শালিকের গায়ের ধূসরতায়, জানিনা কেন - ভুলে যাওয়া কোনো স্বপ্নের ঘোর যেন লেগে থাকে সর্বদা। পথে একা একটি শালিক, থমকে যাওয়া সময়েরর দ্যোতনা নিয়ে আসে আমার কাছে। তার সর্বগ্রাসী নিঃসঙ্গতায়
দ্রবীভূত হয়ে যেতে চায় আমার পুরো
অস্তিত্ব। শালিকের হলুদ দুটো পা, সেখানে সবসময়ের জন্যে লেগে থাকে দূর
অতীতের কোনো বিকেলবেলার স্মৃতিমেদুর রোদ, আমার মন যেখানে যেতে চায় বারবার। ঠোঁট
দুটিতে লেপা থাকে, পাকা হিমসাগরের রঙ। চোখের
চারিদিকে ঘিরে থাকে, বিষণ্ণতার হলুদ বৃত্ত।
শালিকের ডানায় লুকোনো শুভ্রতা, তাড়িত উড়ানে বিকশিত হয়ে পড়ে পালকের বাদামী ধূসরতা সরে গিয়ে। আর, গলা থেকে অবধারিত ভাবে বেরিয়ে আসে টেক অফের হুইশল। উড়ে, আর যাবে কতদুর? হয় শ্যাওলা ধরা কোনো বাড়ির কার্নিশে না হয় ঘুলঘুলির পাঁজরে। কিংবা কোনো পত্রশূন্য আমড়ার ডালে। কত না অভিযোগ, কমলা ঠোঁট দিয়ে বারবার পালকের বুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গরর, গরর আওয়াজ বের করা, অক্লান্তভাবে। ভাবখানা যেন, অনেক হয়েছে। আর নয়।
এক পশলা ভারী বৃষ্টির পরে, রাস্তার খানা খন্দে জমে থাকা জলেই নাইতে নামে শালিক। কোনো এক নির্জন দুপুরবেলায়, চিলেকোঠায় বসে দেখেছিলাম শালিকের চান।, গোপনে। এক পরম অন্তরঙ্গতায়, মাথা চোবানো জলের ঝারি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল তার পালক স্নান। বিন্দু, বিন্দু কাদা মাটি মেশা কালো জলের ফোঁটা পালক পৃষ্টে যে কি শুচি স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে, তা কেবল সেই জানে।
যূথযাপনে অভ্যস্ত শালিকের একাকীত্ব বড়ই বেমানান। সদা মুখরতায় মগ্ন শালিকের নীরবতা তাই ভগ্ন হৃদয়ের বোবা বিলাপের বিষ মাখা তীর হয়ে বিদীর্ণ করে দিতে চায় আমার বুক। মনে পড়ে যায়, সেই দিনই ধস নামে শেয়ার বাজারে। অনেক আশা নিয়েও মেলেনা লটারির টিকিট। চাকরির প্রাপ্তির তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায় না নিজের নাম। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত প্রশ্ন আসে না। তাহলে কি একা শালিকের মর্ম বেদনা এতটাই সংক্রামক যে এই ভাবে তা ছুঁয়ে দিতে চায় সকল প্রত্যক্ষদর্শীর হৃদয়কে?
হোস্টেলের চাতালে দুটি শালিক মিলে তুলে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল শুকনো পাতার ডাঁটি, পড়ে থাকা সূতলি দড়ি, আইসক্রিমের খাঁচি, ছেঁড়া কাগজ সহ আরো কত কিছু। কাছেই, বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার কোটরে তাদের বাসা। হয়তো সেই সংসারে আসতে চলেছে নতুন অতিথি কোনো, নীল ডিম ফুটে ছোট্ট শালিক শাবকের প্রাক-আগমনী আয়োজন সারতেই এত তৎপরতা। করিডোর দিয়ে যাতায়াতের সময় যারা যারা শালিক দুটিকে দেখেছিল, হয়তো সেদিন বাস, ট্রেন ধরতে তাদের বেশী বেগ পেতে হয়নি, হয়তো বস পিঠ চাপড়ে সেদিন তার কাজের প্রশংসা করেছিল দারুণ ভাবে। অপ্রত্যাশিত ভাবেই কপালে জুটেগেছিল, তুমুল এক সুন্দরীর ইঙ্গিত পূর্ণ হাঁসির প্রশ্রয়। ব্যবসায়ে এসেছিল লাভের বাণ। পাওয়া গেছিল নিজের মতে একমত হওয়া অনেক লোককে।
একদিন বগুড়ামের সমুদ্র তীরে, ন্যাড়া ঝাউ গাছের ডগায় দেখেছিলাম একা, এক গাঙশালিককে বসে থাকতে। পালক ফুলিয়ে, জবুথবু হয়ে; যেন কত বেদনায়, মরমে মরে যাওয়া একটি অতি অকিঞ্চিৎকর প্রাণের অস্তিত্ব, তবু সে অনবরত শুষে নিচ্ছিল সুদীর্ঘ সাগরতটের সমস্ত আগ্রহ, উদ্দীপনাকে। যখন দিনের আলো, জীবনানন্দের “রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মত” নিভে যাচ্ছিল, পশ্চিমি ঊর্মিঝঞ্ঝায় ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া সূর্যের সাথে সাথে
কবি জীবনানন্দ, শালিকের বেশে আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন এই বাংলায়। ভাত শালিকের মত মাথায় টানা কালো ঘোমটা দিয়ে। আর এযুগের কবি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য “এক শালিক” হয়ে ইউ টিউবের পর্দায় কথা বলেন নানান বিষয়ে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন