সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

G20, 2023: ভারতীয়ত্বের মোড়কে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা?

১৮তম G20 শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়ে গেল দিল্লীতে। দু-দিনের এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ২০ টি সদস্য দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও আরো ৯ টি দেশের আমন্ত্রিত রাষ্ট্র নেতারা। সর্বসম্মত ভাবে ঘোষিত হল ৫ দফা দিল্লী ঘোষণাপত্র। সব থেকে বড় পাওনা অবশ্যই আফ্রিকান দেশ গোষ্ঠীর নতুন সদস্যপদ লাভ। ভারতের সভাপতিত্বে আয়োজিত ২০২৩ এর এই শীর্ষ সম্মেলন এই কারনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। আরো যে কারনে, ভারতে মাটিতে প্রথম আয়োজিত হওয়া এই G20 সামিট, ভবিষ্যৎ সময়ের কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবে সেটা হল হিন্দুত্বের রসে জারিত এক নতুন ভারতীয়ত্বের প্রতিষ্ঠালাভ। 

একথা আমরা সকলেই জানি, ভারত আত্মার খোঁজ পেতে বিদগ্ধজনেরা সর্বদা বিবিধের মাঝেই তাঁদের সে সন্ধান চালানোর প্রয়াস করে এসেছেন। এবং তাতে সফলও হয়েছেন। বহুত্ববাদের অমৃতেই ভারত তার অমরত্বের রসদ পেয়ে এসেছে চিরকাল। তাই তো ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর ভাষায় ভারতের ঐক্যের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এই ভাবে, “In India, there is unity in diversity and diversity in unity”. ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুও তাঁর বিখ্যাত বই ‘Discovery of India’ য় স্মিথেরই কথার প্রায় পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, ভারতের বর্ণনা করতে গিয়ে। ভারতবর্ষের ঐক্যের সাধনা আসলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবোধের সাধনা। কবি-গীতিকার অতুলপ্রসাদ তাঁর অমোঘ উচ্চারনে যে গানের লাইনকে অমর করে দিয়ে গেছেন, তাতেও দেখা যাচ্ছে ভারতের ঐক্য রক্ষায় তিনি প্রায় একই ভাবে বিবিধতার ব্রত যাপনের কথাই বলেছেন তাঁর মত করে, “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান”। কিন্তু G20 তে আসা অতিথিদের কাছে এবং ১৪০ কোটি ভারতবাসীর কাছে যে নতুন ভারতবর্ষের পরিচয় করানোর চেষ্টা হল তাতে বর্তমান শাসক দলের ঘোষিত হিন্দুত্বের এজেণ্ডাকেই তথাকথিত ভারতীয়ত্বের মোড়কে পরিবেশন করার অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়ে পড়লো বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না।  পেঁয়াজের খোসার মত একের পর এক পাতা ছাড়িয়ে দেখা যাবে সেই রহস্যের প্রমান। গত বছর, ২০২২ এ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে আয়োজিত G20 শীর্ষ সম্মেলনেই স্থির হয়ে যায় পরবর্তী সামিটের দায়িত্ব পাচ্ছে নরেন্দ্রে মোদী শাসিত ভারত সরকার। আর সেই থেকেই বলতে গেলে শুরু হয়ে যায় হিন্দুত্বের মোড়কে নতুন এক ভারতীয়ত্বকে সর্বসমক্ষে পেশ করার লক্ষে সলতে পাকানোর কাজ। তাই সম্মেলনের থিম বাছতে এক কথায় পাশ হয়ে যায় উপনিষদের পাতায় উদ্ধৃত ‘বসুধইব কুটুম্বকম’। “One earth, one family” । শুরু হয় নতুন বিশ্বমানের কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের প্রস্তুতি। রাজধানীর প্রগতি ময়দানে ১২৩ একর জায়গা জুড়ে চলে ভগবান বাসবেশ্বরের ‘অনুভব মণ্ডপমের’ ভাবনায় State of the art কনভেনশন সেন্টার - ভারত মণ্ডপমের নির্মাণ কাজ। তার স্থাপত্যশৈলী শঙ্খ আকৃতির। যে পাঞ্চজন্য শঙ্খ দেখা যায় ভগবান কৃষ্ণের হাতে, আর যে ‘পাঞ্চজন্য’ নামে সাপ্তাহিক মুখপত্র প্রকাশিত হয় বর্তমান শাসক দল বি জে পির থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক আর এস এস এর সদর দপ্তর থেকে।

ভারত মণ্ডপমের প্রবেশদ্বারে বসে ১৮ টন ওজনের ব্রোঞ্জ নটরাজ মূর্তি, যার উচ্চতা ২৯ ফুট। প্রায় সাত মাসের পরিশ্রমে এই নটরাজের মূর্তি যিনি গড়েছেন তিনি - তামিলনাড়ুর প্রখ্যাত ভাস্কর রাধাকৃষ্ণণ শতপথি। এখানেই শেষ নয়। হিন্দু দেবতার মূর্তি আরো বসলো কনভেনশন সেন্টারেরই এক পাশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রদর্শশালা হিসেবে চিহ্নিত হলের প্রবেশ দ্বারে। ২০ হাত বিশিষ্ট কাঠের মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি এবং তার ডান দিকে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। সেন্টারের প্রবেশপথের দেওয়াল জুড়ে থাকলো তাঞ্জর চিত্রশিল্পের নিদর্শন।  প্রধানমন্ত্রী এই বছর ২৬ শে জুলাই উদ্বোধন করেন এই ভারত মণ্ডপমের। প্রসঙ্গত, মোঘলদের আমলে বেড়ে ওঠা মিনিয়েচার চিত্রশিল্প সারা জগত বিখ্যাত। এবং তা ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের একটা মুল্যবান শিল্প ঘরানা হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু সেটি কে আত্মস্থ করার বদলে পরিত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করেছে এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগররা।
এবং অবশেষে এল সেই দিন, ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৮ তম G20 শীর্ষ সম্মেলন যেদিন শুরু হল ভারত মণ্ডপমে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে আসা রাষ্ট্র নেতাদের অভিবাদন জানাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন কনারকের সূর্য মন্দিরের সেই সুমহান রথচক্রের রেপ্লিকার সামনে। করলেন স্বাগত করমর্দন।
প্রথমদিনের অধিবেশন শেষে, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এক বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করলেন। মণ্ডপমেরই Multifunctional Hall-এ। নৈশভোজের হোস্ট রাষ্ট্রপতিকে দেখা গেল তথাকথিত হিন্দু সভ্যতার গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দেশী বিদেশী অতিথিদের অভিনন্দন জানাতে। নৈশভোজের মেনুতেও দেখা গেল গোঁড়া হিন্দুত্বের ছাপ। কোনো মোঘলাই নয়, এমনকি মাংসের কোনো পদ ব্যতিরেকেই ডিনারের মেনু সাজানো হয়েছিল জোয়ার, বাজরা, রাগী দ্বারা তৈরি তথাকথিত ভারতীয় খানা দিয়ে। ছিল মিষ্টি এবং খাওয়ার শেষে মুখশুদ্ধির পান।

‘গোদী’ মিডিয়ার বদান্যতায় দেশবাসী দেখতে পেল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক কেমন নিজের হিন্দুত্বের কথা গর্বের সঙ্গে বলছেন। ফলাও করে দেখানো হল সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ১০ই সেপ্টেম্বর কেমন সস্ত্রীক সুনক দিল্লীর অক্ষরধাম মন্দিরে হাত জোড় করে প্রনাম করার ঢঙে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু দেখানো হল না, ঐতিহাসিক ইমারতের শহর দিল্লীর বিভিন্ন সৌধ যেমন কুতুব মিনার কিংবা হুমায়ুনের সমাধি স্থল দেখতে যাওয়া বিদেশী রাষ্ট্র নেতাদের ভিড়কে।
ভারতবর্ষ কি তাহলে তার ছোট ছোট অস্তিত্বগুলিকে ঢেকে দিতে চায় গরিষ্ঠতার গরিমা দিয়ে? “শত ফুল বিকশিত হোক” না কি ভারতবর্ষের পরিচয় হয়ে উঠবে আগামী দিনে এক ফুলের দেশ বলে। তার বৈচিত্র্যকে কি আর স্বীকার করবে না কোনো এক গরিষ্ঠতার দর্শন। এই ‘বর্ণান্ধ’ দেশ কি আমাদের কারোর কাম্য হওয়া উচিত। তবে এটা ঠিক বি জে পি তার হিন্দুত্বের এজেণ্ডাকে এই সম্মেলনের মাধ্যমে অত্যন্ত সফল ভাবে তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্রবাদে উত্তীর্ণ করতে সফল হয়েছে। কিন্তু সঠিক ভারতীয়ত্বে উত্তীর্ণ করতে বোধহয় এখনও অনেক দূর যেতে হবে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...