সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কৈলাসে কামরাঙা!

কৈলাসে, তোলপাড়! কার্তিক যে ভেতরে ভেতরে এমন ফুলের সন্ধান কোথায় পেল, সেটা নিয়ে মায়ের বিস্ময়ের শেষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, মা তাঁর বাপের জন্মে এমন ফুল দেখেননি। হিমালয় কন্যা থেকে শিবের ঘরণী হয়েছেন, তাও কত যুগ হয়ে গেল। কিন্তু এমন ফুল কস্মিনকালে চোখে পড়েনি তাঁর। কটা দিনের জন্যে বাপের বাড়িতে যান। পথে, তাকে স্বাগত জানাতে কম হোর্ডিং, ব্যানার তো লাগায় না, পুজোর ইভেন্ট ম্যানেজাররা। তাতে তো থাকে ঐ শিউলি, কাশ আর পদ্ম। একেবারে ছেবড়ে ফেলে, রাস্তার দুপাশ। আর একবার মন্ডপে ঢুকে গেলে, বেতের ধামায় যা যা ফুল সাজানো থাকতে দেখেন তার মধ্যেও সেই বেল, জুঁই, জবা, দোপাটি না হয় অধুনা চাষ করা হাইব্রিড গাঁদাই থাকে বেশী। পদ্ম ফুল তো সেই, লঙ্কায় অকাল বোধনের সময় থেকে দেখে আসছেন। এ সব তো তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু এমন গোলাপী আভা মন্ডিত, গুচ্ছ গুচ্ছ কর্ণ ফুলের মতো পুষ্প মঞ্জরী আগে কখনো দেখেননি। আসলে মা ও এখন ছেলে মেয়েদের মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। কারণ এই নিয়ে তাঁর পতিদেব ভোলানাথের, কোনোরকম হেলদোল নেই। বরং পারলে, নিজের সুঠাম শরীরের কিছু সেলফি পোস্ট করে দিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলতে চান তিনি। মা সবই জানেন, বুড়ো হলেও বাবার বান্ধবী সংখ্যা - যে কোনো বলিউডি হিরোকেও হার মানিয়ে দেয়। তাই তো বাবাকে, মোবাইলের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেন না তিনি। কোথায় আবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না খুলে বসেন। সে যাই হোক, ছেলেমেয়েদেরকে কিন্তু এই ব্যাপারে, মা এখনোও নিজের কন্ট্রোলেই রেখেছেন। কৈলাসে ফিরলেই তাই, লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ কার্তিক এমনকি মহিষাসুরের পর্যন্ত মোবাইল চেক করেন তিনি। লক্ষী সরস্বতীর ফোনে শুধুই নিজস্বী ছবির ছড়াছড়ি। মামার বাড়িতে এই কটা দিনের জন্যে, এ সব ক্ষমা ঘেন্নাও করে দেন তিনি। গণেশ অবশ্য নিজের সেল্ফি তোলে কম; বরং বারকোশে সাজানো নানা কিসিমের ভোগের ছবিই তার ফোনের গ্যালারিতে থাকে ভর্তি করে। তিলের নাড়ু, মোয়া, ক্ষীর, সন্দেশ, লুচি, ফল - এইসবের ছবিই পরিপাটি করে তোলে সে সবসময়।


কামরাঙা ফুল!

মহিষাসুর আবার ঠাকুর পুজার সময়, পুরুত মশাইয়ের কান্ড কারখানার ভিডিও তুলতে ভালোবাসে। কেমন চামর ঘোরাচ্ছেন, পঞ্চ প্রদীপ ধরে আরতি করছেন কিংবা তালপাতার পাখা দুলিয়ে কেমন মায়ের গায়ে হাওয়া করছেন - এসবই। মা, তারিয়ে তারিয়ে দেখেন। উপভোগ ও করেন বেশ।
কার্তিক কিন্তু এদের থেকে পুরো হঠকে। নিজের চেহারাও যেমন কন্দর্প কান্তি, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে কম সুন্দরীরা তো আর আসে না; কার্তিক ঠিক বেছে বেছে তাদের ছবিই তুলে রাখে তার ফোনে। মা জানেন, তাঁর এই চিরকুমার ছেলেটি বড়ই সৌন্দর্য কাতর। তাই কিছুটা ওভারলুক করে যান।
কিন্তু এই এত সুন্দর ফুলের ছবিটাই বা কার্তিক কোথায় পেল? মা কৌতুহল চেপে রাখতে পারেন না আর। সটান ডাকেন, কার্তিকেয় বলে। বাধ্য ছেলের মতো, কার্তিক উপস্থিত হতেই মা তাকে এই অপূর্ব দর্শন ফুলের ব্যাপারে সম্যক অবগত করানোর নির্দেশ দেন। ইত্যবসরে চুপিচুপি, মহাদেব শিবও এসে উপস্থিত হয়েছেন।
"বা! ভারী চমৎকার পুষ্প পুঞ্জ, শিবানী তোমার কবরী কুঞ্জে গ্রন্থিত হলে তার সৌন্দর্য কিছু অন্য মাত্রা পেত বলেই মনে করি!"
পতিদেবের এই কথায় যারপরনাই আহ্লাদিত হলেও, মা তাঁর মুখে কপট গাম্ভীর্যই ঝুলিয়ে রাখেন। এদিকে কার্তিক খানিক ইতস্তত করছে বলতে। "বলো, কার্তিক, চুপ করে থেকো না।"
"এই ফুলটিকে নিশ্চিত তুমি মন্ডপের বাইরে গিয়ে কোথাও দেখে থাকবে!"
"হ্যাঁ... মানে..!"
"না তুমি ভুল কিছু করোনি, পুজো নেওয়ার পর তো অনেক সময় থাকে হাতে।"
"সেইসময় আশেপাশে একটু, মানে সাইড সিন করা মোটেই মন্দ নয়," মায়ের কথায় এবার ময়ূর আরোহী স্কন্দ যেন খানিক আশ্বস্ত হয়।
"তাছাড়া এই ফুলটিকেই আমি আগামী বছর থেকে আমার প্রধান অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করার নির্দেশ দেবো আয়োজকদের!"
"তুমি নিশ্চিন্তে বল কার্তিক, কোথায় পেলে এমন অলংকার সদৃশ অনিন্দ্য সুন্দর কুসুম?"
এর মধ্যে গণেশ এসে হাজির। চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল মায়ের কথা। এবারে কার্তিকের দিকে চেয়ে বললো, " ফুল যখন এত সুন্দর, এর ফল ও নিশ্চিত খুব সুস্বাদু হবে!" "পরের বছর থেকে এটিকে চাই..ই ভোগে!"
"বেশ, বেশ, আগে শুনি এই ফুলটিকে কার্তিক কোথায় পেল, তারপরে দেখছি!"
"বলো, কার্তিক, কোথায় দেখলে তুমি এই ফুল?"
"মা, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল, কাঁথির দারিয়াপুরে তুমি কতবছর ধরে যাচ্ছো, তোমার তো মনে আছে!"
"হ্যাঁ, সে অনেক বছর হলো, যোগেন্দ্রনাথ মাইতির বাড়িতে, বড় আদর করে পুজা অর্চনা করে তারা ফি বছর আমার!"
"সেখানেই মা, সন্ধি পুজার পরে আমি ওদের পুকুর ঘাটে গিয়ে খানিক জিরোতে গিয়েছিলাম।"
"কি অপূর্ব, মাথার ওপরে কত বাতাবি লেবু ঝুলে আছে। আম, কাঁঠালের ছায়ায় বড় মায়াময় শান বাঁধানো সেই ঘাট গুলো!"
"বহু পুরনো, সবুজ শ্যাওলা ধরা জল। চারপাশের পাড়ে অগুনতি নারকেল গাছ!"
গণেশ এবার ক্ষেপে গিয়ে, তাড়াতাড়ি সব বলতে বলে কার্তিককে। "দাদা, তুমি বড্ড বেশী ভূমিকা করছো, অত শোনার সময় নেই মায়ের!"
কার্তিক এবার নড়ে বসে। "ঘাটের পূর্ব দিকে একটা কামরাঙা গাছ রয়েছে, তাতেই এমন সুন্দর ফুল ধরেছিল মা!"
"কৃষ্ণকায় কান্ডের চারপাশে যেন কোনো রমণীর বাহুতে পরা ফুলেল বাজু বন্ধ! "
"থাক, থাক, অনেক হয়েছে ও সব কাব্যকথা! আমার কিন্তু কামরাঙা ভোগে চাই," গণেশের আবদারে মা ঘাড় নাড়েন।
তবে কার্তিক সতর্ক করে দেন, "কামরাঙা খেলে দেখিস, তোর হাতীর দাঁত ও টকিয়ে যাবে কিন্তু।"
মহাদেব এবার হেঁসে ওঠেন খিলখিলিয়ে।
[বিঃ দ্রঃ - প্রসঙ্গত এই রূপকে বর্ণিত যোগেন্দ্রনাথ মাইতি আমার মায়ের ঠাকুরদাযিনি বহু বছর পূর্বে তাঁর বাড়ির ঠাকুর দালানে দুর্গা পুজার সূচনা করেছিলেন। তা এখনোও চলছে। কাঁথির সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলেদারিয়াপুরের মাইতি বাড়ির পুজো বহু প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। মামার বাড়ির সেই পুজোয় গিয়েমহা অষ্টমীর দিন এই কামরাঙা ফুলের ছবিটি তুলেছিলাম। ]


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...