সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিবের মুখে গুন্টার গ্রাসের গোঁফ!

গোল বেঁধেছে স্বপ্নাদেশ নিয়ে। সে আবার, যার তার নয়। স্বয়ং শিবের। রঙের শিল্পী রামচাঁদ আজ তাই খানিক বেপরোয়া । রাত পোহালেই কালী পুজো। বালিগঞ্জ, নরেশ মিত্র লেনের, পেয়ারা বাগান বস্তির দেওয়ালে মা কালীর নাতিদীর্ঘ, খোদাই করা মূর্তি; সামনে ফুটপাতের ওপরে - একটুখানি চৌকো মত সিমেন্টের চাতাল; তার ওপরেই, রঙ তুলি নিয়ে বসেছে রামচাঁদ। বছরকার পুজার আগে, মায়ের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া গা'য়ে পুনরায় রঙের আভাস ফুটিয়ে তুলতে, যত্নের খামতি নেই তার। কিন্তু এ কি! শিবের এমন শুভ্র, টিকালো নাকের নীচে, দীর্ঘ দিনের পাকা শিল্পী রামচাঁদ, এটা কি করছে? বাটিতে রাখা কালো রঙের দ্রবণে তুলি চুবিয়ে, এমন মোটা মোটা করে পোঁচ মেরে যাচ্ছে সে, যে কারুরই নজরে পড়বে। পাশে, রাস্তার ওপরে ছেলেরা লঙ্কা পটকা ফাটাচ্ছে হরদম। হুটোপাটা চলছে। তার মধ্যে রামচাঁদ, অবিচল তার কাজে। একমাত্র রক্ষে, রবিবার বলে; অন্য দিনের মতো, তত লোকজন নেই রাস্তায়।

এদিকে রঙ আর তুলির সুনিপুণ টানে - শিব ঠাকুরের ঠোঁটের ওপরে, বেশ একটা মার্ক টোয়েন মার্কা গোঁফ ফুটে উঠছে ক্রমশ। চওড়া, ঝাপানো; কেমন ওয়ালরাস প্রতিম।
কয়েকদিন আগে, এক কর্পোরেট হাসপাতালের জনৈক ডাক্তারের মুখে এমন গোঁফ দেখে, উৎসাহ চেপে রাখতে পারিনি, বলে ফেলেছিলাম, "আপনার গোঁফ খানা, পুরো গুন্টার গ্রাস স্টাইলের!" যদিও উনার গোঁফের যা ছিরি, হাইওয়ের ধাবায় টাঙানো সাইনবোর্ডের সেই বহু পরিচিত আপ্যায়ন মুখো কার্টুনের চেয়ে কিছু ভালো নয়; ঠোঁটের দুদিকে যেন দুটো হাতীর শুঁড় ঝুলে আছে। খুব ভালো বললে, হবু রাজার মতো বলা যায়। যাই হোক, ডাক্তার বাবু শুনে বেশ গদগদ হয়ে বললেন, "ঠিক পরিচর্যা করা হয় না তাই...!" "তবে আমি গ্রাসের ভীষণ বড় ভক্ত!"
সেই কবে, ২০১৫ সালে গুন্টার গ্রাস প্রয়াত হয়েছেন। তারও ১০ বছর আগে, ২০০৫ এ শেষবারের মতো কোলকাতায় এসেছিলেন তিনি। কোলকাতার প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা সুবিদিত। রিক্সাওয়ালা থেকে কাগজ কুড়ুনি; একসময় বারুইপুর থেকে বালিগঞ্জ, প্রবল ভিড়ের মধ্যেই ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে বেরিয়ে, ফুটপাতের হা ঘরে মানুষজনই তাঁর ডায়েরির পাতায় ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে। কাঠ কয়লার স্কেচে এঁকেছিলেন সেই সমস্ত ছবি। সেটা গত শতাব্দীর আটের দশকের কথা। ৮৬ সাল। ছয় মাসেরও বেশী সময় ছিলেন তখন।
কিন্তু, বালিগঞ্জের রঙের শিল্পী রামচাঁদের সঙ্গে তো গ্রাসের কোনোদিন দেখাই হয়নি। সে জানেও না, গ্রাস কে ছিলেন, কি বৃত্তান্ত। তাও, শিবের মুখে গ্রাসের গোঁফ আঁকাতে, রামচাঁদের যে কেন এত আগ্রহ তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না পেয়ারা বাগান বস্তির কোনো মানুষজন। পুজোর অন্যতম হোতা - হাবু, খানিক দেখতে এসেছিল রঙের কাজ কতদূর এগুলো। এসে সে যা দেখলো! ওরে বাব্বা ! শিবের অমন কালো, ঠোঁট ঝাপা গোঁফ দেখে তো তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। "এটা কি করছিস রামু?" "তোর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?"
"দাদুর জন্মেও, শিবের অমন বাঘের মতো মোচ দেখিনি!"
"আমি কি জানি!" অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর, রামচাঁদ এবার মুখ খোলে।
"মানে?" হাবু ধমক দিয়ে উঠলে, রামচাঁদ কেমন গুটিয়ে যায়। মিনমিনে গলায় বলে, "শিবের নির্দেশ!"
"অ্যাঁ..! কি বলছিস কি রে তুই!" কথা শুনে, সবার মাথা চটকে যাওয়ার জোগাড়।
"তা শিবের নির্দেশ, শুনি সেটা কিভাবে!"
"গতকাল ভোর রাতে, স্বপ্নে এসেছিল শিব ঠাকুর!" রামচাঁদ যখন কথাগুলো বলছিল, তার মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর চুলের মধ্যে থাকা দুটি কোটরাগত চোখ যেন তেঁতুল পাতার মতো কাঁপছিল ফিরফির করে।
"শিব ঠাকুর বললো, আমার মনের কথা কেবলমাত্র একজন বুঝেছিল। সে হলো গুন্টার গ্রাস!" "কোলকাতায় আঁকা তার ছবিগুলি নিয়ে, সে ফিরে গিয়েছিল তার নিজের দেশ জার্মানে!" "তারপরে, ছবি সমেত ১২টি পর্বে লিখেছিল একটা দীর্ঘ কবিতা!" হাবু সহ আরোও কয়েকজন - যারা রামুর কান্ডকারখানা দেখতে, পরপর এসে দাঁড়িয়েছিল কালিতলায়, তারা তো শুনে থ। আট ক্লাস পড়া রামু, এ সব কি বলছে! ভূতে ধরলো না তো!
"তারপরে শিব ঠাকুর বললে কি জানো? যে কথা নাকি তিনি কোনোদিন বলতে পারেননি তাঁর নিজের আপন স্ত্রী কে, তাই নাকি বলতে পেরেছিলেন ঐ জার্মান লেখক!"
কি, কি বলেছিল সেই লেখক? সকলে প্রায় সমস্বরে জিজ্ঞাসা করে উঠলো।
"শিব ঠাকুর বললো- আমার মনের কথাই ও লিখেছিল। যথার্থই বলেছিল ও কালী কে - জিভ কাটো লজ্জায়!"
ওরে বাব্বা! এ তো মস্ত বড় কথা! তা শেষপর্যন্ত, কি নির্দেশ দিল তোকে মহাদেব, সেটা এইবার বল দেখি শুনি? বললো - ওই শিব গিরি করে আর লাভ নেই বুঝলি। মুখ বুজে শুয়ে শুয়ে, মেরুদন্ড বেঁকিয়ে যাচ্ছে। পাশ ফেরার জো টি নেই।
তার চেয়ে বরং কিছুটা ব'লে ভার মুক্ত হওয়া ভালো। মুখ ফসকে নয়, বেশ সপাটেই বলে দেওয়া উচিত এবার - জিভ কাটো লজ্জায়।
তুই বরং আমায় গুন্টার গ্রাস সাজিয়ে দে। গুন্টার নাকি চুরুট প্রেমী ছিল। তা আমিও ধুম্র সেবনে কম যাই না। তুই আমাকে অন্তত ওর মতো গোঁফটা করে দিস। তাতেই হবে।
শিব ঠাকুর তারপরে, ঐ লেখকের একটা ছবি, গুগল থেকে বেরকরে দেখালো; বললো - ইনি ১৯৯৯ এ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন বুঝলি। এমনি এমনি নয়। সেবার কোলকাতায় এসে, শিল্পী শুভা প্রসন্নের বাড়িতে কালী পুজো দেখতে গিয়ে, প্রায় ধ্যান মগ্ন হয়ে গিয়েছিল। আমার কষ্টের কথা তার বিবেকে বড়ই লেগেছিল রে।
শিব ঠাকুর যখন এইসব বলছিল, গুন্টার গ্রাসের গোঁফের নীচে তখন এক চলক, দুষ্টু হাসির চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে, হাতে ধরা ছিল একটি বেতের কাঠি; যা দিয়ে, জোরে জোরে বাজিয়ে চলেছিলেন টিনের ঢোল। 'দা টিন ড্রামার।'

নোবেল জয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস!  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...