির কার্নিশে না হয় ঘুলঘুলির পাঁজরে।  কিংবা কোনো পত্রশূন্য আমড়ার ডালে। কত না অভিযোগ, কমলা ঠোঁট দিয়ে বারবার পালকের বুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গরর, গরর আওয়াজ বের করা, অক্লান্তভাবে। ভাবখানা যেন, অনেক হয়েছে। আর নয়।
এক পশলা ভারী বৃষ্টির পরে, রাস্তার খানা খন্দে জমে থাকা জলেই নাইতে নামে শালিক। কোনো এক নির্জন দুপুরবেলায়,  চিলেকোঠায় বসে দেখেছিলাম শালিকের চান।, গোপনে।  এক পরম অন্তরঙ্গতায়, মাথা চোবানো জলের ঝারি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তার পালক স্নান। বিন্দু, বিন্দু কাদা মাটি মেশা কালো জলের ফোঁটা পালক পৃষ্টে যে কি শুচি স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে, তা কেবল সেই জানে।
যূথযাপনে অভ্যস্ত শালিকের একাকীত্ব বড়ই বেমানান। সদা মুখরতায় মগ্ন শালিকের নীরবতা তাই ভগ্ন হৃদয়ের বোবা বিলাপের বিষ মাখা তীর হয়ে বিদীর্ণ করে দিতে চায় আমার বুক। মনে পড়ে যায়, সেই দিনই  ধস নামে শেয়ার বাজারে। অনেক আশা নিয়েও মেলেনা লটারির টিকিট। চাকরির প্রাপ্তির তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায় না নিজের নাম। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত প্রশ্ন আসে না। তাহলে কি একা শালিকের মর্ম বেদনা এতটাই সংক্রামক যে এই ভাবে তা ছুঁয়ে দিতে চায় সকল  প্রত্যক্ষদর্শীর হৃদয়কে?
হোস্টেলের চাতালে দুটি শালিক মিলে তুলে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল শুকনো পাতার ডাঁটি, পড়ে থাকা সূতলি দড়ি, আইসক্রিমের খাঁচি, ছেঁড়া কাগজ সহ আরো কত কিছু। কাছেই, বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার কোটরে তাদের বাসা।  হয়তো সেই সংসারে আসতে চলেছে নতুন অতিথি কোনো, নীল ডিম ফুটে ছোট্ট শালিক শাবকের প্রাক-আগমনী আয়োজন সারতেই এত তৎপরতা। করিডোর দিয়ে যাতায়াতের সময় যারা যারা শালিক দুটিকে দেখেছিল,  হয়তো সেদিন বাস, ট্রেন ধরতে তাদের বেশী বেগ পেতে হয়নি, হয়তো বস পিঠ চাপড়ে সেদিন তার কাজের প্রশংসা করেছিল দারুণ ভাবে। অপ্রত্যাশিত ভাবেই কপালে জুটেগেছিল, তুমুল এক সুন্দরীর ইঙ্গিত পূর্ণ হাঁসির প্রশ্রয়। ব্যবসায়ে এসেছিল লাভের বাণ। পাওয়া গেছিল নিজের মতে একমত হওয়া অনেক লোককে।
একদিন বগুড়ামের সমুদ্র তীরে, ন্যাড়া ঝাউ গাছের ডগায় দেখেছিলাম একা, এক গাঙশালিককে বসে থাকতে। পালক ফুলিয়ে, জবুথবু হয়ে; যেন কত বেদনায়, মরমে মরে যাওয়া একটি অতি অকিঞ্চিৎকর প্রাণের অস্তিত্ব, তবু সে অনবরত শুষে নিচ্ছিল সুদীর্ঘ সাগরতটের সমস্ত আগ্রহ, উদ্দীপনাকে। যখন দিনের আলো, জীবনানন্দের “রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মত” নিভে যাচ্ছিল, পশ্চিমি ঊর্মিঝঞ্ঝায় ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া সূর্যের সাথে সাথে
কবি জীবনানন্দ, শালিকের বেশে আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন এই বাংলায়। ভাত শালিকের মত মাথায় টানা কালো ঘোমটা দিয়ে। আর এযুগের কবি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য “এক শালিক” হয়ে ইউ টিউবের পর্দায় কথা বলেন নানান বিষয়ে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...