নাগরাকাটার নায়ক! সারা দেশের নজর এখন সেই নায়কের ওপরে। তবে এই পর্বে নায়ক শুধু একজন নন। অনেকে। যাদের কথা না বললেই নয়।
সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গে হয়ে যাওয়া প্রবল বৃষ্টি এবং যার ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ নদী প্লাবন ও ব্যাপক ভূমি ধসের কারণে যে মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হল বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলের মানুষজনকে তাদের মধ্যে নাগরাকাটার অবস্থা ছিল শোচনীয়তম। দুর্গা পূজার শেষ এবং কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার মধ্যেকার এই সময়ে, উৎসবের মুডে থাকা সমগ্র উত্তরবঙ্গ বাসীর কাছে এই দুর্বিপাক সম্ভবত এক ঘোর দুঃস্বপ্নের মতই চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দুর্যোগের সূত্রপাত, গত 4/10/2025 তারিখে। শনিবারের দিন। সন্ধ্যার পরে পরেই শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। চলেছিল সারা রাত্তির ধরে। বরং রাত্রি যত বাড়ছিল, আকাশ ভাঙা সেই বৃষ্টির গতি তত প্রলয়ের আকার ধারন করছিল। যার চরম ক্লাইম্যাক্স দেখা গেল, রাত্রির শেষ প্রহরে এসে।
বৃষ্টির তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে তার আওয়াজে বন্য জন্তুরা পর্যন্ত চুপ করে ছিল। কি হবে, ভেবে! জলপাইগুড়ি জেলার গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক ও তার সংলগ্ন নাগরাকাটা ব্লকের বিস্তির্ণ অঞ্চলের মানুষের মনে তখন গভীর সাসপেন্স। বৃষ্টি হচ্ছিল পাহাড়েও। সিকিম, ভুটান, দার্জিলিংয়ে, একযোগে। যার ফলশ্রুতি, দিনের আলো ফোটার আগেই, পাহাড় বেয়ে নেমে এলো জলের মহা প্লাবন। যার তোড় এতটাই শক্তিশালী যে, ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপরে থাকা ব্রীজও তা প্রতিরোধ করতে পারে নি। নাগরাকাটা ব্লক ও টান্ডু বামনডাঙ্গার মধ্যে সংযোগকারী একমাত্র সেতু - টানাটানি সেতুও, সেই টানে ভেঙে পড়েছে হুড়মুড় করে। অবিরাম বৃষ্টির সঙ্গে পাগলের মতো ধেয়ে আসা জলের গর্জন, তার মধ্যে ভেসে যাওয়া মানুষের চিল চিৎকার, গাছপালা ও ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার কর্কশ আওয়াজ ও ভয়ার্ত বন্য জন্তুদের কাতর গোঙানি - যেন এক হলিউডি থ্রিলার ফিল্মের সিকোয়েন্স তৈরি করেছিল সেই সময়। ফোনে, ভয়ঙ্কর সেই রাতের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন নাগরাকাটার এই পর্বের অন্যতম নায়ক রাহুল মহাশেঠ। ব্লক হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পাশে রামসাই অঞ্চলে বাড়ি। জলের স্রোতে জঙ্গলের গন্ডার, হরিণ কে ভেসে যেতে দেখেছেন তিনি।
১২ ঘন্টার টানা বৃষ্টি ও বেনজির মহা প্লাবনের ফলে যে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চলেছে এই অঞ্চল জুড়ে, তার হিসাব নিকাশ করবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দপ্তর, কিন্তু এইরকম বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যেটা প্রথম প্রয়োজন সেটা হলো বিপর্যয় গ্রস্ত মানুষজনকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধার করা এবং তাদের আপৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। এই কাজে , বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মীদেরকেই সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। গত ৪ঠা অক্টোবর এর ঘটনাতেও তার ব্যত্যয় হলো না।
নাগরাকাটা ব্লক হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টারেই ছিলেন, ব্লক মেডিকেল অফিসার, মোল্লা ইরফান হোসেন। বর্ধমানের গলসিতে বাড়ি। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস আউট । ফার্স্ট পোস্টিং, নাগরাকাটায়, সেকেন্ড মেডিকেল অফিসার হিসেবে। কোভিড মহামারীর সময়ে ও তাঁর উদ্যমী পরিষেবা এলাকার মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। বত্রিশ বছর বয়সী ইরফান হোসেন তাই, পরের দিন সকালেই, প্রথম যে কাজটি করেন সেটি ব্লকের ফার্মাসিস্ট গৌতম ভৌমিককে ফোন করা এবং প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র - যেমন হ্যালোজেন ট্যাবলেট থেকে এ ভি এস - সব পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে কি না জেনে নেওয়া। পুজোর ছুটির মধ্যে এই দুর্যোগ; তাই অনেকেই ছুটিতে ছিলেন। ইরফান সাহেব তাই হাসপাতালের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ইমারজেন্সি মেসেজ দিয়ে রাখেন, সকলকে যত দ্রুত সম্ভব জয়েন করার জন্যে। তখন সকাল আটটা, রবিবার।
ইতিমধ্যে খবর আসে, বামনডাঙ্গা থেকে অনেক মানুষের হতাহত হওয়ার খবর। মূলত চা বাগান ও চা বাগানের শ্রমিকদের বসবাস এই অঞ্চলে। তাদের মধ্যে বেশীরভাগই আবার আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এদিকে, নাগরাকাটা থেকে বামনডাঙ্গা যাওয়ার একমাত্র রাস্তা টানাটানি সেতু ভেঙে পড়েছে। তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তার নীচে বয়ে চলা গাঠিয়া নদী স্রোতে উত্তাল। বৈশাখ মাসে যদিও হাঁটু জলও থাকে না নদীতে। শুকনো বালির চর। হেঁটে পার হয়ে যায় মানুষজন।
ফার্মাসিস্ট গৌতম ভৌমিক, ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ি ডি আর এস থেকে আরোও কিছু প্রয়োজনীয় ঔষধ আনার জন্যে কথা বলে রাখেন জেলার আধিকারিকদের সঙ্গে। প্রস্তুত করেন, ফ্লাড ইমারজেন্সি ইনডেন্ট। কিন্তু বামনডাঙ্গায় পৌঁছাবেন কি করে! সমস্যা নিরসনে, দুরন্ত এক ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসে, এন ডি আর এফ। ভেঙে যাওয়া ব্রীজের সঙ্গে পাড়ের যোগাযোগ করতে, সেট করে দেয় জিপ লাইন। স্টেনলেস স্টিলের কেবলের ওপর দিয়ে, চাকার গড়ানে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার ব্যবস্থা। সাধারণত দুর্গম অঞ্চল পার হতে এই জিপ লাইনের সহায়তা নেওয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু তাতে কি!
প্রসঙ্গত, ব্লক ফার্মাসিস্ট গৌতম বাবু জানালেন শনিবারের দুর্যোগের পরের দিন থেকে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। রবিবারই পাঁচজন ভর্তি হয়। যদিও তাঁরা সকলেই ভালো আছেন বলে তিনি জানান।
রবিবার সারাদিনই, ব্লক মেডিকেল অফিসারের নেতৃত্বে বামনডাঙ্গায় চলে, আহত মানুষের প্রয়োজনীয় মেডিকেল পরিষেবা দেওয়ার কাজ। জ্বর কাশি এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি রোগভোগ ছাড়াও পেটের রোগের নানা ঔষধপত্র বিতরণ ও তা ঠিকঠাক খাওয়ার ব্যাপারে ভালো করে বুঝিয়ে বলা। সর্বোপরি, বিভিন্ন বন্য প্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত মানুষজনকে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বা এ আর ভি ইনজেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
কিন্তু যে রোমহর্ষক ঘটনাটির কথা না বললেই নয় সেটি সোমবার দিনের। তখন রাত প্রায় বারোটারও বেশী। খবর এলো বামনডাঙ্গায় একজন প্রসূতি মা কে দ্রুত ভর্তি করতে হবে হাসপাতালে। এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটলেন ইরফান সাহেব, সঙ্গে রেডিও টেকনোলজিস্ট রাহুল মহাশেঠ সহ আরোও কয়েকজন। সাত কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে তবে পৌঁছতে হয় টানাটানি ব্রীজের কাছে। ভাঙা ব্রীজের কারণে তখন একমাত্র উপায় বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের স্পিড বোট। তাতে চড়েই অত রাতে সেই উথাল পাথাল নদী পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে এগিয়ে এলেন সেই ইরফান সাহেবই। রাহুল বাবু আমাকে বললেন, সেই প্রসূতি মা ইতিমধ্যে একটি ফুটফুটে শিশুর জন্ম দিয়েছেন হাসপাতালে।
বর্তমানে জল নেমে যাওয়াতে, নদী খাতে ট্রাক্টরে করে ত্রাণ পারাপারের কাজ শুরু হয়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে সেতু মেরামতের কাজ ও।
কিন্তু এই পর্বের নাগযাকোটের এই নায়কদের কথা সত্যিই অবিস্মরণীয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন ঃ
পুরো লেখাটি টেলিফোনিক সাক্ষাৎকার ভিত্তিক। ফার্মাসিস্ট গৌতম ভৌমিক ও রাহুল মহাশেঠ এর সঙ্গে কথা বলে লেখা। সঙ্গের ছবিও রাহুল বাবুর দেওয়া।
সর্বোপরি, এই লেখার পেছনে যার বদান্যতার কথা স্বীকার করতেই হয়, তিনি বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালের সিনিয়র ফার্মাসিস্ট অলক সাঁতরা। তিনি ফোন নাম্বার জোগাড় না করে দিলে এই লেখা সম্ভব হতো না।
ধন্যবাদ!


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন