সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্মৃতির দেশে ফেরা!

গ্রামের দিকে দাদাগিরির খুব পরিচিত একটা ডায়ালগ হচ্ছে - মেরে তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো। সত্যিই কি তা সম্ভব? সেই উত্তর দেওয়ার আগে এইটুকু বলে নেওয়া ভালো, এটি কিন্তু আর দশটা টাপুরি মার্কা হুমকির মতো শুধুমাত্র বলার জন্য বলা নয়। এর পেছনে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে। এই প্রসঙ্গে যেটা বলার, বাপের নাম বা নিজের নাম ভুলে যাওয়ার মতো স্মৃতি হারোনোর ঘটনা কিন্তু হাত বা পা এমনকি বুকের পাঁজর ভেঙে গেলেও হয় না। হয় মাথায় আঘাত লাগলে। সেটা ডাক্তারবাবুদের মতো পাড়ার হেদিপেচি দাদারাও বেশ ভালো করে জানে।

এই প্রসঙ্গে যে তথ্যটি জানা খুব জরুরী সেটা হলো, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় দু কোটির মতো লোক মস্তিস্কে আঘাত পেয়ে আহত হন। ভারতবর্ষে সেই সংখ্যাটা প্রায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ। সিংহভাগ ক্ষেত্রে, পথ দুর্ঘটনাই এর মূল কারণ। উল্লেখ্য, এই ২০ লক্ষ মাথায় আঘাত পাওয়া মানুষের মধ্যে আবার ৫০ শতাংশ মানুষই ঘটনাস্থলে বা হাসপাতালে প্রাণ হারান। বাকি মানুষগুলো প্রাণে না মরলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পুরনো স্মৃতি পুরোপুরি অথবা আংশিক ভাবে লোপ পেয়ে যায়। ধূসর হয়ে যায় স্মৃতি। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে অতীতজীবন।
এখন প্রশ্ন, এই হারানো স্মৃতির কি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব? কেন, হিন্দি সিনেমা গুলোয় তো কত এইরকম ঘটনা ঘটে। আমাদের পাড়ার লাল্টুদা আবার বড় মুভি বিশেষজ্ঞ। গরম এক গ্লাস চা হাতে পড়লেই, মূর্তিমান মুভি-এনসাইক্লোপিডিয়া বনে যান তিনি। চোখ মুখ কুঁচকে, এমনভাবে বলবেন যেন মনে হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোনো আশাই নেই। শোন্, ঋষি কাপুরের 'হেনা' দেখ, বিয়ে করতে যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি গিয়ে খাদে পড়লো। ব্যাস মাথায় চোট, নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে জল। সে স্মৃতি ফিরলো পরে, তবে ততক্ষণে হেনা বলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে একেবারে একসা। আমির খানের 'গজনি'তেও তাই। এটি আবার ইংরেজি ছবি 'মেমেন্টো'র ছায়ায় বানানো।
এদিকে তার কথা কে শুনছে না শুনছে, সেসব দেখার দরকার নেই লাল্টুদার। চোখ না খুলেই, অনবরত বকে যাবে। কে বোঝাবে তাকে, স্মৃতি ফেরাতে গেলে নির্দিষ্ট পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় রোগীকে। এই প্রসঙ্গে বলে নিই, মাথায় আঘাত পাওয়ার পরে সাধারণত দু ধরনের স্মৃতি বিলোপের ঘটনা ঘটে। একধরনের যেখানে দূরবর্তী অতীতের কথা মনে থাকলেও সাম্প্রতিকতম অতীতের কথা বিস্মৃত হয় রোগী যাকে পরিভাষায় অ্যান্টেরোগ্রেড স্মৃতিভ্রংশ বলে। দ্বিতীয়টি হলো - দূর্ঘটনা পূর্বের স্মৃতি সম্পূর্ণ রূপে লোপ পেয়ে যাওয়া। যাকে রেট্রোগ্রেড স্মৃতিহীনতা বলে। এগুলো নির্ভর করে মস্তিস্কের অগ্রভাগ বা টেম্পোরাল অঞ্চলে আঘাত কতটা গুরুতর তার ওপরে। ফিল্মে সাধারণত দ্বিতীয় ধরনের স্মৃতিভ্রংশের ঘটনা বেশী দেখা যায়।
এদিকে লাল্টুদা অনেকক্ষণ পরে চোখ খুলে দেখেন, একমাত্র রমেন বেচারা বসে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। তাই সই। তাকে উদ্দেশ্য করেই, ধ্যান ভাঙা সাধুর মতো তিতকুটে মুখ করে বলেন, আরোও আছে, শুনবি?
'সদমা' ছবিতে শ্রীদেবী!
১৯৮৩ তে রিলিজ করেছিল, শ্রীদেবী ও কামাল হাসানের 'সদমা' । তামিল ছবির রিমেক এটি। ছবিতে, কার অ্যাকসিডেন্টে শ্রীদেবীর স্মৃতি পুরো চলে যায়। কামাল হাসান তাকে পতিতালয় থেকে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে তার স্মৃতি ফিরে আসে, কিন্তু সে আবার কামাল হাসানকে ভুলে যায়। মর্মান্তিক পরিণতি বুঝলি।
তবে সবক্ষেত্রে যে এমনটা হয় তা কিন্তু নয়। বরং মিলনান্তিকই হয় বেশী। যেমনটা সম্প্রতি হিমাচলের রিখি রামের ক্ষেত্রে ঘটলো। এমনকি এই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স, কোনো বলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্যকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
কয়েকদিন আগে, টাইমস্ অব ইন্ডিয়ায় এই নিয়ে খবর হয়েছে। রিখি ছিলেন তখন ষোল বছরের কিশোর। ৪৫বছর আগের কথা। আম্বালা যাওয়ার পথে, এক পথ দুর্ঘটনায় তার স্মৃতি সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি তার নিজের নাম, বাবার নাম বা জন্মস্থানের কথাও সে ভুলে যায়। ফলস্বরূপ তার নতুন নামকরণ হয়েছিল, রবি চৌধুরী। সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়ে, নতুন করে পথচলা শুরু হয় রবির। অজ্ঞাত হয়ে যায়, পূর্বের রিখি রাম। স্মৃতি হারানোর পরে, অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বিষয়টিকে পরিভাষায় বরোড মেমোরি বা ধারকরা স্মৃতি বলে।
বর্তমানে, মুম্বাইয়ের নানডেড়ের এক কলেজে কর্মরত রবি চৌধুরী, বিয়েও করেছিলেন ইতিমধ্যে। বর্তমানে তিন সন্তানের বাবা তিনি। কিন্তু বিধির লিখন, কয়েকমাস আগে রবি চৌধুরী, পুনরায় এক দুর্ঘটনায় পড়েন এবং মাথায় চোট পান। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হওয়া। কিন্তু এর পরে যা ঘটলো তা এযাবৎকাল কোথাও হয়নি, এমনকি ফিল্মের পর্দাতেও নয়।
বিষে বিষে বিষক্ষয়ের মতো কিংবা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো, আশ্চর্যজনক ভাবে রবি চৌধুরী তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি ফিরে পেতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল তার পূর্বের নাম। গ্রামের নাম - নাভির কথা; হিমাচল প্রদেশের সাতাউন জেলায় অবস্থিত সেই গ্রাম।
কখনো কখনো স্মৃতি ফেরাতে সক থেরাপি বা মাথার মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালনার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়, যাকে ই সি টি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মাথায় পাওয়া চোটের পুনরাবৃত্তিতে স্মৃতি ফিরে পাওয়ার ঘটনা এখনোও পর্যন্ত বিরলতম।
১৫ই নভেম্বর, শেষমেশ রিখি তার গ্রামে গিয়ে তার ভাই বোনেদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তার বাবা বা মা কেউই বেঁচে নেই এখন, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন রিখি আর বেঁচে নেই।
স্মৃতি ফেরার স্মৃতিকথায় নিঃসন্দেহে এটি একটি স্মরণীয় সংযোজন হয়ে থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...