সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সেগুন মঞ্জরী ও দেবীপক্ষের সূচনা!

মহালয়ার সন্ধ্যায়, মেঘ যেন ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে তার বৃষ্টি তর্পণ শুরু করেছে। কথায় বলে, একা অমাবস্যায় হয় না, কৃষ্ণ মেঘ দোসর। একে তো আকাশ আজ চন্দ্রহীন, তারপরেও ওইরকম টিমটিম করে জ্বলা, কয়েক পুঞ্জ নক্ষত্রকেও যদি, মেঘ তার কালো কম্বলের তলায় ঘুম পাড়িয়ে রাখে তো আর রইলোটা কি, হাতে হ্যারিকেন ছাড়া! মা আসছেন, বেতার ভবন থেকে, দেবীপক্ষের সূচনা ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু কিছু মজা আসছে না। বৃষ্টির ছাঁট, ট্রেনের জানালা দিয়ে, পুজোর চাঁদা তুলতে আসা পাড়ার মাতব্বরদের মতো ছিটপিট করে ঢুকে পড়ছে , আর চোখ মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দিনের আলো থাকতে, রূপনারায়ণের দুই পাড়ে - খানিক কাশের দোল খাওয়া দেখা যেত। বর্ষা উত্তর, রূপনারায়ণের ভরা যৌবন; আর তাতে জোয়ারের সময় কেমন কাশ ফুল গুলো ডুবে ডুবে জল খায়, তাও দেখা যেত মন্দ নয়। কিন্তু এখন জানালার বাইরে শুধুই অন্ধকার। নিকষ কালো। সমুদ্রের মতন। দূরে মাছের ভেড়িতে জ্বলে থাকা আলো গুলো যেন ছোট ছোট খেয়া নৌকার মতো টলমল করছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চকমকি, আঁধারের কেশগুচ্ছ কে যেন ছিঁড়ে, ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে। সাথে গুরু গুরু কন্ঠে, মেঘের উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত চর্চা আর যাই হোক শারদীয়া পূজার আবহ তৈরি করতে পারছে না। যথারীতি এক গুচ্ছ নামী, অনামী শারদ সংখ্যা বেরিয়ে গেছে বাজারে। শিউলি তার বাসর সাজাচ্ছে ভূমিতলে। স্বর্ণালী সেগুন মঞ্জরী, লবঙ্গ গ্রন্থিত লতিকা মিষ্টান্নের ন্যায় সবুজ পুষ্প পুটে ভরিয়ে দিচ্ছে - পীলসুজের মত দেখতে শাখা প্রশাখার অগ্রভাগ।

তবে আজ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে আকুল করে গেল। বেশ একটু দোলাচলেই পড়ে গেছিলাম, কারণ দুর্গা পুজা এখন এলোই না আর ছাতিম কিনা তার পসরা নিয়ে হাজির হয়ে গেল। শরতে, ছাতিম ফুলের এমন মায়াময় বিস্তার, শাখা প্রশাখা গুলো যেন ফুলের ভারে ঝুলে পড়তে চাইছে মাটিতে। কুসুম্বা হাই স্কুলের উঁচু পাঁচিল টানা দোতলা বাড়ির সামনে - লোহার বড় গেটটার মুখে ছাতিম গাছটা আজ, মৌমাছি আর ভ্রমরের গুঞ্জনে যেন বেশ মজে আছে মনে হল। হালকা হাওয়ার খুনসুটিতেই ঝরিয়ে দিচ্ছে হলুদ পুষ্প চূর্ণ। ভাগ্যিস আজ মহালয়ার কারণে স্কুল বন্ধ। নয়তো ছাত্র ছাত্রীদের, সেই অপূর্ব ছাতিম শয্যা মাড়িয়ে মাড়িয়েই স্কুলে ঢুকতে হতো। ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে। ভোরবেলা, পাশের ঘর থেকে টিভিতে - তারস্বরে কোনো মহিষাসুরবধ গীতিনাট্য চলছে বোধহয়, আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।। শোনা যাচ্ছে দেবীর রণ হুঙ্কার। আর এদিকে ছাতিমের মন কেমন করা গন্ধ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, আমি পুজোর অন্য মানে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। বৃষ্টি একটু কমেছে বোধহয়। জানালার কাঁচ তুলে দিতেই হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়লো কামরার মধ্যে। লাইনের দুপাশে - নয়ানজুলিতে, প্রচুর পদ্ম ফুটে আছে নিশ্চয়ই, দিনের বেলা হলে দেখা যেত বেশ। গোলাপি আভা যুক্ত অর্ধ বা পূর্ণ প্রস্ফুটিত কোমল কোকনদ। সকালবেলায়, ডোঙায় করে পদ্ম ফুল তুলতে আসে মালি। একদিন, নন্দাই গাজন স্টেশনে এক পেয়ারাওয়ালা উঠতেই জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা এই ফুল কি সারাবছর হয়? নাকি এই পুজোর সময়েই ফোটে? তা উনি বললেন কি, শরৎ এলেই যেন বেশী বেশী করে ফোটে, অন্য সময়ের চেয়ে। মায়ের পুজো আসছে, তাই প্রকৃতিও তার পসরা সাজাতে থাকে। খানিক দূরে শালুক ফুল ফূটে থাকতে দেখা যায় বিল গুলোয়। বৃষ্টির জল পেয়ে, বেশ ডগমগ হয়ে ওঠে শাপলা। তা পদ্ম বনে, শুনেছি বিষাক্ত সাপ থাকে। হ্যাঁ, পদ্ম খরিস থাকে। কামড়ায় না? জিজ্ঞাসা করলাম। তা সেই পেয়ারাওয়ালা, তিনি নিজেও কখনো কখনো পদ্ম ফুল তুলতে নেমেছেন ডোঙায় চড়ে। কখনো কখনো তো, মালি তার ছোট বাচ্চাকেও নিয়ে আসেন সঙ্গে করে। ভয় লাগে না? তা উনি বললেন কি, সাপ, সে চেনে মালি কে। তাই কিচ্ছুটি বলে না। বলতে বলতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে আসছে পুজোও। রোদের রঙে, শরতের সেই অনাবিল ট্রেডমার্ক মার্কা মখমলি ঝলক নাই বা থাকলো। পুজোর ছুটি পড়লো বলে। ঘরে ফেরা মানুষের ঢল লাগলেই মনে হয় পুজো আর বেশী দিন বাকি নেই।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...