ঘোটক-সিংহ, মালকোষ রাগে সানাই, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঠাকুর দালানের প্রবেশ মুখে- ঝাড়বাতি ঝোলা লম্বা করিডোর, পদ্ম পাঁপড়ি তোলা, সুদৃশ্য সাত খিলান এবং আট স্তম্ভ বিশিষ্ট দক্ষিণ মুখী, নকশা তোলা রাজসিক নাটমন্দির, পেছনে মাটির দুর্গা বেদী, তারও পশ্চাতে - মা রাজ রাজেশ্বরী, কমলা গায়ের- দেবী জগদ্ধাত্রী; গর্ভ গৃহের চারিদিকে- সবকটি স্তম্ভের পেটে লম্বা লম্বা আয়না টাঙানো, তলায় রাজ পরিবারের সদস্যদের বসার সুভব্য আয়োজন। বৈঠকখানার মেজাজ। এখানে মা, ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধাভিসারিনী। ঠাকুর মশাইয়ের কথায় মূর্তিকার পালেরা তখন সিংহ কেমন জানতো না। তাই সিংহ জ্ঞানে ঘোড়াই এখানে মায়ের বাহন। কৃষ্ণনগরের, রায় বাড়ির পুজোতেও, মায়ের বাহন হিসেবে ঘোটক-সিংহ কে দেখা যায়।
মাইকে - মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ, ভেসে বেড়ায় হাওয়ায়; প্রাসাদের বিরাম কক্ষ থেকে রাজ বাড়ির লাল প্রাকার পেরিয়ে, নহবতের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়; ফটকের বর্শা-ফলা শোভিত লৌহ দ্বার ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে, বাইরের রাস্তার দুপাশে বসা অগুন্তি খাওয়ারের দোকান গুলিতে।
তাতে কোথাও ভাজা হচ্ছে পাটিসাপটা, ভাপা পিঠে, কোথাও গোল বড়ার মতো দেখতে মথুরাপুরী কেক। গরম তাওয়ায়, তেল ঘষার জন্যে বেগুনের কাটা বোঁটার ব্যবহার বেশ লাগলো। ক্ষীরের মালাই, জিলিপি, পাঁপড় ছাড়াও হরেক রকমের ফুচকা দোকান ঘিরে ছোট ছোট ভিড়, বেশ চোখে পড়ার মতো। । রঙীন, বড় বড় ছাতার নীচে দেদার বিক্রি হচ্ছে দই ফুচকা, চকোলেট ফুচকা থেকে জল ফুচকা এবং এখানকার বিশেষ স্বাদের চুরমুর।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে, কৃষ্ণনগর গামী সকাল ৯টা ৪৮ এর এ সি লোকাল ট্রেন, একটুর জন্য ধরতে পারেননি, শ্যামল দা। এই নিয়ে ৩৪ বার, কৃষ্ণনগর যাচ্ছেন জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে। দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই এর বাড়ি সেখানে, বৌবাজার এলাকায়। পাশেই, আদি মা'র নাম করা পুজো হয়। কৃষ্ণনগরে সবার বাড়িতে আত্মীয় স্বজন ভর্তি থাকে এই সময়। পুজোর দিন, কারুর বাড়ি যদি অতিথি বন্ধু কম আসে তবে এলাকায় তার মান থাকে না। ভাইয়ের সম্মান রাখতে তাই, শ্যমলদা সব কাজ ফেলে বেরিয়ে পড়েছেন।
কৃষ্ণনগরের রাস্তায়, বনেদিয়ানার ম্যাজিক দেখা য়ায় নবমীর সারাদিন, সারারাত। ব্লু টুথ থেকে সানাইয়ের সুর বাজে মাইকে, কোথাও আবার পাড়ার মাচায় বসে, নহবতের আখড়া। ডি জে বক্স চালিয়ে, তার সামনে উদোম নৃত্যের বেহায়াপনা কৃষ্ণনগরে নেই। মন্ডপ সজ্জায় তেমন বাহাদুরি দেখা না গেলেও, মূর্তির গাম্ভীর্য এবং ঐতিহ্যের আভিজাত্য রক্ষায় কোনো বারোয়ারী কমিটিই কোনোরকম আপোষ করে না।।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুধীর চক্রবর্তীর কৃষ্ণনগরে, মোড়ে মোড়ে চলে জগদ্ধাত্রী রঁদেভু। "ভিড়ে হারিয়ে কখনো দেখেছিস, কেমন লাগে!" কবিতার লাইনের মতো কথোপকথন ভেসে আসে হলুদ পাঞ্জাবী, তসর সিল্কের শাড়ি জড়ানো ছোট ছোট আইল্যান্ড থেকে।
শাড়িতে, এলোকেশে, বেলি ফুলের গজরার গন্ধে ম ম করে চারিদিক। ধুতি পরা ঢাকি, এবং ঢাকের পালকময় বাঁকানো পুচ্ছগুলো, এমন তালে তালে দুলে দুলে ওঠে, যে তাকিয়ে দেখতে হয়।
রাজবাড়ীর ভেতরে, অনেকগুলো পুরনো কাঠ গোলাপের গাছ রয়েছে। মন্দির থেকে প্রাসাদের দিকে যেতে, ঝরে পড়া কাঠ গোলাপ মাড়িয়েই ঢুকতে হয়। রাজসভার পাশে, চাঁপা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কৃষ্ণনাগরিকেরা আকছার কোচবিহারের রাজবাড়ীর কথা বলেন। সেখানকার স্থাপত্য শৈলী, সবুজ লন; উঠে আসে গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তীর নাম, মুনমুন সেনের শাশুড়ির প্রসঙ্গ।
জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা দিনই খোলা থাকে রাজবাড়ী। পুজোও হয় শুধু একদিনের জন্যে, কেবল মাত্র নবমীর। তান্ত্রিক মতে, তিনটি পর্বে সাঙ্গ হয় পুজো - প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন ও অপরাহ্নকালীন। বলা হয়, এই পুজোগুলোই যথাক্রমে সপ্তমী, অষ্টমী, ও নবমী পূজার প্রতিভূ।
তখন বেলা, একটা; শোনা গেল, বর্তমানে রাণী মা শ্রীমতী অমৃতা রায়,, মালোপাড়ার দিকে রওনা দিলেন; রাজবাড়ী থেকে পুজোর ঘটের জল নিয়ে।। এই জল ছাড়া ওখানকার পুজো শুরু হবে না । তার জন্যে, দক্ষিনা হিসেবে রানী মা'র হাতে ১১ টাকা তুলে দেওয়া হবে। রাজ বাড়িতে কাজ করা মালীরাই একসময়, এই পুজো চালু করেছিলেন। এখনোও এই নিয়ম চলে আসছে। এখানকার পুজোয়, মনস্কামনা পূর্ণ হলে ধুনো পোড়ানোর রীতি ভীষণ আকর্ষণীয়।
শ্যামল দা, আমাকে বলে দিয়েছিলেন, অবশ্যই চাষা পাড়ায় বুড়ি মা'র দর্শন করতে। বুড়ি মা ছাড়াও, আরোও মা রয়েছেন এখানে - বড় মা, ছোট মা, মেজ মা, বাঘাডাঙার বাঘা মা ইত্যাদি। তবে বুড়ি মা স্পেশাল। যেমন দীর্ঘ মূর্তি, তেমনি মাতৃত্ব ভাবে গম্ভীর। আকর্ণ চোখ, প্রায় ত্রিশ কিলো ওজনের সোনার গহনা পরানো হয় মায়ের গায়ে।
পলাশীপাড়া হাসপাতালের সিনিয়র নার্স ছিলেন দেবপ্রিয়া মজুমদার। পদে সিনিয়র হলেও বয়সে তত নয়। তখন তাঁর বিয়েও হয় নি। জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন, মায়ের গায়ে সমস্ত গহনা পরাতে হতো। তাই সেদিন তাঁর ছুটি থাকতো। উঁচু টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে, মায়ের মাথার চূড়া বা গলার হার পরানোর দৃশ্য নাকি বড় বিরল। চাষা পাড়াতেই তাঁর বাবার বাড়ি ছিল।
এই প্রসঙ্গে বলি, আমার সঙ্গে বুড়িমা'র প্রথম পরিচয় করান গণেশ দা, গণেশ বিশ্বাস। সদা হাঁসি মুখ, গণেশ দা ছিলেন আমাদের অফিসের ড্রাইভার। অফিসের কাজে, কৃষ্ণনগর আসতে হলে, উনি করিমপুর রোড ধরে এসে, কৃষ্ণনগর ঢোকার মুখে একটা শর্ট কার্ট রোড ধরতেন। তারপরে, কিছুটা যাওয়ার পরে, একটা পুরোনো ঠাকুর দালান দেখিয়ে বলতেন, "জানা বাবু, এটা বুড়ি মা'র মন্দির।" 'ভীষণ জাগ্রত!" "আড়াইশো বছরেরও বেশী প্রাচীন পুজো।"
আজ যখন প্রচুর মানুষের ঢল, প্রবল ভিড় ভেঙে কোনোমতে বেরিয়ে আসছি, রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সঙ সাজা শিব, কালী ও কৃষ্ণের সঙ্গে। বললেন, সারাবছর তাঁরা চাষের কাজ করেন। পুজোর সময় দুটো পয়সা ইনকাম করতে, সঙ সাজেন।
ও হ্যাঁ, আসতে আসতে দেখলাম সুন্দর আলপনা দেওয়া ছোট ছোট একতারা, 'জিভে বাঁশি' বিক্রি হচ্ছে। সুদূর অগ্রদীপ থেকে, কৃষ্ণনগরে এসেছেন বিক্রেতেরা, বাঁশ ও নারকেলের খোলা দিয়ে তৈরি এইসব বাদ্য সামগ্রী নিয়ে।
বিক্রি হচ্ছে বাঁশি ও একতারা!
পরিশেষে একটা মজার কথা বলতেই হয়, কাঁধে করে বিরিয়ানি হাঁড়ি বয়ে নিয়ে যেতে যেতে, হঠাৎ কি ভাবে বাঁশ থেকে খুলে পড়লো হাঁড়ি - একেবারে মাঝ রাস্তার ওপরেই। তবে রক্ষে, বিরিয়ানি পড়ে নি মাটিতে।










মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন