মহালয়ার সন্ধ্যায়, মেঘ যেন ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে তার বৃষ্টি তর্পণ শুরু করেছে। কথায় বলে, একা অমাবস্যায় হয় না, কৃষ্ণ মেঘ দোসর। একে তো আকাশ আজ চন্দ্রহীন, তারপরেও ওইরকম টিমটিম করে জ্বলা, কয়েক পুঞ্জ নক্ষত্রকেও যদি, মেঘ তার কালো কম্বলের তলায় ঘুম পাড়িয়ে রাখে তো আর রইলোটা কি, হাতে হ্যারিকেন ছাড়া! মা আসছেন, বেতার ভবন থেকে, দেবীপক্ষের সূচনা ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু কিছু মজা আসছে না। বৃষ্টির ছাঁট, ট্রেনের জানালা দিয়ে, পুজোর চাঁদা তুলতে আসা পাড়ার মাতব্বরদের মতো ছিটপিট করে ঢুকে পড়ছে , আর চোখ মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দিনের আলো থাকতে, রূপনারায়ণের দুই পাড়ে - খানিক কাশের দোল খাওয়া দেখা যেত। বর্ষা উত্তর, রূপনারায়ণের ভরা যৌবন; আর তাতে জোয়ারের সময় কেমন কাশ ফুল গুলো ডুবে ডুবে জল খায়, তাও দেখা যেত মন্দ নয়। কিন্তু এখন জানালার বাইরে শুধুই অন্ধকার। নিকষ কালো। সমুদ্রের মতন। দূরে মাছের ভেড়িতে জ্বলে থাকা আলো গুলো যেন ছোট ছোট খেয়া নৌকার মতো টলমল করছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চকমকি, আঁধারের কেশগুচ্ছ কে যেন ছিঁড়ে, ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে। সাথে গুরু গুরু কন্ঠে, মেঘের উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত চর্চা আর যাই হোক শারদীয়া পূজার আবহ তৈরি করতে পারছে না। যথারীতি এক গুচ্ছ নামী, অনামী শারদ সংখ্যা বেরিয়ে গেছে বাজারে। শিউলি তার বাসর সাজাচ্ছে ভূমিতলে। স্বর্ণালী সেগুন মঞ্জরী, লবঙ্গ গ্রন্থিত লতিকা মিষ্টান্নের ন্যায় সবুজ পুষ্প পুটে ভরিয়ে দিচ্ছে - পীলসুজের মত দেখতে শাখা প্রশাখার অগ্রভাগ।
তবে আজ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে আকুল করে গেল। বেশ একটু দোলাচলেই পড়ে গেছিলাম, কারণ দুর্গা পুজা এখন এলোই না আর ছাতিম কিনা তার পসরা নিয়ে হাজির হয়ে গেল। শরতে, ছাতিম ফুলের এমন মায়াময় বিস্তার, শাখা প্রশাখা গুলো যেন ফুলের ভারে ঝুলে পড়তে চাইছে মাটিতে। কুসুম্বা হাই স্কুলের উঁচু পাঁচিল টানা দোতলা বাড়ির সামনে - লোহার বড় গেটটার মুখে ছাতিম গাছটা আজ, মৌমাছি আর ভ্রমরের গুঞ্জনে যেন বেশ মজে আছে মনে হল। হালকা হাওয়ার খুনসুটিতেই ঝরিয়ে দিচ্ছে হলুদ পুষ্প চূর্ণ। ভাগ্যিস আজ মহালয়ার কারণে স্কুল বন্ধ। নয়তো ছাত্র ছাত্রীদের, সেই অপূর্ব ছাতিম শয্যা মাড়িয়ে মাড়িয়েই স্কুলে ঢুকতে হতো। ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে। ভোরবেলা, পাশের ঘর থেকে টিভিতে - তারস্বরে কোনো মহিষাসুরবধ গীতিনাট্য চলছে বোধহয়, আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।। শোনা যাচ্ছে দেবীর রণ হুঙ্কার। আর এদিকে ছাতিমের মন কেমন করা গন্ধ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি পুজোর অন্য মানে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। বৃষ্টি একটু কমেছে বোধহয়। জানালার কাঁচ তুলে দিতেই হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়লো কামরার মধ্যে। লাইনের দুপাশে - নয়ানজুলিতে, প্রচুর পদ্ম ফুটে আছে নিশ্চয়ই, দিনের বেলা হলে দেখা যেত বেশ। গোলাপি আভা যুক্ত অর্ধ বা পূর্ণ প্রস্ফুটিত কোমল কোকনদ। সকালবেলায়, ডোঙায় করে পদ্ম ফুল তুলতে আসে মালি। একদিন, নন্দাই গাজন স্টেশনে এক পেয়ারাওয়ালা উঠতেই জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা এই ফুল কি সারাবছর হয়? নাকি এই পুজোর সময়েই ফোটে? তা উনি বললেন কি, শরৎ এলেই যেন বেশী বেশী করে ফোটে, অন্য সময়ের চেয়ে। মায়ের পুজো আসছে, তাই প্রকৃতিও তার পসরা সাজাতে থাকে। খানিক দূরে শালুক ফুল ফূটে থাকতে দেখা যায় বিল গুলোয়। বৃষ্টির জল পেয়ে, বেশ ডগমগ হয়ে ওঠে শাপলা। তা পদ্ম বনে, শুনেছি বিষাক্ত সাপ থাকে। হ্যাঁ, পদ্ম খরিস থাকে। কামড়ায় না? জিজ্ঞাসা করলাম। তা সেই পেয়ারাওয়ালা, তিনি নিজেও কখনো কখনো পদ্ম ফুল তুলতে নেমেছেন ডোঙায় চড়ে। কখনো কখনো তো, মালি তার ছোট বাচ্চাকেও নিয়ে আসেন সঙ্গে করে। ভয় লাগে না? তা উনি বললেন কি, সাপ, সে চেনে মালি কে। তাই কিচ্ছুটি বলে না। বলতে বলতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে আসছে পুজোও। রোদের রঙে, শরতের সেই অনাবিল ট্রেডমার্ক মার্কা মখমলি ঝলক নাই বা থাকলো। পুজোর ছুটি পড়লো বলে। ঘরে ফেরা মানুষের ঢল লাগলেই মনে হয় পুজো আর বেশী দিন বাকি নেই।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন