পুনর্জন্মে তাঁর বিশ্বাস ছিল না একেবারেই, তবু যদি আপনি রাজা হতেন তবে রাণী কে হত গোছের প্রশ্নের মত, তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হল - পরের জন্মে তিনি কি তাঁর বর্তমান জীবনকেই পুনরায় ফিরে পেতে চাইবেন? উত্তর দিতে বেশীক্ষণ সময় লাগাননি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সটান বলে দিয়েছিলেন – না! তার মানে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর জীবনের দ্বিতীয় ভাগ চান নি! অদ্বিতীয়, থাকতে চেয়েছেন।
পরক্ষণেই অবশ্য, তাঁর ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠেছে মুচকি হাঁসি; বলেছিলেন, সুনীল নয়; সেরকম সুযোগ পেলে তিনি একজন মেয়ে হয়েই জন্ম নিতে চান। কারণ, মেয়েদের জীবনটা তাঁর ভালো করে জানা নেই। কিংবদন্তী গায়িকা, লতা মঙ্গেশকরও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - তিনি আর লতা মঙ্গেশকর হতে চান না। কারণ লতা মঙ্গেশকরের জীবনটা ভীষণ যন্ত্রণার।
এখন প্রশ্ন জাগে, সুনীল কি তাহলে তাঁর লেখক সত্তারও আগে যৌন তৃপ্তির বিষয়টাকেই বেশী এগিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন? কারণ তাঁর মেয়ে হতে চাওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি যে নারী জীবনের গভীরতাকে আরও নিবিড় ও সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলতে চান, এমন কোনো আভাস কিন্তু কোথাও ব্যক্ত করেন নি। অর্থাৎ সূক্ষ্ম ভাবে নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতেই তিনি পরের জন্মে নারী হতে চান, এমন কথা কোথাও বলেননি। উল্টে তাঁর সাহিত্য শিল্পী হিসেবে সার্বিক তৃপ্তির স্বীকারোক্তি - তাঁকে যে কোথাও নারী হওয়ার প্রেরণা জোগাতে পারে, এমন ভাবনাকেই সরাসরি নাকচ করে দেয়। সেদিক থেকে, মানুষ হিসেবে তাঁর ঘোষিত অতৃপ্তির কথাই, তাঁর নারী জীবন যাপনের ইচ্ছার পেছনে থাকা মূল চালিকাশক্তি বলে মনে হয়। যে সুনীল একদা আক্ষেপ করেছিলেন, জীবনে যদি একটা ‘ঢোড়াই চরিত মানস’ লিখতে পারতাম বলে; যিনি এত জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি করার পরেও বলেন, কোনো লেখা লিখেই তিনি সম্পূর্ণ ভাবে তৃপ্ত হতে পারেন নি, তাঁর শিল্পী মানসের তৃপ্তির কথা তাই দ্বৈত ভাবনার জন্ম দেয়।
তবে তাঁর মানুষ হিসেবে যে অতৃপ্তি তা যে কোনোভাবে প্রেমজ বা যৌন আকাঙ্খা প্রসূত নয়, সে ব্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু কোনোরকম ধোঁয়াশা রাখেন না। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের, অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ লেখক যিনি শৈশব কাটিয়েছেন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দশ বছর ও সেই সময়কালে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ ও মন্বন্তরের আতঙ্ক, বিপন্নতা ও ক্ষুধার পীড়নকে সঙ্গী করে তাঁর পক্ষে মনুষ্যত্ব বোধের এই অতৃপ্তি অস্বাভাবিক নয়। মনুষ্যত্বের মহত্বাকাঙ্খা যে তাঁকে অস্থির করে তুলবে, সেটাই প্রত্যাশিত। জীবনের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে আসার পর তাই তাঁর মনে হয় - মানুষ হিসেবে তিনি কি আরও উঁচু, আরও মহৎ, আরও উদার হতে পারতেন না?
ঘটনাচক্রে, সুনীল এই কথাগুলি যখন বলছেন তখন তিনি সুইডেনের স্টকহোমে। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ, ১৯৮৫ সাল। প্রবাসী বাঙালীদের সঙ্গে এক ঘরোয়া আলাপচারিতায় তিনি উপস্থিত হয়েছেন, নোবেলের শহরের একটি সাধারণ দোতলার ফ্ল্যাটে। বার্ষিক নির্ঘণ্ট অনুসারে, মাত্র এক মাস আগে - অক্টোবর মাসের গোড়ায়, নোবেল কমিটির থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সে বছরের নোবেল প্রাপকদের নাম। সেবার, সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন, ফরাসি লেখক ক্লদ সিমো। সুনীলের নাম কি মনোনীতদের তালিকায় ছিল সেবার। নোবেল কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুসারে, সালওয়ারী মনোনীতদের নামের তালিকা ৫০ বছরের আগে সর্ব সমক্ষে আনা হয় না। তাই সুনীলের নাম থাকা না থাকা নিয়ে জানতে আরও কয়েকবছর সময় লাগবে। কিন্তু সুনীল যেহেতু ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন তাই নোবেল প্রাপ্তির আর কোনো সম্ভাবনা নেই তাঁর। রবীন্দ্রনাথের পরে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঙালীর যে নোবেল স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল তার অবলুপ্তি ঘটে গেছে চিরতরে। সুনীল নিজে যদিও, তাঁর নোবেল উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে কখনো কোনো উচ্চবাচ্য করেননি, কিন্তু বাংলার অন্যান্য সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষ করে শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর বা মানিকের এমনকি সতীনাথ ভাদুড়ীরও যে নোবেল পাওয়া উচিৎ ছিল সে ব্যাপারে বহুবার সরব হয়েছেন। এখন প্রশ্ন, নিজের ব্যাপারে তাঁর এই অনাকাঙ্খার কারণ কি প্রত্যাশার কুহকী চাপের কাছে নিজেকে সমর্পণ না করার কৌশল? প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ (১৯১৩ য়, ৫২ বছর বয়স) যত বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কাকতালীয় ভাবে ১৯৮৫ তে সুনীল যখন স্টকহোমে পৌঁছালেন, তাঁর বয়সও ছিল সেই ৫২ বছর। ততদিনে তাঁর ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘সেই সময়’ সহ আরও অনেক কালজয়ী উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে। সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার রঙ, তাঁকে ঘিরে যে আশার রামধনু তৈরি করেছিল তা এককথায় অনস্বীকার্য। তাই তিনি সেবার স্টকহোমে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সেখানকার কালচার সেন্টারে বক্তৃতা করার জন্যে। পাশাপাশি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকা গোষ্ঠীকেও। সেক্ষেত্রে, সেখানকার প্রবাসী বাঙালীরাই বা শুধুশুধু বাদ যাবেন কেন। স্টকহোম বিমান বন্দর থেকেই, সুনীলের সঙ্গে তাঁরা লেপটে ছিলেন।
সেদেশে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চাকারীরাই ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের বাবুল সিরাজী এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারত থেকে মিহির বিশ্বাস; যাদের উদ্যোগে মুলত সুনীল সেখানে একটি ঘরোয়া আড্ডায় মিলিত হন। অনেক রাত অব্দি চলে প্রশ্ন উত্তরের পালা। শৈশব থেকে শুরু করে, জীবনের প্রথম লেখা কবিতা; রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, জীবনানন্দ; মুজিবর রহমান থেকে প্রিয় রং, প্রিয় খাবার; বাদ যায়নি জীবনের প্রথম প্রেম নিয়ে আবেগ ঘন স্মৃতিচারণও। কিন্তু সুনীল কি তাঁর সাহিত্য কীর্তি নিয়ে একটু বেশীই উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন সেদিন? নাকি
অভিমান! মৃত্যুর পরে তাঁকে কিভাবে পৃথিবী মনে রাখবে তাই নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠায় কি সেদিন, অপ্রাপ্তির হতাশাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার
বোহেমিয়ানাই প্রকাশ পায় নি? ভাঙা হাটের শেষ বিক্রেতার মতো, তাই কি তাঁর মুখ থেকে সেদিন শোনা গিয়েছিল বৈরাগ্যের চূড়ান্ত অভিরাগ, “শেষ নিঃশ্বাস টুকু ফেলবো, ওখানেই
ফুরিয়ে যাবো।"
এটা ঠিক, তিনি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর
সাহিত্য সৃষ্টিকে মনে রাখার প্রশ্নে, রবীন্দ্রনাথের মত তাঁর মনে যে কোনো সুপ্ত আকাঙ্খা ছিল
না, এটা ভাবতেও বেশ কষ্ট লাগে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি,
কৌতূহল ভরে”। সেখানে সুনীল বলেন, “মৃত্যুর পরে, কেউ কেউ ছবি করে কিছুদিন ঝুলাবে,
কেউ কেউ ঝুলাবে না।" তাতে, কিছু
এসে যায় না। "জীবনের পর মৃত্যু; তারপর শেষ!" "কয়েকদিনের খেলা মাত্র।"
তথ্যসুত্রঃ ১৯৮৫ সালে, স্টকহোম-প্রবাসী কথাসাহিত্যিক, বাবুল সিরাজীর সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একান্ত কথোপকথনের দীর্ঘ কাটাছেঁড়ার ফল এই লেখা। ৮৫'র দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর বাদে, ২০১৯ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর, সুনীলের জন্মদিনে, এতদিনকার অপ্রকাশিত থাকা সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েব পেজে।



মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন